রাত ২টা। বাবার সাথে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় কেউ নেই, দূরে কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো, বসন্তের মৃদু বাতাসে আমার চুল উড়ছে। আমি হেঁটে চলেছি, গন্তব্য ঠিকানা বিহীন।
পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলে যাওয়া একটি বাসের ধুলো এসে পড়লো গায়ে, হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে আসছি জানিনা, সামনে থেকে আসা ট্রাকের শব্দে ধ্যান ভাঙলো, রাস্তার মাঝখানে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ট্রাকের আলোয় কিছু দেখতে পাচ্ছিনা, হর্ণের সাথে পাল্লা দিয়ে আলোর তীব্রতা বাড়তে লাগলো। আমি দুই হাত দিয়ে আলো ঠেকাতে বৃথা চেস্টা করলাম, তারপর কিভাবে যেন সেফ সাইডে চলে গেলাম বলতে পারবোনা। আমি বাস্তব জগতে ফিরে এলাম, ট্রাকের ড্রাইভার কি যেন বলল, শুনতে পাইনি।
এই মুহূর্তে আসেপাশে কেউ নেই। দূরে কয়েকটা মানুষ দেখা যাচ্ছে, পাশের যাত্রি বিশ্রাম এর বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর...
.
“মন খারাফ? চলেন মন ভালা কইরা দিমু”
আমি উদাস চোখে তাকালাম, একটি রাতপরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার ঠোঁটের কড়া লিপস্টিক ল্যাম্প পোস্টের আলোয় চিকচিক করে করছে, চোখে ঘন কাজল, সেই চোখে কোন লজ্জা নেই, কোন ভয় নেই, অজানা এক কামনার আকর্ষণ।
.
-এমনেচাইয়া কি দেখেন? যাবেন কিনা কন, আমার কিন্তুক অনেক ডিমান্ড।
-কিরে বুবলি কার লগে এত কথা কস? (আরেকজন এগিয়ে আসে)
-দেহস না ফুলঝুরি, এত সুইট কইরা কইতাছি, এই ছেলে কিছুই কয়না।
-কি কস, তোরে দেইখা রাজি হইবো না? এই আফনে পুরুষ তো?
.
একসাথে দুজন হেসে উঠলো, আমি পকেটে থেকে টাকা বের করে দিলাম।
- ৫০ ট্যাকা!! এই বুবলির দাম ৫০০ টাকা, তবে তোমারে আমার পছন্দ হইছে তুমি কিছু কম দিও....চলো।
(মেয়েটি আমার হাত ধরে টান দেয়)
.
-আমি যাবোনা, টাকাটা আপনি রেখে দিন।
-যাইবানা তো ট্যাকা দিছো কেন? ও বুঝছি ভিক্ষা, এই বুবলি ভিক্ষা নেয়না। নেন আপ নের ট্যাকা।
- আমার কাছে এর চেয়ে বেশী টাকা নেই। তাছাড়া এই টাকা আমার কাছে এখন মূল্যহীন, আপনার কাজে লাগতে পারে রেখে দিন।
-লইয়া ফেল, ট্যাকা হইলো আমাগো ভগবান।
.
বুবলি নামের মেয়েটি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তুমি কি কানতে ছিলা? (কন্ঠে মায়া)
-এগুলা জাইন্না আমাগো কি কাম, চল কাস্টমার খুঁজি।
.
ফুলঝুরি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বুবলি তাকিয়ে আছে আমার দিকে, সে চোখে অন্যরকম মায়া, আমি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম। চারপাশের বাতাসটা কমে গেছে, ভেতর থেকে আবার কান্না চেপে আসলো আমার।
.
“ঐ যা আছে বের কর” ছুড়ি হাতে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আমি তাকিয়ে আছি লোক টার চোখের দিকে, সে চোখ টক টকে লাল। লোকটি এবার আগের চেয়ে জোর গলায় বলল।
.
- ওস্তাদ আমার মনে হয় কানে শুনেনা।
-তুই দেখ কি আছে।
-ওস্তাদ কিছুই তো নাই।
-ভালো কইরা দেখ।
-নাই ওস্তাদ।
-“ঐ......বের কর কি আছে” ওস্তাদের চোখ থেকে মনে হল আগুন বেরুচ্ছে ভয়ে আমি কেঁপে উঠলাম।
.
-ওস্তাদ আমার মনে হয় বোবা।
-“বোবা কিনা এখুনি প্রমাণ হইবো” ওস্তাদ ছুড়ি উপরে তুললো, চোখের পলকে ছুঁড়িটা নিচে নেমে এলো, আমি সরে গেলাম।
.
-“হিরু শক্ত কইরা ধর...” হিরু নামের ছেলেটি এগিয়ে আসছে, আমি ফাঁক বুঝে দিলাম দৌড়। পিছনে ওরা তাড়া করছে। কিছুক্ষণ পর, হাইওয়ে পুলিশের দেখা পেয়ে গেলাম। ঘটনা বুঝে পুলিশ এগিয়ে এলো, ততক্ষণে দুজন আড়ালে। পুলিশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করলো, তারপর উপদেশ দিলো, আর চলে যেতে বলল। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়তেই ভিতর থেকে ডুকরে কান্না বের হয়ে আসলো, বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।
.
মা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে আছে, আমার ভিতরে ঢোকার শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালেন, তাঁর চোখ ছিল কান্নায় ভেজা আর মমতায় ভরা।
.
মাঃ অনেক বড় হয়ে গেছিস তাইনা? কত বড় সাহস তোর বাসা থেকে বের হয়ে গেলি? (মা কান্না করে দিলেন)
নিজের ভুল আর বোকামি বুঝতে পেরে আমি অনুতপ্ত। মায়ের সাথে আমিও কান্না করে দিলাম।
.
-দেখ তুই আবিদকেও কাঁদিয়েছিস, সেই কখন থেকে বলছে, “আম্মা আম্মা, আল্লাহ্কে বলেন যেন ঝড়-বৃষ্টি না দেয়, তাহলে ভাইয়া কি করে আসবে?”
আমার পরিবারের এত ভালবাসা দেখে আমি নিজের ছেলেমানুষিকে উপলব্ধি করতে পারলাম, ছোট ভাইটাকে সরি বলে গালে চুমু দিয়ে দিলাম।
.
আমার মত কেউ এমনটি করবেন না, এই পৃথিবীতে পিতা-মাতাই একমাত্র আপনজন। তারা শাসন করেন আমাদের ভালোর জন্য, তাদের কথা মাঝে মাঝে কটু মনে হতে পারে, শুনে বিরক্ত লাগতে পারে। এই বয়সটাই অদ্ভুত কোন উপদেশ আর বাঁধা মানতে চায়না, নিজের খেয়াল-খুশী মত চলতে চায়, আর কথায় কথায় রাগ উঠে আর মাথা গরম হয়ে যায়। কিন্তু, তখন মাথা-গরম না করে ধৈর্য ধরা উচিত। ধৈর্য ধরা হল মহৎ কাজ।
সেদিনের ঘটনায় অনেকগুলো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সেদিন হয়তো আমার সাথে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো, হয়তো মারাও যেতে পারতাম।
.
আমাদের সবারএকটা কথা মনে রাখতে হবে মা-বাবা যা বলেন আমাদের ভালোর জন্য বলেন। তাদের কথা মেনেই জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
লিখা: নাহিদ হোসাইন