আমাদের কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত উত্তরবঙ্গের এক ভদ্রলোকের সাথে অফিসের সবারই মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। তবে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে আমার সাথে একটু বেশি বলে মনে হয়। কারণ হচ্ছে- তিনি নাকি আমার ভায়রা ভাই। তো কীভাবে?
পাঠক অনেকেই হয়তো জানেন, আমার শশুড়বাড়ী বনলতা সেনের নাটোরে। ঐ ভদ্রলোকের শশুড়বাড়ীও নাটোরে! সুতরাং তিনি আমার ভায়রা ভাই!!
সে যাই হোক, ভদ্রলোকের বাড়ি বগুড়ায় হওয়ায় একবার তিনি আমাদের বিখ্যাত বগুড়ার দই খাইয়েছেন। তা যাক সে প্রসঙ্গ।
এখন যে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে কী-বোর্ড চালাচ্ছি তা হলো- তিনি আজকে আমার জন্য একজোড়া খড়ম পাঠিয়েছে। খড়ম জোড়া পায়ে দিয়ে দাদার স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠছে বার বার। দাদা ভাইকেই আমি প্রথম খড়ম পায়ে হাটতে দেখি। সেটা অবশ্য শেষ বারও মনে হয়। সময়টা ছিল ৮০’র দশক। এর পরে আর সেভাবে খড়ম পায়ে কাউকে হাটতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
খড়ম কী?
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা মতে, খড়ম একপ্রকার কাঠের পাদুকা। হিন্দি "খড়ৌঙ" শব্দটি থেকে বাংলায় "খড়ম" শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃতে খড়ম "পাদুকা" নামে পরিচিত।
একখণ্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে খড়ম তৈরি করা হয়। সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেয়া হয় যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলটি দিয়ে আঁকড়ে ধরা হয়। বর্তমানে পা আটকে রাখার জন্য কাঠের গুটির পরিবর্তে রাবার খণ্ড ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন কালে খড়মের উদ্ভব। খড়ম পায়ে হাঁটা সহজ নয়। এছাড়াও খড়ম পায়ে হাঁটার সময় চটাশ্ চটশ্ বেশ শব্দ হয়। বাংলাদেশের নিম্নোদ্ধৃত লোকজ ছড়াটিতে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে :
হরম বিবি খড়ম পায়
খটটাইয়া হাঁইটা যায়
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিরা ফিরা পিছন চায় ....
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল (রহ ১৪শ শতকে বাংলাদেশের সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত খড়ম এখনো তাঁর সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় রক্ষিত আছে।
‘খড়ম’ এখন শুধুই স্মৃতি
বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠ নির্মিত পাদুকা খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি। এককালে সমগ্র দেশের মানুষই ছিলো খড়ম নির্ভর। কিন্তু বর্তমানে এ শিল্পটি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
বর্তমানে চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জুতা (পাদুকা) মানুষের পায়ে শোভা বর্ধন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে বার্মিস জুতায় ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের নগর মহানগর শহর এমনকি গ্রাম বাংলার মানুষের পায়ে পায়ে। বলতে গেলে এখন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বার্মিস জুতা ব্যবহার করেন। অথচ ৭০’র দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলায় অনেক জনপ্রিয় ছিল এই খড়ম পাদুকা। জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব। তারপরও মানুষ এটিকে পরিহার করেছে। অপরদিকে বার্মিস জুতা মানুষের মাথা গরম করা, পায়ের নিচের স্তর চামড়া মোটা করে বয়রা নামক রোগের সৃষ্টি করে।