সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড:
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষই সরকার ও রাষ্ট্রের সাধারণ পার্থক্যটাই বোঝেন না। সেই সুযোগটা নিয়েছিল আওয়ামীলীগ, লীগের অনন্য অঙ্গসংগঠন, আওয়ামী দালাল, ভারতীয় দালাল ছাড়াও যারা ১৬ বছরের স্বৈরাচার শাসন আমলে দুধে ভাতে ছিল তারা। আওয়ামীলীগের বা এর সাথে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অপকর্মের প্রতিবাদ করা মাত্রই তাঁকে ট্যাগ দিয়ে দেয়া হত সরকার বিরোধী। নানান ভাবে করা হত হয়রানি। রাষ্ট্রবিরোধী মামলা সহ পাঠানো হত আয়না ঘরে। করো কপাল খারাপ হলে সে হত গুম, চলে যেত না ফেরার দেশে। মরতে হত ক্রসফায়ার নামক নেক্কারজনক-জঘন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে।
তাহলে সরকার এবং রাষ্ট্রের ভেতর পার্থক্যটা কী? সরকার হলো রাষ্ট্র পরিচালনাকারি একটি প্রতিষ্ঠান। যারা কিনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনতার রায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরু দায়িত্ব পালন করে। রাষ্ট্র হলো সেই মহা ক্ষেত্র যেখানে সরকার, জনগণ সহ অন্য সকল অস্তিত্ব বিরাজমান।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ এ, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে চিন্তা বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বধীনতা প্রদান ওরা হয়েছে। কিন্তু বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ শাসন আমলে এই অধিকার পুরোপুরি ভাবে উপেক্ষিত ছিল। শুধু তাই নয়, কেউ যদি সরকারের সমালোচনা করত, সেটাকে রাষ্ট্র বিরোধী ন্যারেটিভ দেয় হত। এই স্বৈরাচারী শাসনের এক পর্যায়ে, বাংলাদেশের মানুষ সরকার এবং রাষ্ট্রর ভেতর সহজ পার্থক্য ভুলতে বসেছিল। তাঁরা ভেবে নিয়েছিল সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড বা কথা বলা সম্পূর্ণ অবৈধ! কিন্তু সরকারের সমালোচনা, সরকার বিরোধী কর্ম কাণ্ড সব কিছুর বৈধ নিশ্চয়তা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ থেকে ৩৯ অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বা রাজাকার:
এই ট্যাগইং কালচার অমামিলীগ ৭১ এর পর থেকেই শুরু করে। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধটাকে রীতিমত পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে। কোনো ব্যক্তি তাদের স্বার্থের বাইরে গেলেই তাঁকে রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি ট্যাগ দেয় হতো। সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হতো। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামীলীগ বাংলাদেশে এক প্রকার অঘোষিত রাজতন্ত্র কায়েম করে। জুলুম, অন্যায় অত্যাচারের সীমা লঙ্ঘন করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তাদের ট্যাগইং থেমে থাকেনি! তাদের এহেন কর্ম কাণ্ডে দেশের জনতা তক্তবিররক্ত হয়ে প্রতিবাধী হয়ে ওঠে। তারপরও চলতে থাকে তাদের ট্যাগইং।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি:
আওয়ামীলীগ যতবারই বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছে। তবে ২০০৮ এ ক্ষমতায় আসার পর এরা উম্মাদ পাগলের মতো ইতিহাস বিকৃতি ঘটাতে থাকে। ৭ বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষা শহিদ সহ জাতীয় সকল নেতাদের উপেক্ষা করে একক ভাবে শেখ মুজিবের পূজা শুরু করা হয় সমগ্র বাংলাদেশে। শেখ মুজিবকে এমন একটি ফিগার বানাও হয়, যেখানে তাঁর কোনো সমালোচনা করা মহাপাপ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবের সকল ভুল-ত্রুটি গোপন করে, বিকৃত করা হয় দেশের পবিত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং যুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস। দেশ ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্র থেকে অঘোষিত রাজতন্ত্রতে পরিণীত হতে থাকে। ঠিক নর্থ-কোরিয়ার মতো। যেখানে একটি পরিবারের একটি দল এক নেতা। ইলেকশন ও হয় এবং সেই ইলেকশনে সেই নেতাই জেতে। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে নর্থ কোরিয়ার খুব একটা তফাৎ ছিল না। আওয়ামীলীগের স্বৈরাচারী সরকার শুধু ইতিহাস বিকৃত করে ক্ষান্ত থাকেনি, তারা এই দেশের একাধিক জেনারেশনকে এই বিকৃত ইতিহাস গিলিয়েছে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। শুধুমাত্র ওদের পা চাটা লয়ালিস্ট বানানোর জন্য।
শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের ঈশ্বর বানানোর অপচেষ্টা:
বিগত ১৬ বছরে আওয়ামীলীগ যে কত হাজার/লক্ষ প্রকল্পতে শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের নাম ব্যবহার করেছে সেটার ইয়াত্তা নেই। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম বা শহর নেই যেখানে শেখ মুজিবের বা তাঁর পরিবারের নামে কিছু নেই। ব্যপারটা ঈশ্বর বানানোর থেকেও ভয়াবহ। একক শেখ মুজিব এর নামের ওপর যে পরিমাণে দুর্নীতি হয়েছে সেটা সমগ্র পৃথিবীর কোনো দেশে নজির বিহীন। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, চায়ের দোকানে, এলাকার ক্লাব ঘরে, জুয়ার আড্ডা খানায়, এমন কোনো স্থান নেই যেখানে শেখ মুজিবের ছবি টাঙিয়ে ২ নাম্বারী কাজ হতো না। নতুন কোনো স্থাপনা বা প্রকল্প হলেই শেখ মুজিব বা তাঁর পরিবারের করো নাম থাকবেই। সম্ভবত শেষ বিতর্কিত হয়েছিল; কক্স বাজারের একটি সমুদ্র সৈকতের নাম "বঙ্গবন্ধু বিচ" রাখা। দেশের মানুষ এটা নিয়ে ট্রল শুরু করলে, পরে সেটা প্রত্যাহার করা হয়। শুধু এই নয়, বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি জেলাতে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় এক শিশু বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকলে সেটা একটু বেমানান হয়। এই জন্য ওই শিশুকে তিরস্কার এবং লাঞ্ছিত করা হয়। শেখ মুজিবের ১০০ তম জন্মবার্ষিকীতে কী উম্মাদনাইনা আওয়ামীলীগ দেখিয়েছে। ২০২০ সালের করোনার ভেতর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি-কোটি টাকা খরচ করে শেখ মুজিবের জন্মদিন উযাপন করা হয়েছে, যখন দেশের মানুষ করণা আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে হসপিটালে মরছে। সরকারি-বেসরকারি সকল অফিসে বাধ্যতামূলক মুজিব শতবর্ষ লোগো লাগানো হয়েছে। সকল সরকারি অফিসে মুজিব কর্নার বানানো হয়েছে। যেখানে শুধুই মুজিবের অস্তিত্ব ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো নেতার অস্তিত্ব ছিলো না।
জামাত-শিবির-জঙ্গি নাটক:
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামীলীগ জামাত-শিবির নির্মূলে মাঠে নামে। দেশে কোনো ধরনের কোনো অঘটন হলেই সেটার দোষ দেয়া হতো জামাত-শিবির বা বিএনপি এর ঘাড়ে। এমনও অনেক কাহিনি হয়েছে যেখানে আওয়ামীলীগ নিজে অপকর্ম করে পরে জামাত-শিবির বা বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। দেশে এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ দাড়ি রাখতে, টুপি পরতে ভয় পেত! শুধু মাত্র জঙ্গি নাটকের জন্য। অগণিত নির্দোষ মানুষকে জঙ্গি সাজিয়ে তাদের ক্রসফায়ার দিয়ে মেরেছে আওয়ামীলীগ। ১৬ বছরে বাংলাদেশের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে সংখাগুরু নির্যাতিত হতে শুরু করে কিছু কতিপয় সংখ্যালঘুদের দারা। আওয়ামীলীগ এবং ভারতের ছত্রছায়ায় এরা অদমনীয় হয়ে ওঠে।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের নামে বিরোধী দলকে ফাঁসানো:
জুলাই এর গণবিপ্লবেও আওয়ামীলীগ সংখ্যালঘু ট্রামকার্ড খেলেছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতা তাদের সেই ট্রামকার্ডকে ওভার ট্রাম করেছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আওয়ামীলীগের সংখ্যালঘু চালাকি এখন শিম্পূর্ণ পরিষ্কার। এরা বরাবরই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ডাঙা লাগিয়ে সেটা থেকে ফয়দা লোটার লুটেছে।
দ্য জ্বালাও পোড়াও থিওরি এন্ড ব্লেম গেম:
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকার পতন ঘটানোর জন্য একটা সময় বিএনপি দেশ জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কিন্তু তাদের স্ট্রাটেজি ছিল ভুল। এবং পরবর্তীতে তাদের এই ভুল স্ট্রেটেজই তাদের অন্যতম কাল হয়ে দাঁড়ায়। দেশে কোথাও আগুন লাগলেই, ভাংচুর হলেই আওয়ামীলীগ বিএনপির দিকে আঙুল তুলত। আওয়ামলীগের এই ব্লেমগেম ২৪ এর বিপ্লবে এসে ধরা পড়ে, যখন বাসে আগুন দেতে যেয়ে ধরা পড়ে আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠনের এক নেতা। ২০২৪ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সময় আওয়ামীলীগ একটু ভিন্ন স্ট্রাটেজি ফলো করে, তখন তারা বাসে আগুন না দিয়ে ট্রেনে আগুন দেয়া শুরু করে। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় বহু নিরীহ মানুষকে। তখনও আওয়ামীলীগ বিএনপি-জামাতের ঘরে দোষ চাপিয়ে পাড় পেয়ে যায়। কিন্তু সত্য তো চাপা থাকে না, একদিন না একদিন সত্য আলোর মুখ দেখবেই। বাংলাদেশের মানুষ এখন প্রমাণ সহ জানে কর দেশ জুড়ে ১৬ বছর মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। কারা ব্লেমগেম খেলেছে।
আরও অগণিত অপকর্ম করতে-করতে ১৬ বছরে আওয়ামীলীগের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়। যে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে ওরা দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতন শুরু করেছিল, সেই একটি রাজাকার শব্দই ওদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের জনগণ ঝেটিয়ে বিদায় করে আওয়ামীলীগ এবং এর অঙ্গসংগঠন গুলোকে। ১৬ বছরের স্বৈরাচারী-রাজতন্ত্রের অবসান হয়। বাংলাদেশের মানুষ আবারও স্বাধীনতা তৃপ্তি লাভ করে।
কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে ১৬ বছরের আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসনে দুধেভাতে থাকা "সুশীল আফসোসলীগ" এবং ভারতের একটি অংশ। ওরা একটা কাজই এখন করতে মহা বাস্ত; ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এবং বিজয়ের গৌরভকে কালিমা লেপন। কিছু হলেই আফসোস করতে-করতে বলা; এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম? এটাই কি তাহলে স্বাধীনতা? স্বৈরাচারী থেকে এরা কম কিসে? জনগণ ও স্বৈরাচারী। এটা ছাত্র আন্দোলন হতে পারে না! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই বদমাইশগুলোকে নিয়ে আশা করছি একটি লেখা হবে। এই বদমাইশ গুলো হলো দেশের পেটে ফিতা কৃমির মতন। নীরব ঘাতক। এখনই যদি এদের চিহ্নিত করে সামাজিক ভাবে বহিস্কার না করা যায়, তবে দেশের ভবিষৎ খুব একটা মসৃণ হবে না। এরা দেশটাকে ভেতর থেকে নীরবে কুড়ে কুড়ে খাবে!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৪ সকাল ৯:১১