মানবজাতির উদ্ভব হযরত আদম (আঃ) থেকে আর আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি মৃত্তিকা থেকে। তাই একজন আরবের চেয়ে অনাবরের যেমন কোন অগ্রাধিকার নেই, তদ্রূপ কোন অনারবের চেয়ে আরবের। একজন শ্বেতাঙ্গের অগ্রাধিকার নেই যেমন কোন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর। তেমনি কোন কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই শ্বেতাঙ্গের ওপর। হ্যাঁ এ জন্য স্রষ্টার কাছে শ্রেষ্ঠত্ব বা অগ্রাধিকার পাবার একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি এবং সৎকর্ম বা আমলে সালেহ।
এই মূলনীতি আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর তিরোধানের আগে তাঁর জীবনের সর্বশেষ দিক-নির্দেশনা বা বাণী হিসেবে আমাদের জন্য বিবৃত হয়েছিল। মহানবী (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জে প্রদত্ত ভাষণের মধ্যে বেশ কিছু বাণী সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামে জাতিভেদ জাতীয়তাবাদের কোন স্থান নেই। এতদসত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ'র মাঝে এসব মানবিক দুর্বলতা ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এমনকি বর্তমান সময়ে বর্ণ ও জাতি-বৈষম্য এবং ভৌগোলিক কারণে অনেক মুসলিম ব্যাপক পাশবিক নির্যাতনের শিকার। পাকিস্তানী মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, আরবদের মুখে ইহুদী কর্তৃক ফিলিস্তিন ও ইরাক দখলের কথা শোনা গেলেও তারা ভারতীয়দের কাশ্মীর দখলের প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের সমর্থনে তেমন কিছুই বলেছেন না।
আরব বিশ্বের মধ্যেও দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী শ্রমিক এমনকি স্থানীয় বেদুইনদের ওপর বৈষম্য নির্যাতনের অনেক নজীর রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে চীনের উইঘুর মুসলিমরা যে জাতি বিদ্বেষ-বৈষম্য ও নির্যাতনে চরম শিকার হচ্ছে সে ব্যাপারে মুসলিম-মানস সোচ্চার নন। আমার অন্তরাত্মা তখনই তাদের জন্য একটু কেঁপে ও একটু সোচ্চার প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তখন, যখন কোন সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে ঐসব আমাবিকতার কিছু রিপোর্ট আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। ইসলামে জাতি বিদ্বেষ-সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ইসলামী আচার-আচরণ পরিপালন করি। কিন্তু এ ব্যাপারে একটু বিশেষ মনোযোগী হলে সক্রিয়ভাবে এ জন্য আন্দোলনের কথা ভাবি।
আফ্রিকার মুসলিম এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা অথবা কোন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান মুসলমানের ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্টীম রোলার নেমে আসে তখন মুসলিম বিশ্বের কুম্ভকর্ণের ভূমিকা ছাড়া আর কিছু তো দেখা যায় না। চলতি বছর প্রায় ১৭টি আফ্রিকান রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে। এর মধ্যে অধিকাংশ দেশেই যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত-সহিংসা, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি এবং চরম শোষণের শিকার। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হচ্ছে আফ্রিকার সর্ববৃহৎ ধর্ম, যদিও খৃস্টানদের দ্বারাই শাসিত হচ্ছে।
এসব অঞ্চলের অনেক মুসলিম এখনও এ ব্যাপারে সচেতন নয় যে, এসব দেশে মুসলমানরা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং জাতির প্রতি তাদের অঙ্গীকারের ব্যাপারেও তারা উদ্বিগ্ন নয়। এ হচ্ছে আমাদের চিন্তা-গবেষণা কথা-কাজের ভেতরে সংকীর্ণ জাতিভেদ, অসভ্যতা, বর্বরতা অনুপ্রবেশের চরম লজ্জাজনক প্রতিফলন।
আফ্রিকার কোন কোন দেশে যখন মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয় তখন অপরাপর মুসলমানরা নিষিত মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য ন্যূনতম মঙ্গল কামনা দোয়া পর্যন্ত করতেও ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তবে কিছুসংখ্যক দুঃসাহসী মুসলিম বীরের ঐসব নির্যাতিতদের পক্ষে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন এমনকি এ জন্য শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন, আমরা তাদের এই সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি দেয়ার মতো লোকদের নামও জানি না।
অনেক মুসলমানের সাধারণ চেচনিয়া, কাশ্মীর এবং ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ইতিহাস-রাজনীতির সম্পর্কে ধারণা আছে। কেন হচ্ছে এমনটি? কারণ এখানকার মুসলমানদের মধ্যে যথাক্রমে, সাদা-কালো, এশীয় আঞ্চলিকতা এবং আরব জাতীয়তার দ্বনদ্ব বিরাজমান। একই সমস্যা যখন ইরিত্রিয়া, মালি, নাইজার ও সেনেগালের ক্ষেত্রে দেখা দেয় তখন সেটার কিছুটা সমাধান করা সম্ভব হয়। এমনকি সোমালিয়া এবং সুদানে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তাকে রঙ-চড়িয়ে মিডিয়ার কল্যাণে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং আফ্রিকার সমস্যা বলে একে প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়, ২০০৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গীনির মুসলমানদের ওপর কোনাক্রীতে এ ধরনের গণহত্যা এবং ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনা ঘটানো হলো। আমাদের উচিত সেইসব লোমহর্ষক পৈশ্বাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি চেষ্টা করা।
প্রায় ১ কোটি জন অধ্যুষিত ঐ দারিদ্র্যপীড়িত মুসলিম দেশটির ওপর ঔপনিবেশবাদী ও স্বৈরশাসকদের চরম প্রতিমূর্তি দেখা গিয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। দেশটির শতকরা ৮৫ ভাগ লোকই মুসলিম। সেপ্টেম্বর ট্রাজেডির প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দা ক্ষোভে নিনাদিত হয়ে দেশটি।
ঐ নারকীয় দিবসটির স্মরণে ফিলিস্তিনী আকসা ইন্তিফাদার উদ্যোগে ন্যাশনাল ফুটবল স্টেডিয়ামে দেশটির ক্যাপ্টেন মুসা দাদিস কামারার অব্যাহত সামরিক শাসনের প্রতিবাদে লাখো মানুষের এক স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় এক বছর আগে মুসা দাদিস সামরিক শক্তি প্রয়োগে দেশটি ক্ষমতায় আরোহন করেন। স্টেডিয়ামটির ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার।
কিন্তু অনুষ্ঠানের শুরুতেই এর গ্যালারিসহ আশপাশ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে পুরা মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সভা শুরুর পরপরই সরকারি পেটোয়া বাহিনী সাধারণ নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তে রঞ্জিত করে তোলে পুরো সভাস্থল। নিরপেক্ষ তদন্তের লক্ষ্যে মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ পরবর্তী মাসগুলোতে এ ব্যাপারে ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে।
২৮ সেপ্টেম্বরের বিয়োগান্ত ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে এগারটার প্রেসিডেন্ট গার্ড বাহিনীর কয়েক শ' সদস্য, দাঙ্গা পুলিশ, সাদা পোশাকধারী আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ সহস্রাধিক সশস্ত্র সদস্য নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। অনেকেই গুলীবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে স্টেয়িামের সবুজ চত্বর। অনেকে প্রাণভয়ে সীটের নিচে, কেউ বা বাথরুমে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। কেউ কেউ দেয়াল টপকে প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অনেকে গুলীবিদ্ধ হয়ে এখানে ওখানে পড়ে থাকেন মুখ থুবড়ে।
এ ছাড়া ড্রেনে নর্দমায় আশ্রয় নেয়। কেউ আবার দেয়াল বেয়ে নামার সময় গুলী খেয়ে ঝুলে থাকেন। গণহত্যার পর সেখানে ১৫০টি গীনিবাসীর লাশ পড়ে থাকে যত্রতত্র। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ঘটনায় অন্ত ১৪শ' লোক মারাত্মক আহত হন। এরপর লোকজন প্রাণভয়ে যখন দিকাদিক ছুটছিল তখন নরপিশাচরা অবলা নারীদের ওপর পাশবিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময়ে সেন্যরা তাদেরকে বেয়নেট, বন্দুকের বাট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে। যারা প্রাণ দিয়ে বেঁচে গেছেন। তাদের ওপর আরেক দক্ষ বিচারিক নির্যাতন চালানো হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১:৫৬