১ম পর্ব: ব্রাউসার যুদ্ধ
২য় পর্ব: সার্চ ইন্ঞ্জিন
৪র্থ পর্ব: ওয়েব বিপ্লব
ইন্টারনেট ব্যবসা - ডট কম বাবল
যদি আপনাকে খুঁজতে বলা হয় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে যুগান্তকারী কোন আবিষ্কার যার এখনো উন্মোচন হয়নি, আপনি প্রথমেই কোথায় খোঁজ করবেন? আপনি কোথায় খুঁজবেন তা আমি জানি না, তবে আমার পরামর্শ থাকবে সবার আগে কোন গ্যারেজে খুঁজুন! শুনতে একটু কেমন কেমন লাগছে? তাহলে বলে রাখি, তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে অসংখ্য বৈপ্লবিক আবিষ্কারের আঁতুরঘর ছিলো গ্যারেজ - এমনকি HP আর Apple এর মতো প্রতিষ্ঠানেরও, এ তালিকা শেষ হবার নয়। আজ আলোচনার শুরুটা যে প্রতিষ্ঠনটিকে দিয়ে তার জন্মস্থানও কিন্তু এই গ্যারেজ - Amazon.com। এই গ্যারেজটির অবস্থান ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে আর এর মালিক ছিলেন জেফ বেজাস (Jeffrey Bezos)।
জেফ বেজাস
বেজাসের কর্মজীবনের জীবনের শুরুটা ওয়াল স্ট্রিটে (Wall Street)। উনি ছিলেন যাকে এক কথায় বলা যেতে পারে সারাদিন হিসেবের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ। যখন ইন্টারনেটের আগমণ ঘটলো তখন থেকেই তিনি চিন্তা করতে থাকলেন কি ধরনের পণ্য ইন্টারনেটে বিক্রি করা যেতে পারে। এ জন্য তিনি তালিকার পর তালিকা বানিয়েছিলেন, আর সবসময়ই সেসব তালিকায় সবার ওপরে স্থান পেতো "বই"। এর প্রধান কারন হলো একটা জেফ সেই সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবীতে কোটি কোটি বই আছে আর এই সব বইকে বা তার কোন ক্ষুদ্র অংশকেও একত্রিত করা পৃথিবীর কোন লাইব্রেরীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই সম্ভব ছিলো ইন্টারনেটে। জেফ বেজাস ১৯৯৫ সালে Amazon.com নামক সাইট উন্মুক্ত করেন। স্বভাবতই প্রথম থেকেই Amazon.com এ প্রাধান্য পেতো বই।
পিয়েরে অমিডিয়ার
ঠিক সেই সময়কারই কথা - যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে পিয়েরে অমিডিয়ার (Pierre Omidyar) নামে একজন তরুণ সফটওয়্যার প্রোগ্রামারও ইন্টারনেটে ব্যবসার কথা চিন্তা করেছিলেন। আজ পিয়েরে অমিডিয়ার একজন সফল ও অত্যন্ত ধনী একজন মানুষ। কিন্তু সেই ৯০' এর দশকে অমিডিয়ার ছিলেন Apple Computer এ কর্মরত একজন নগন্য সফটওয়্যার প্রোগ্রামার মাত্র। কিন্তু অমিডিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর তার সেই স্বপ্নই রূপ লাভ করেছে আজকের eBay.com তে। শুরুতে পিয়েরে অমিডিয়ার আর জেফ বেজাসের চিন্তাধারায় একটা মিল ছিলো - দু'জনেই ওয়েবকে কল্পনা করেছিলেন ব্যবসা করার স্থান হিসেবে। কিন্তু এই একটি বিষয় বাদে আর কোন মিল তাদের মধ্যে ছিলোনা। বেজাস যেখানে যুক্তির্নিভর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বলে Amazon.com কে গড়ে তুলতে চাইছিলেন, সেখানে পিয়েরে অমিডিয়ার এর কোন নির্দিষ্ট ব্যবসা নীতি বা পরিকল্পনা ছিলো না। অমিডিয়ারের কাছে অনলাইন নিলাম সাইটের আইডিয়াটা বেশ ভালো বলে মনে হয়েছিলো আর এই ভালো লাগাটাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। এই আইডিয়া বাস্তবায়নে অমিডিয়ারের খুব একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রয়োজন পড়েনি। শুধুমাত্র নিজের বাসার কম্পিউটারে বসে, কোডিং আর প্রোগামিংয়ের বলেই তার পক্ষে সবকিছু সামলানো সম্ভব ছিলো।
অমিডিয়ার ভেবেছিলেন ইন্টারনেটে EBay এর মতো অনলাইন নিলাম সাইট হবে ছোট, বড় সকল ভোক্তা আর ক্রেতার জন্য একটি "লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (Level Playing Field)। এর মাধ্যমে ছোট ক্রেতারাও সুযোগ পাবে রাঘব বোয়ালদের সাথে প্রতিযোগিতা করার। আর তাই অমিডিয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন EBayকে ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করবার। ১৯৯৫ সালের এক ছুটির সপ্তাহে অমিডিয়ার EBayকে জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করেন। একজন-দু'জন করে ব্যবহারকারী সাইটে আসতে শুরু করলো। কিন্তু এসে তারা সাইটে বিক্রির তালিকায় যেসব জিনিস দেখতে পেলো শুনলে আপনার হাসি পাবে। কয়েকটা নমুনা দিচ্ছি:
* পুরনো কি-বোর্ড আর মাউস
* অটোগ্রাফ সম্বলিত সেলেব্রিটি আন্ডারওয়্যার
* বাচ্চাদের খেলনা দমকলের গাড়ি
* সুপারহিরো লাঞ্চবক্স
উপরের তালিকাটি দেখে কি মনে হচ্ছে? কোন যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক ব্যাবসায়িক উদ্দ্যোগের শুরু নাকি কিছু সেকেন্ডহ্যান্ড আবর্জনার স্তুপ? যদি আপনি পরেরটা বলেন তবে আমি বলবো, হয়তো এ কারনেই আপনি কোন কোটিপতি নন, যেমনটা হচ্ছেন পিয়েরে অমিডিয়ার।
শুরুটা নড়বড়ে হলেও Amazon আর EBay এর সাফল্যের মুখ দেখতে খুব বেশি সময় লাগেনি। EBay খোলার কয়েক মাসের মধ্যেই পিয়েরে অমিডিয়ার হাজার হাজার ডলার আয় করতে শুরু করেন। আর খোলার ৩০ দিনের মধ্যেই Amazon তাদের সেবা সম্প্রসারন করে বিশ্বের ৪৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে বই সরবরাহ করা শুরু করে। কিন্তু Amazon আর EBay এর এই তাৎক্ষণিক সাফল্য ওয়াল স্ট্রিটের নজর এড়ায়নি। ওয়াল স্ট্রিটের বিশেষজ্ঞ আর পরিসংখ্যানবিদরা ভেবে কূল করতে পারছিলেন না ওয়েব কত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো ওয়েবের এই দ্রুত সম্প্রসারনের রহস্যটা কি? এটা বুঝতে হলে আমাদেরকে সামান্য টেকনোলজিক্যাল জ্ঞান আহরণ করতে হবে, জানতে হবে দু'টি সূত্র সম্পর্কে আর সেই সূত্রদ্বয়র মিলিত প্রভাব সম্পর্কে।
১ম সূত্রটি হচ্ছে বিখ্যাত সিলিকন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের (Gordon E. Moore) যা মুরের সূত্র (Moore's law) নামেও পরিচিত। সূত্রটা হলো অনেকটা এমন - "ইন্ট্রিগ্রেটেড সার্কিটের (তা মাইক্রোপ্রসেসরই হোক আর মেমোরি চিপ) গতি ও ক্ষমতা প্রতি ১৮ মাসে দ্বিগুণ হয়।" সূত্রটা শুনে আপনার মনে হতে পারে - "তো কি হয়েছে?" দ্বিগুণ হবার মাহত্মটা হলো খুব ছোট কোন মান থেকে বড় কোন মানে পৌঁছাতে যদি এই দ্বিগুণ নীতি অবলম্বন করা হয়, তাহলে অবাক হয়ে দেখবেন যে খুব বেশি ধাপের প্রয়োজন পড়ছে না। যেমন: ২ --> ৪ এ যেতে ১টি ধাপ লাগছে। ২ থেকে ৮ এ যেতে (২ --> ৪ --> ৮) ২টি ধাপের প্রয়োজন পড়ছে। এভাবে মাত্র ২০ তম ধাপে আপনি ২০ লাখে পৌঁছে যাবেন। এই সূত্রের ফলাফল? ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ট্রানজিস্টরের আবির্ভাব আর পূর্বে রুম জুড়ে অবস্থান করা কম্পিউটারকে কোলের ওপর বসানোর মতো অভিজ্ঞতা।
২য় সূত্রটি হচ্ছে ইথারনেটের জনক রবার্ট মেটক্ল্যাফের সূত্র যা মেটক্ল্যাফের সূত্র নামে পরিচিত। এই সূত্রকে সরল করে বলা যেতে পারে - "যখন কোন নেটওয়ার্কে একজন নতুন ইউসার যোগ দেন, তিনি শুধু ঐ নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা একজন বাড়িয়েই (+১) দেন না, বরং ঐ নেটওয়ার্কের কার্যকারিতাও বাড়িয়ে দেন।" সেটা কিভাবে? মনে করি কোন নেটওয়ার্কে ২ জন ব্যবহারকারী আছেন। তাহলে উক্ত নেটওয়ার্কে সম্ভাব্য সংযোগের সংখ্যা মাত্র ১টি।
যখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ জন, তখন সম্ভাব্য সংযোগের সংখ্যা ৩টি।
যখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ জন, তখন সম্ভাব্য সংযোগের সংখ্যা ৬টি।
এবারে সংখ্যাটা একটু বাড়াই। যখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ জন তখন সম্ভাব্য সংযোগের সংখ্যা ৪৫টি।
এবং যখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০, তখন সম্ভাব্য সংযোগের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো। আর তাই এই সূত্র ধরে ইন্টারনেটের ব্যাপারে বলা যায় যে যতো সময় যাচ্ছে ইন্টারনেট আরো কার্যকারী হয়ে উঠছে। কেননা সময়ের সাথে সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে যোগাযোগ আর পক্ষান্তরে বাড়ছে ইন্টারনেটের কার্যকারিতা এবং যারা এখনো ইন্টারনেটে যোগ দেননি তাদের কাছে একে আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে।
৯০' এর দশকের মাঝামাঝি এসে মুর আর মেটক্ল্যাফের সূত্র বলতে গেলে হাতে হাত রেখে কাজ করে যাচ্ছিলো। আধুনিক আর শক্তিশালী পিসির উদ্ভব ঘটছিলো, বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক কেবল সংযোগ টানা হয়, বাড়ছিলো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, ইন্টারনেট এসে পড়ছিলো মানুষের হাতের মুঠোয়। ওয়াল স্ট্রিট ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো ইন্টারনেটের এই জনপ্রিয়তা আর কার্যকারিতার কথা। আর এর অর্থ ছিলো একটাই। শীঘ্রই ইন্টারনেট পরিণত হয় নতুন একটি ব্যবসাক্ষেত্রে।
ইতিহাস আমাদেরকে বলে, যখনই পৃথিবীর কোথাও কোন নতুন কোন ব্যবসা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তখনই হিরিক পড়ে গিয়েছে কোম্পানীর পর কোম্পানী খোলার, আর ব্যবসাকে নিজের আয়ত্বে আনার প্রচেষ্টার। এর ভালো উদাহরণ হতে পারে মধ্য ১৮শ শতাব্দীর যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যে রেলওয়ে ব্যবসার সূচনা বা ঐ একই সময়েরই আরেকটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি টেলিগ্রাফের আবিষ্কার অথবা তারও ৫০ বছর পরের মোটোরগাড়ির আবিষ্কার। প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই গল্পটা প্রায় এক। শুরুটা কোন যুগান্তকারী আবিষ্কার দিয়ে, তারপর কিছু উদ্যোগী মানুষের সাহসী সূচনা আর অতঃপর বিনিয়োগকারীদের মেলা জমে যাওয়া আর কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালা। কিন্তু পরিণতি প্রকি ক্ষেত্রে একটাই - কর্মী ছাঁটাই, অসংখ্য কোম্পানীর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া আর কোটি কোটি টাকার লোকসান।
ইন্টারনেটে ইতিহাসটাও অনেকটা এমনই। শুরুটা নেটস্কেপের যুগান্তকারী আবিষ্কার নেটস্কেপ ন্যাভিগেটরের ব্রাউসারের শেয়ার মার্কেটে উন্মুক্তকরণ, তারপরে শেয়ার ছাড়ে ইয়াহু! আর এক্সাইটের মতো সার্চ কোম্পানীরা। আর তারও প্রায় এক বছর পরে ১৯৯৭ সালের মে মাসে শেয়ার ছাড়ে Amazon। Amazon এর বয়স তখন মাত্র ২ বছর, ছিলো কিছু বিশ্বস্ত বিনিয়োগকারী, কিন্তু ছিলো না কোন লাভ। কিন্তু জেফ বেজাস Amazonকে সবার কাছে পৃথিবীর বৃহত্তম বইয়ের দোকান বলে বেড়াচ্ছিলেন আর তাই বিনিয়োগকারীর অভাব হচ্ছিলো না। যদিও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছিলো, বাড়ছিলো বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ, কিন্তু ব্যবসায় লাভ করা বলতে যা বোঝায় তা Amazon মোটেও করছিলো না। বরং বিপুল লোকসান দিয়ে কোম্পানী চলছিলো। এমনকি বেজাস যখনই সুযোগ পাচ্ছিলেন তিনি দাম আরো কমাচ্ছিলেন।
এখন আপনার কাছে মনে হতে পারে - জেফ বেজাস কি তবে পাগল ছিলেন? তবে কি বেজাস লাভের কথা ভাবছিলেন না? এভাবে লোকসান দিয়ে দিয়ে কোম্পানী চালু রাখার কি মানে? বিনিয়োগকারীরাই বা কি বুঝে Amazon এর পিছনে অর্থ ব্যয় করছিলেন। আসলে বেজাস একটি সুনির্দিষ্ট নীতির বলে Amazonকে পরিচালনা করছিলেন, আর তা হলো - "Get big fast (দ্রুত সম্প্রসারন)"। এই নীতিকে কল্পনা করো যেতে পারে আমাদের দেশে কতিপয় সংবাদপত্রের ব্যবসার শুরুটার সাথে। এরা প্রথমে সংবাদপত্র ছাপিয়ে খুব অল্প মূল্যে ও লোকসান দিয়ে বিক্রি করে। মূল্য কম হওয়ায় ক্রমেই এসব পত্রিকার জনপ্রিয়তা বাড়ে। একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা ঠিকই সংবাদপত্রের দাম বাড়ায়। কিন্তু প্রাথমিক ঐ জনপ্রিয়তার দরুন মানুষ বেশি মূল্য দিয়ে হলেও উক্ত পত্রিকা কেনে ও পড়ে।
১৯৯৮ সাগাদ EBay বুঝতে পারে যে যদি ওয়াল স্ট্রিট এখনো তাদের কোন ভবিষ্যত দেখছে না এবং কারা প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে কিভাবে EBayকে আরো লাভজনক করে তোলা যায়, কিভাবে EBay থেকে বিপুল লাভ করা সম্ভব সে ব্যাপারে ওয়াল স্ট্রিটকে আশ্বস্ত করা যায়। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে EBay তাদের শেয়ার উন্মুক্ত করে দেয় ঠিক এমন একটা সময়ে যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলছিলো। আর তাই একটা আশঙ্কা সবার মনে কাজ করছিলো। EBay কি লাভের মুখ দেখবে? কিন্তু সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে EBay প্রচুর লাভজনক সাব্যস্ত হয় ঐ কয়েক মাসের ভেতরই মেয়ার মূল্য প্রায় ৪ গুণ হয়ে যায়। ওদিকে ওয়াল স্ট্রিট Amazon এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল তেখতে পাচ্ছিলো। ১৯৯৮ এর শেষের দিকে ওয়াল স্ট্রিট ঘোষণা করে যে প্রচুর লোকসান সত্ত্বেও, আগামী ১ বছরের মধ্যেই Amazon এর শেয়ার মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এবং মজার ব্যাপার হলো Amazon এর শেয়ার মূল্য দ্বিগুণ হলোও, কিন্তু ১ বছরে নয়, বরং সাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই।
এই ঘটনাগুলো দারুনভাবে প্রভাবিত করলো মার্কিন শেয়ার বাজার আর জনগণকে। প্রায় কোন সংক্রামক রোগের মতো শুরু হয়ে গেলো শেয়ার কেনার প্রতিযোগিতা। মানুষ যে কোম্পানীর নামের শেষেই .com (.ডট কম) কথাটা খুঁজে পাচ্ছিলো তার শেয়ার কিনছিলো। এমনকি মানুষ দোকানে, রেস্টুরেন্টে, বাড়িতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা টিভিতে ফিনান্সিয়্যাল নিউজ চ্যানেল দেখতো, যাচাই করতো তাদের কেনা শেয়ারের মূল্য বেড়েছে নাকি কমেছে। অদ্ভূত সে নেশা। অনেকে সকালে শেয়ার কিনে বিকেলেই বিক্রি করে দিতো এমন ঘটনাও দেখা গিয়েছে। আর বিনিয়োগকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো, যেকোন ইন্টারনেট ভিত্তিক কোম্পানী দেখলেই তারা কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার জন্য হামলে পড়ছিলো। আর এই সময়টাকেই ইন্টারনেটের ইতিহাসে অভিহিত করা হয়ে থাকে "ডট কম বাবল (dot com bubble)" হিসেবে। মানুষ এই সময়ে দিবাস্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন দেখেছে লাখ লাখ ডলারের মালিক হবার। টাকা যেন আকাশে উড়ছিলো, শুধু হাত বাড়িয়ে ধরার অপেক্ষা।
১৯১২ সালের ১৪ই এপ্রিল টাইটানিক আটলান্টিক সাগরের অতলে নিমজ্জিত হয়। তার ঠিক ৮৮ বছর পরে আরেক ১৪ই এপ্রিলে ইন্টারনেট বাণিজ্যের অনেকটা তেমনই পরিণতি ঘটে। এই দিনটি ওয়াল স্ট্রিটে সবসময় পরিচিত হয়ে থাকবে "ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday)" হিসেবে। এইদিন NASDAQ ৩৫৫ পয়েন্ট হ্রাস পায় ও শেয়ারমূল্য প্রায় ২৫% কমে যায়। এই ধস ছিলো মার্কিন স্টক মার্কেটের ইতিহাসে বৃহত্তম ধস। ব্ল্যাক ফ্রাইডের ঐ সপ্তাহে শুধু ছোট কোম্পানীগুলোই নয়, বিপদে পড়ে যায় Amazon, EBay এর মতো বড় কোম্পানীগুলোও। Amazon তো প্রায় দেউলিয়াই হয়ে গিয়েছিলো। ২০০১ সালে Amazon তার ১৩০০ কর্মীকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়। বিশাল লোকসানের মুখোমুখি হন শেয়ার মালিকরা। ক্ষোভের সুর ওঠে তাদের মাঝে। আর সব ক্ষোভ গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছিলো বিনিয়োগকারী আর ওয়াল স্ট্রিটের ওপর।
কিন্তু ডট কম বাবলের এই সময়কালে অসংখ্য ভবিষ্যৎহীন, গন্তব্যহীন ও অর্থহীন ওয়েব প্রজেক্টের পেছনে অনেক অনেক অর্থ ঢেলেছেন বিনিয়োগকারীরা, গড়ে তুলেছেন তাসের ঘরের মতো সব প্রতিষ্ঠান। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিনিয়োগকারীরা কি তবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন? ওয়াল স্ট্রিটেরই বা কি হয়েছিলো? তারা কি বুঝতে পারেনি যে হাওয়ার ওপর গড়ে তোলা এসব কোম্পানীর কোন ভবিষ্যত নেই? তারপরও কেনা তারা মানুষকে মিছে আশা দেখিয়েছিলো। বিনিয়োগকারীরা কিন্তু ঠিকই জানতেন এসব কোম্পানীর অধিকাংশেরই কোন ভবিষ্যত নেই। কিন্তু তারা এও জানতেন যে এসব কোম্পানীর কিছু কিছু ঠিকই টিকে থাকবে, এমনকি ভবিষ্যতে রাজত্ব করবে। আর এই সুযোগটাই তারা নিয়েছিলেন।
তবে পৃথিবীর আর সব খারাপের মতোই এরও কিছু ভালো দিক ছিলো। ডট কম বাবলের হিরিকের কারনে এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে ঘিরে ফেলা গিয়েছে ধরিত্রীকে। কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তি হয়েছে সহজলভ্য, এসেছে হাতের নাগালে। যা হতে হয়তো ১৫ বছর লাগতো, তা ঘটেছে মাত্র ৫ বছরের ক্ষুদ্র সময়কালে।
* ডিসকভারি চ্যানেলে প্রচারিত Download - The True History of Internet অনুষ্ঠান অবলম্বনে রচিত।
কৃতজ্ঞতা:
এই পোস্টের কিছু ছবি ও সকল বহির্গামী লিংক উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত
অন্যান্য পর্বসমূহ:
১ম পর্ব: ব্রাউসার যুদ্ধ
২য় পর্ব: সার্চ ইন্ঞ্জিন
৪র্থ পর্ব: ওয়েব বিপ্লব