দৃশ্যপট ১:
কয়েক মাস আগের কথা। আমার এক কাজিনের সাথে বছর খানেক পরে দেখা। ঢাকার একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস সেভেনে পড়ে ও। এবার এইটে উঠবে। ঘরের মধ্যেই ক্রিকেট খেলছিলাম। তো অবাক হয়ে দেখলাম আমার ঐ কাজিন বাংলাং গুণতে পারে না। আমি যদি তাকে 49 এর বাংলা কি হবে জিজ্ঞেস করি সে অনেক ভেবেও ঊনপঞ্চাশ বলতে পারে না। আরো ভয়াবহ অবস্থা বাংলা থেকে ইংরেজী করতে দিলে। সে আমাকে জানালো শুধু সেই নয়, তার ক্লাসের আরো অনেকেরই এমন অবস্থা। আমি ঘটনা দেখে না পারছিলাম হাসতে না পারছিলাম কাঁদতে। তবে মুচকি মুচকি হেসেছিলাম। সালাম, রফিক, বরকতের জীবনদান তুচ্ছ মনে হতে লাগলো.......
দৃশ্যপট ২:
আমার এক বন্ধু, সে এই ব্লগেও লিখে সে। তার সাথে সেদিন দেখা। কথায় কথায় মজার এক ঘটনা সে শোনালো আমায়। তার সাথে নাকি এক মেয়ের সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে। কথা বার্তা বলে ভালোই খাতির হয়েছে। তো আমার ঐ ফ্রেন্ড ঐ মেয়েকে ফেইসবুকে এ্যাড করতে চায়। কিন্তু মেয়েতো প্রায় আঁতকে ইঠে। বলে - "না, তোমাকে আমি ফেইসবুকে এ্যাড করতে পারবো না।" স্বভাবতই আমার বন্ধু কারন জানতে চায়। সে বলে - "আমার ফেইসবুকের সব ফ্রেন্ড ইংলিশ মিডিয়ামের। তোমাকে এ্যাড করলে ওদের কাছে আমার প্রেস্টিজ থাকবে না। আমাকে ওরা ক্ষ্যাত ভাববে।" আমার ফ্রেন্ড আমাকে হেসে হেসে এই ঘটনা বলছিলো। আমি কিন্তু হাসতে পারিনি, চোখ-মুখ কুঁচকে এই কাহিনী হজমের চেষ্টা করছিলাম।
দৃশ্যপট ৩:
এও আমার এক বন্ধু। মাসখানেক আগে ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে সে। ইদানিংকালে ওর মধ্যে মজার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমার সাথে কথা বলছে ঠিকমতোই, কিন্তু যখনি ওর মোবাইলে কোন কল আসছে ওর কথা বলার ভঙ্গি পুরোদস্তুর পাল্টে যাচ্ছে। কথা বাংলায়ই বলছে কিন্তু তাকে বাংলা বলে ঠাওড়ায় কার বাপের সাধ্য। ইংরেজী "R" আর বাংলা "র" দুটোরই উচ্চারন শোনাচ্ছি বাংলা "ড়" এর মতো। আর অবাঞ্ছিতভাবে প্রায় প্রতি ১৫টা বাংলা শব্দের সাথে একটি করে ইংরেজী শব্দ জুড়ে দিচ্ছে। অবাঞ্ছিত বলছি কারন - ভাবপ্রকাশের স্বার্থে বাংলা বাক্যের মধ্যে ইংরেজী শব্দ আনা যেতেই পারে, আমিও নিজেও তা করি। আমি বলছি না যে মোবাইলকে "মুঠোফোন বলাহোক বা অক্সিজেনকে "অম্লজান"। কিন্তু যেখানে একদমই প্রয়োজন নেই কোন ইংরেজী শব্দের সেখানেও ঠেলেঠুলে একটা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেন এ কোন নতুন ভাষারীতি। বোঝা গেল আমার এই বন্ধুটি এখনো এই আজব ভাষাটি পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি, আর তাই ঠেলেঠুলে ঢোকানো ইংরেজী শব্দগুলোর প্রয়োগ প্রায়ই ভুল হচ্ছে। আরো একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ছিলো, পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলা বাক্যগুলোতে ইচ্ছাকৃত ভাবে "করতেসি", যাইতেসি, "খাইতেসি" ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। হাসি পাচ্ছিলো অনেক.......
পরিশেষ:
আমি জানতাম শিক্ষা মানুষকে প্রগতিশীল করে, নৈতিকতাকে উৎকর্ষে পৌঁছাতে সহায়তা করে। তবে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদেরকে একরকম অছুঁত ঘোষণা করে দেয়া - এটা কোন ধরনের প্রগতিশীলতা দয়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।
আমি জানতাম শিক্ষা মানুষকে তার সত্বাকে, তার ঐতিহ্যকে কে চেনায়। তবে বাংলায় গুণতে পারার অক্ষমতা কিভাবে ঐতিহ্য আর স্বত্বা ধারণের নিদর্শন হতে পারে তা আমার জানা নেই।
আমি জানতাম শিক্ষা বিকৃতি বর্জিত, মার্জিতকে কাছে টেনে নেয়। তবে ওভাবে "র" কে "ড়" উচ্চারণ, বাংলা-ইংরেজীর অবাঞ্ছিত জগাখিচুড়ি আর শুদ্ধ-অশুদ্ধ শব্দের মিশ্রনে কথা বলা কোন ধরনের মার্জিত ভাব, তা আমি বলতে পারবো না।
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর কি আসলেই আমার জানা নেই? তা হয়তো নয়। আসলে হয়তো জানতে চাইনা, তাই জানিনা। ব্যাক্তিগতভাবে আমি সব দায় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেবোনা। যদি তাই করা হয় তবে আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, সচেতনতা, মানবিকতা মূল্যহীন হয়ে যাবে, মূল্যহীন হয়ে যাবে দিন-রাত ঐ দেড় কেজি ওজনের যন্ত্রটাকে মাথায় করে বয়ে বেরানো। কেউ কেউ হয়তো এখনো ঐ যন্ত্রটার সদ্ব্যবহার এখনো করেন, না হলে ইংলিশ মিডিয়াম আর প্রাইভেট ভার্সিটির অধিকাংশ ছাত্রেরই হাল এরকম হতো। কিন্তু যদি এখনি কিছু না করা হয়, তবে অধিকাংশেরই এই দশা হতে আর খুব বেশি বাকি নেই। এই পৃথিবীর বুকেই তথাকথিত উন্নত কিছু দেশে এখনো গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে জাতিবাদের মতো জঘন্যতম প্রথা চালু আছে। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রদের প্রতি ইংরেজী মিডিয়ামের ছাত্রদের এই মনোভাবকে আমি তার চাইতে ভালো কোন দৃষ্টিতে দেখি না।