আয়েশা (রাঃ)-র বিবাহকালীন বয়স ইন্টারনেটে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সমালোচনা করা, গালিগালাজ করা এবং তাঁকে যৌনবিকৃতিসম্পন্ন মানুষ সেটা প্রমাণ করার জন্য প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। এটা নিয়ে ইসলামি মনোভাবাপন্ন লোকজন নানারকম জবাব দেয় এবং অনেক জবাবই বেশ যুক্তিযংগত। কিন্তু তবুও শিক্ষিত মুসলমানরা আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স নিয়ে কিছুটা হলেও হীণমন্যতাই ভুগেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। একদিকে তাঁরা ইসলামকে ভালবাসেন, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ভালবাসেন, অন্যদিকে মুহাম্মদ (সাঃ) একজন কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সেটা মানতে তাঁদের কষ্ট হয়। (এখানে একটা তথ্য উল্লেখ করা দরকার যে মুহাম্মদ (সাঃ) মুসলমানদের অলমোস্ট সব বিষয়ে অনুসরনীয় হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা না। যেমন রাসুল (সাঃ)-এর বিয়ের সংখ্যা এবং বিয়ে সংক্রান্ত কিছু অন্যান্য বিষয়াদির ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য তাঁকে অনুসরন করার বিধান নেই, তাই মুসলমানদেরকে নয় বছরের মেয়েকে বিয়েও দিতে হবেনা এবং করতেও হবে না।)
এটাচড ছবিটা ভালমতে লক্ষ্য করুন।
ছবিটি দেখে কি মনে হয়? ছবির পুরুষ এবং মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি? আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছি, সে বলেছে ছবির মেয়েটা পুরুষটার কন্যা হয় সম্পর্কে। তাকে দোষ দেওয়া যায় না, আমরা বর্তমান সমাজের মান ধরে বিচার করলে সেটাই মনে হবে। আদতে ছবির পুরুষটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মেয়েটা তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দুজনকে বেমানান মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে নিতান্তই শিশুর মত মনে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেন ১১-১২ বছরের একটা মেয়েকে, সেটা তখন অস্বাভাবিক মনে হয়নি। বিয়ের ২ বছর পর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান হয়। তেমনি ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ তার মেয়ে রেনুকা দেবীকে বিয়ে দেন মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়সে (তাও রেনুকা তার বরকে কোনদিনই দেখেননি, কোন পরিচয়ই ছিলনা বিয়ের পূর্বে)।
এ ঘটনা দুটো মাত্র এক-দেড়শ বছর আগের বাংলার সবচেয়ে শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, আধুনিক পরিবারের বাংলা সাহিত্যের বরপুরুষ ইংরেজি-শিক্ষিত এবং বিলেত-ফেরত রবীন্দ্রনাথের। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের পরিবার ছিল একেশ্বরবাদি ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। এই ধর্মের লোকজন সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত এবং আধুনিক ছিলেন, নারী শিক্ষাকে তারা গুরুত্ব দিতেন। এত কিছুর পরও রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেছিলেন ১১-১২ বছরের একটা বালিকা, নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন সাড়ে দশ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ বালিকা বিবাহ করে সমাজের কোন বিরোধিতার মুখোমুখি হননি, তাঁকে কেউ কোন অপবাদ দেয়নি কম বয়সি মেয়ে বিয়ে করাতে। তার মানে মাত্র এক থেকে দেড়শ বছর আগের বাংলার সবচেয়ে শিক্ষিত, আলোকিত এবং সংস্কৃতিবান সমাজে ১০-১১ বছরের মেয়ে বিয়ে করা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প "হৈমন্তী"-র হৈমন্তীর ১৭ বছর বয়সে বিবাহ হওয়াতে আইবুড়ো অপবাদ পেয়েছিল, শ্বাশুড়ি ১১ বছর বয়স বলার জন্য হৈমন্তীকে অনুরোধ করেছিল। এমনকি শ্বাশুড়ির কাছে ১১ বছরও বাড়ন্ত ছিল, যদিও হৈমন্তির স্বামী সে সময়ের বিএ পাশ শিক্ষিত ছিল।
মেয়েদের বিয়ের বয়স মধ্য-বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ৫/৬ থেকে ১০/১১ এরকমই ছিল (ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল, আমি গড়ে যা ঘটত সেটাই বলছি); ছোটকালে শুনেছি আমার দাদীর বিয়ে হয়েছিল মাত্র সাত বছর বয়সে। সে সময়ে যে মেয়ের যত ছোট বয়সে বিয়ে হত, সে সেটা নিয়ে গর্ব করত, কেননা আগে বিয়ে হওয়া মানে সুন্দরি হওয়ার প্রমাণ। কিছু ব্যতিক্রম ব্যাতিরেকে সারা বিশ্বেই মোটামোটি মেয়েদের বিয়ে হত পিরিয়ড হওয়ার পরপরই, অনেকের তারও আগে হয়ে যেত। পিরিয়ড হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী সহবাসের জন্য নতুন বালিকা-স্ত্রী পিরিয়ড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে রেনুকাকে সাড়ে দশ বছর বয়সে বিয়ে দিলেও, ১৮৮৭ সালে, মানে রেনুকার বিয়ের অন্তত এক যুগেরও বেশি আগে থেকেও মেয়েদের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার মানে এই দাড়াই যে রেনুকাকে যখন সাড়ে দশ বছর বয়সে বিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ সেটাকে বাল্য বিবাহ হিসেবে দেখেননি, বরং হয়ত সেসময় সমাজে প্রচলিত ৩-৫ বছরের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রথাকে তিনি বাল্যবিবাহ মনে করেছেন।
বিয়ে এবং বিয়ের বয়স দুটাই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রপন্ঞ। সমাজ তার প্রয়োজনের নিমিত্তে নিয়ন্ত্রন করেছে বিয়ের আওতা এবং বিয়ের বয়স। জ্ঞান-ভিত্তিক আধুনিক সমাজ বিকশিত হওয়ার পুর্বে, প্রাক-আধুনিক যুগে সমাজব্যবস্থা ভেবেছে তার সুস্থ, কর্মক্ষম মানুষ দরকার, তা নাহলে সমাজ টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। বিয়ের মাধ্যমে দীর্ঘকালীন কমিটমেন্টের বদৌলতে একটা পারিবারিক আবহ সৃষ্টি করলে শিশুর প্রয়োজনীয় যত্ন নেওয়া এবং শিশুকে সমাজের প্রয়োজনে বড় করা সহজ হয়ে ধরা দিয়েছে যুগে যুগে মানবসমাজের কাছে। পারিবারিক দৃষ্টিভংগী থেকে যে পরিবারের যত বেশি কর্মক্ষম সন্তান থাকত, বিশেষ করে পুরুষ সন্তান, সে পরিবার তত বেশি প্রভাবশালী ছিল। তাই সন্তান জন্মদানের সম্ভাব্যতা, সন্তান লালন-পালন করে বড় করার যোগ্যতা, এবং বেশিদিন ধরে সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা এইসব ছিল পাত্রী আনার ক্ষেত্রে পুরুষদের এবং পাত্রের পারিবারের মূল চাহিদা। সামাজিক দৃষ্টিভংগী থেকে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান/প্রথাকে জারি রাখার জন্য মোটামোটি সব সমাজেই মানুষ কতজন বিয়ে করতে পারবে এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ আর ভারসাম্য কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এসব নিয়মকানুন আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনবোধে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াতে বিয়ের ছোটখাট ডিটেইলসও ভিন্ন হয়েছে, তবে মূল প্রতিষ্ঠানিক স্পিরিট হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তত থেকেছে। একই সমাজের বিয়ের নিয়ন্ত্রণের দিকও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে আর্থ-সামাজিক কারনে। যেমন কোন সমাজে যদি যুদ্ধবিগ্রহের কারনে পুরুষের সংখ্যা অনেক কমে যায়, সামাজিক শৃংখলা টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পরবর্তীতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য পুরুষদেরকে বেশি স্ত্রী নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে কোন সমাজে, আবার একই সমাজে যখন স্বাভাবিক অবস্থা চলেছে এবং পুরুষ-মহিলার সংখ্যার ভারসাম্য বজায় থেকেছে তখন পুরুষদেরকে কম বিবাহ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছে। এরকমও হয়েছে কোন সমাজে সুস্থ-কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরীর জন্য যেসব পুরুষ শারিরীক দিক দিয়ে শক্তিশালী এবং তার সন্তানও শক্তিশালী/কর্মক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তখন এরকম পুরুষকে অনেক বেশি বিয়ে করার জন্য সমাজ উৎসাহিত করেছে, বিপরীতে ক্ষীনকায়/দূর্বল পুরুষদেরকে বিয়ে না করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। কোন জনগোষ্ঠীকে যখন অন্য কোন জনগোষ্ঠী যুদ্ধে পরাস্ত করেছে, তখন পরাজিত জনগোষ্টীর নারীরা স্বেচ্ছায় বিজয়ী সৈন্যদের সাথে সংগম করতে আগ্রহী হয়েছে যাতে নিজেদের বীরপুরুষ সন্তান প্রসব হয়, এ ধরণের ঘটনারও ইতিহাসে অনেক প্রমাণ আছে।
প্রাক-আধুনিক সমাজে সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালনই যেহেতু সমাজের দৃষ্টিতে মেয়েদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ ছিল, এবং মানুষের আয়ু যেহেতু কম ছিল (গড়ে ত্রিশ বছরের বেশি বাঁচার আশা করাটাও অনেক সময় অকল্পনীয় ছিল), তাই মেয়েদেরকে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায় ততই সেটাকে সমাজ মঙ্গলজনক মনে করেছে, এতে করে বেশিদিন সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতা থাকবে বলে সমাজ ধারনা করত। মেয়েদের আসল আশ্রয়স্থল স্বামীর ঘর এই ধারণা সমাজের প্রয়োজনের নিমিত্তেই সেসময় বৈধতা লাভ করেছিল, তাই মেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সেখানে অভ্যস্ত হওয়া এবং পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা মেয়ের মা-বাবার কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি শ্বশুরবাড়ির সবার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য অনেক সময় মেয়ের পিরিয়ড হওয়ার পূর্বেই, এমনকি ৪/৫ বছর বয়সেও মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত, যাতে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সেটাকে নিজের আবাসস্থল হিসেবে গড়ে নিয়ে যেতে পারে, নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে পারে এবং পিরিয়ড হওয়ার পরপরই সন্তানধারণের জন্য মানসিক এবং শারিরীক প্রস্তুত থাকে। রবীন্দ্রনাথ যখন তার মেয়ে রেনুকাকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন যে মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিলে সে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সে বাড়ির রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হতে পারবে, সে বাড়িকে তার নিজের বাড়ি মনে করে সেখানে তার একটা অবস্থান গড়ে উঠবে, সে বাড়ির লোকজনও তার সাথে কম বয়স থেকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে, তাই যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায় ততই ভাল। উল্লেখ্য গ্রাম এলাকায় এখনো যারা খুব অল্প মেয়ে বয়সে বিয়ে দিতে চান, তাদের যুক্তিও এটাই। যদি মেয়েকে লেখাপড়া করার সামর্থ্য বা ইচ্ছে না থাকে, তাহলে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে এ অবস্থানকে অযৌক্তিক বলার উপায় নেই। (এখানে উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আয়েশা (রাঃ)-কে বিয়ে করেন, আয়েশা (রাঃ)-র পিতামাতাই আয়েশা (রাঃ)-কে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাড়িতে দিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন, আরো উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ের আগে আয়েশা (রাঃ)-র অন্য একজনের সাথে বাগদান হয়েছিল, সে লোক নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল, এর পরে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে বিয়ে হয়। তার মানে সে সমাজে আয়েশা (রাঃ)-র যে বয়স ছিল সে বয়সে বিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল এবং কাফিররা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে নিয়মিত কূৎসা রটনা করলেও আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স নিয়ে কোন কূৎসা রটনা করেনি।) মেয়েদের বিয়ের এবং বিয়ের বয়সের এই দর্শণ সমাজের এবং পরিবারের নিজের অর্থনৈতিক/ডেমগ্রাফিক প্রয়োজনের নিমিত্তে নির্ধারণ হত। আগেই বলেছি বেশিদিন ধরে সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া বলবত রাখার নিমিত্তে প্রাক-আধুনিক সমাজে বাল্যবিবাহ স্বাভাবিক ছিল, এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে। যত বেশি কর্মক্ষম সন্তান কোন পরিবারে, সে পরিবার তত প্রভাবশালী, এই অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রয়োজনের জন্যই বাল্যবিবাহ সে সময়ের সমাজে "অপটিমাল" ছিল।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে, বিশেষ করে পশ্চিমা প্রভাবিত দেশ/সমাজসমূহে বাল্যবিবাহকে খারাপ মনে করা হয় কেন? উপরের আলোচনাতেই এর উত্তর নিহিত আছে। মূলত দু-তিনটা পারস্পরিক সামন্জস্যপূর্ণ কারনে বিংশ শতকের শুরুর দিক থেকে ইউরোপে এবং মধ্য-শতক থেকে সারাবিশ্বেই বাল্যবিবাহকে খারাপ চোখে দেখা হয়। এখানেও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনই শেষ কথা। প্রথম কারন হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নতি। বিংশ শতকের শুরু থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হওয়াতে মানুষের গড় প্রত্যাশিত আয়ু (এভারেজ লাইফ এক্সপেকটান্সি) হুট করে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। শিশুর নানা রকম টীকা আবিষ্কারের ফলেও প্রত্যাশিত আয়ু বেড়ে যায়। এতে করে ব্যাপকভাবে জনসংখ্যার বিস্ফোরন ঘটতে থাকে। আগে যেখানে সমাজের কাছে জনসংখ্যা কম হওয়াটা সমস্যা হিসেবে ধরা দিয়েছিল, এখন জনসংখ্যার আধিক্যই (এবং সে অনুপাতে সম্পদের অপ্রতুলতা) বরং সমস্যা/বোঝা হিসেবে ধরা দিল। তাই সমাজ বেশি সন্তান জন্মদানকে নিরুৎসাহিত করল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের গোড়াপত্তন হওয়া শুরু করলে জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্যের চেয়ে জনসংখ্যার জ্ঞানভিত্তিক কর্মদক্ষতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। তবে ইউরোপে এসবের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে কারনে বাল্যবিবাহ কমে আসল তার কারন হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশাল সংখ্যক কর্মক্ষম পুরুষ জনসংখ্যার হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে মৃত্যু ঘটল। অথচ ইতিমধ্যেই ব্যাপকহারে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে ইউরোপ শিল্পভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হল। এতসব শিল্পকারখানা টিকে থাকার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যথেষ্ট পরিমান কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা ছিল না। ইউরোপ এ কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য একদিকে প্রাক্তন ওপনিবেশ থেকে ইমিগ্রেশান উৎসাহিত করল, অন্যদিক নারীদেরকে অন্তপুর থেকে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের জন্য প্রনোদনা দিল। নারীরা হঠাৎ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেল এবং স্বাভাবিকভাবে বিয়ের মাধ্যমে নিজের অর্থনৈতিক দায় কোন পুরুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার হার অনেক কমে গেল। এ সব কারনে বাল্যবিবাহ ব্যাপকভাবে কমে গেল। এরপরে তো আছে সেকেন্ড ওয়েভ অফ ফেমিনিজম, যা বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে ইউরোপে পশ্চাদপদ হিসেবে গন্য করা শুরু করল। তার মানে একদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি, অন্যদিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজের গোড়াপত্তন এবং সর্বশেষ এবং সবচেেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে কর্মক্ষম পুরুষের ব্যাপক অভাবের কারন মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ হেতু বাল্যবিবাহের প্রয়োজন সমাজের কাছে ফিকে হয়ে আসল।
প্রাক-আধুনিক যুগে বাল্যবিবাহের প্রয়োজন সমাজের ছিল, তাই সমাজের জন্য অপটিমাল ছিল বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করা, আধুনিক সমাজে আর্থ-সামাজিক কারনে বাল্যবিবাহের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই সমাজে বাল্যবিবাহকে এখন খারাপ চোখে দেখা হচ্ছে। বিয়ে এবং বিয়ের বয়সের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝার জন্য আমি দুইটা হাইপথেটিকাল উদাহরন দিয়ে আমার লেখা শেষ করব।
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে, কিন্তু হাইপথেটিকালি ধরেন সেখানে শি্ল্প কারখানা ছিল না যাতে মেয়েরা বাইরে কাজ করতে পারে। সে অবস্থায় সমাজের জন্য অপটিমাল কি হত? সমাজ তখন হয়ত দুটা কাজ করত, একটা হচ্ছে উপার্জনক্ষম পুরুষদেরকে বহুবিবাহের জন্য উৎসাহিত করত, যাতে সারপ্লাস নারীদের থাকাখাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয়। নতুবা পতিতাবৃত্তির প্রতি সামাজিক নেগেটিভ দৃষ্টিভংগী কমে যেত এবং অনেক নারীই পতিতাবৃত্তিতে কর্মরত হত অথবা একই সংগে দুটা ফোর্সই কাজ করত। সামাজিক প্রয়োজনেই তখন বহুবিবাহ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেত।
২. গত অর্ধশতকে বস্তুবাদি সমাজব্যবস্থা এবং ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় শুরু হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণী প্রজাতি ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-য়ের জন্য মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে। হাইপথেটিকালি ধরেন আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পর বিশ্বের বড় অংশই পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে এবং শিল্পায়নের জন্যই যেহেতু গ্লোবাল ওয়ার্মিং হয়েছে তাই তখন মানুষের কাছে শিল্পায়নের আবেদন ফুরাবে, মানুষ আবার প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিব্যবস্থায় ফেরত যাবে। সে সমাজে আবার কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা দিবে, আর্থ-সামাজিক কারনে বাল্যবিবাহের আবেদন তখন বাড়বে এবং তখনকার মানুষ খুবই আশ্চর্য্য হয়ে ভাববে কেন বিংশ শতকে মেয়েরা এত দেরীতে বিয়ে করত। তাদের কাছে সেটা তখন খুবই অনৈতিক এবং পশ্চাদপদ মনে হবে।
এখানে আর্থ-সামাজিক কারনের মাধ্যমে যে বিয়ে এবং বিয়ের বয়সের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেটা মোটাদাগে সত্যি, তবে মানবসমাজ খুবই জটিল এবং আর্থ-সামজিক কারন প্রধান হলেও সময় এবং সমাজের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে অন্যান্য কারনও বিয়ে এবং বিয়ের বয়সের ভ্যারিয়েশানের জন্য দায়ী থাকতে পারে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারন সে ব্যাপারে সন্দেহ নাই।
এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি এখন রবীন্দ্রনাথের ১১ বছরের মেয়েকে বিয়ে করা বা সাড়ে ১০ বছরের দেয়ার উদাহরনে ফিরে যান, এখন কি সেটা খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ আধুনিক শিক্ষিত, ই্উরোপীয় ধ্যান-ধারণার প্রতি পরিচিত এবং অনুরক্ত ছিলেন, এবং এ ঘটনা মাত্র ১০০-১৫০ বছর আগে বাংলার সবচেয়ে আধুনিক পরিবারের ঘটনা। সে আলোকে এখন আপনি এর ১৩০০ বছর আগে আরবের মরুভূমির সমাজব্যবস্থায় রাসুল (সাঃ)-এর আয়েশা (রাঃ)-র সাথে বিয়েকে বিবেচনা করুন, কি খুবই অস্বাভাবিক মনে মনে হচ্ছে? রাসুল (সাঃ)-এর সময়ের সমাজের আরেকটা উদাহরন দিই। সেসময় বাপ এবং ছেলে একইদিনে বিয়ে করা খুবই কমন ছিল। ইন ফ্যাক্ট রাসুল (সাঃ)-র বাবা আব্দুল্লাহ যেদিন বিয়ে করেন, একইদিন একই আসরে রাসুল (সাঃ)-এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবও বিয়ে করেন বলে ঘটনা বর্ণিত আছে এবং আব্দুল মুত্তালিবের বয়স তখন সত্তরের কাছাকাছি ছিল আর তার নব বালিকাবধুর বয়স আব্দুলার নব বালিকাবধুর বয়সের সমান বা কম ছিল। সে সমাজে এটা কোন অস্বাভাবিক ছিল না।
বিয়ে নিয়ে আরো একটা চমকপ্রদ উদাহরন দিয়েই শেষ করছি। ভারতের কর্ণাটক এবং তার পাশের অনেক রাজ্যে হাজার বছর ধরে হিন্দুদের মাঝে মামা তার আপন ভাগ্নিকে (আপন মায়ের পেটের বড় বোনের মেয়েকে) বিয়ে করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল, এখনো সমসয়ে অসময়ে এরকম বিয়ের কথা শুনা যায়। আপনার কাছে এটা ডিসগাস্টিং মনে হচ্ছে না? কিন্তু এ বিয়ের পেছনেও বেশ জোরালো সামাজিক কারন আছে; কারনটা কি বলতে পারবেন?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:৩১