ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, যে সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি হয়ে আসছে। এমনকি এককালে এর সাথে সংযুক্ত থাকা নোয়াখালীতে মানুষের বসতি স্থাপনের পূর্বেই সন্দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। সন্দ্বীপের লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা এবং বস্ত্র শিল্প পৃথিবী খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন ও সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা ও বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, প্রতি বছর সন্দ্বীপ উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত এবং সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথীবী খ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানী করা হত। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হন এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন। ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। লবণ এবং জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগীজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন।তাছাড়া ভ্রমণ এবং ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসী ও ওলন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন।
সন্দীপ ফেরী ঘাটের একটি অত্যান্ত মনোরম দৃশ্য
১৬১৫ সালে পর্তুগীজদের সাথে আরকানরাজের যুদ্ধে ২০০জন সৈন্য সহ পর্তুগীজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হয় এবং পর্তুগীজরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলে ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখল করে।এরপর সন্দ্বীপে আরকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতাকে অস্বীকার করে একে প্রায় অর্ধ শতাব্দী শাসন করেন করেন দেলোয়ার খাঁ। ১৬৬৬ সালে তার রাজত্বের পতন ঘটে এবং মোঘল সরকারের অধীনে জমিদারদারী প্রথার সূচনা ঘটে যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়। রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে। ১৩৪৫ সালে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ভিনীশ পর্যটক সীজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ননা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ সালের ২৮শে জানুয়ারী মুজফ্ফর আহমেদর সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপ ভ্রমনের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তার মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
ছোট জাহাজ ও স্টিমারই সন্দ্বীপ ও অন্যান অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম।পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সন্দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল ৪০ কিমি ও প্রস্থ ৩-৯ মাইল ৫-১৫কিমি। এই অঞ্চলে মোট আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ৫৬৫৩০ একর এবং অনাবাদী জমি ২২৯১১ একর। মোট বনাঞ্চল ১১২০০ একর।বিভিন্ন বেসরকারি অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বর্তমানে এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় চার লাখ।২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই দ্বীপের জনসংখ্যা ৩৩৪৪২০ জন। পুরুষ ১৬৭১৮০ জন ও মহিলা ১৬৭২৪০ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বঃ কিমি তে ৪৩৯ জন।সন্দ্বীপ পৌরসভার আয়তন প্রায় ৩০.৩ বর্গ কিঃ মিঃ। জনসংখ্যা প্রায় ৪২,৮৪২ জন। সন্দ্বীপ ও দেশের মুল ভুখন্ডের মধ্যে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হল নৌপথ। দ্বীপ থেকে মূল ভুখন্ডে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বি.আই.ডব্লিউ.টি সি. এর ২টি ষ্টীমার ঘাট এবং ৫টি জেলা পরিষদ ফেরীঘাট।
সন্দ্বীপে শিক্ষার হার ৪৬.৭২%। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:
উচ্চ বিদ্যালয় - ২৮টি ।
কলেজ - ০৫টি।
মাদ্রাসা - ২৩৯টি।
প্রাথমিক বিদ্যালয় - ১৫০টি।
এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় - ০৫টি।
কমিউনিটি বিদ্যালয় - ০১টি।
এখানে প্রধানত কৃষি, মৎস্য চাষ ও আহরন । প্রধান ফসল ধান । তাছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাত প্রভৃতি স্থান হতে পাঠানো রেমিটেন্স।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ এর অবস্থান
সমূদ্রবেষ্টিত দ্বীপ এলাকা হওয়ায় সন্দ্বীপ প্রায়শই ঘূর্নিঝড়, টর্ণেডো, জলোচ্ছ্বাস ঢল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হয়। এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারনে সন্দ্বীপে প্রায় প্রতি বছরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শত শত বছর ধরে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস সন্দ্বীপে আঘাত হানেছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে এসকল ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ থেকে দেখা যায়- ১৪৮৪, ১৫৮৪, ১৭৭৬, ১৭৯৮, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩২, ১৮৩৫, ১৮৫৫, ১৮৬৪, ১৮৬৭, ১৮৬৯, ১৮৭০, ১৮৭৬, ১৮৯৩, ১৮৯৫, ১৯০৪, ১৯০৫, ১৯১০, ১৯১৯, ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৮৫, এবং ১৯৯১ সালে সন্দ্বীপে বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে।অসংখ্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাঝে ১৮২৫, ১৮৭৬, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস সন্দ্বীপের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়। স্মরনকালের ভয়াবহতম ঘূর্নিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টি ২৯শে এপ্রিল সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। সন্দ্বীপের ওপর দিয়ে এ ঝড়টি ঘন্টায় প্রায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে আক্রমণ করে। এই ঘূর্নিঝড়ে সন্দ্বীপের উপকূলীয় অঞ্চলের কমপক্ষে ৬০ হাজার এবং ঝড়ের পড়ে অনাহারে ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগে আরো প্রায় ২০-৩০ হাজার লোক প্রাণ হারায়।
অবস্থান এবং নামকরন
সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বকোণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম উপকূল এবং সন্দ্বীপের মাঝখানে সন্দ্বীপ চ্যানেল অবস্থিত। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। সন্দ্বীপের প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপের অবস্থান। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তারও পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে ১২ আওলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিস্কার করেন এবং নামকরণ করেন শুন্যদ্বীপ যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপে রুপ নেয়। ইতিহাসবেত্তা বেভারিজের মতে চন্দ্র দেবতা সোম এর নামানুসারে এই এলাকার নাম সোম দ্বীপ হয়েছিল যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপে রুপ নেয়।কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা এবং প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত স্বর্ণদ্বীপ হতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দুর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় স্যান্ড-হীপ (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান নামের উত্ִপত্তি হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩১