শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী দুজনই বান্ধবী। কুমিল্লার নওয়ার ফয়েজুন্নেছা গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী তারা। ১৯৩০ সাল। মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে তখন চিটাগংয়ে বেশ কয়েকটি স্থানে বৃটিশবিরোধী আক্রমন রচিত হয়। বৃটিশরা তখন মাহাত্না গান্ধীর নেতৃত্বাধীন অহিংস আন্দোলনের পক্ষে যারা, তাদেরকেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা বা গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যদিও বৃটিশ বিরোধী। আর নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস, মাষ্টারদা সূর্য সেন সহ সহিংস আন্দোলনের সবাইকে বৃটিশরা অদ্যাবধি Terrorist হিসেবেই দেখে আসছে। শান্তি ও সুনীতির মধ্যে পারিবারিকভাবেই বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন ও নিজেদের যুক্ত করবার ইচ্ছে ছিল।
শান্তি ঘোষের জন্ম ২২শে নভেম্বর, ১৯১৬ সালে কলকাতায়। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষের আদি বাড়ী বরিশালে এবং তিনি তখন কুমিল্লা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, একজন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক। তিনি খুব ছোট বেলা থেকেই শান্তিকে নিয়ে যেতেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের মিটিংয়ে। ১৯২৬ সালে যখন সরোজিনি নাইডু কুমিল্লায় আসেন, তখন মাত্র ১০ বছর বয়সে শান্তি তার পিতার সাথে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা সংগীতে অংশগ্রহন করেন। সেদিন বাসায় ফিরেই তার বাবা তাকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন এবং সরোজিনি নাইডুর মত নেত্রী হতে অনুপ্রেরনা দেন।
সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষের চেয়ে ছয় মাসের ছোট হলেও স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। সুনীতি ২২শে মে, ১৯১৭ সালে, ত্রিপুরা জেলা, বর্তমানে কুমিল্লার, ইব্রাহিমপুর নামক গ্রামে, একটি মধ্যবিত্ত সাধারন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা উমাচরণ চৌধুরী বৃটিশ সরকারের কালেক্টরেট অফিসে চাকরি করতেন। সরকারী চাকরী করলেও, তিনি তার মেয়ে সুনীতি ও ছেলে শিশিরকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন।
যুগান্তর পার্টির একমাত্র মেয়ে নেত্রী প্রফুল্ল নন্দিনী বর্মনের নজরে আসে শান্তি ও সুনীতি। যুগান্তর পার্টি ছিল বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। যারা সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং আক্রমনে অংশগ্রহনের জন্য কারাতে, তীর ধনুক ও অস্ত্র চালনার শিক্ষা দিত। প্রফুল্ল নন্দিনী স্কুলে শান্তি সুনীতির এক ক্লাস উপরে পড়ত। পার্টি থেকে তার উপরে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নারী দল গঠনের। প্রথমে শান্তি ও সুনীতি ও পরে আরও কিছু মেয়েকে জোগাড় করে তিনি তৈরী করেন Tripura District Women Student's Association। নিজে প্রেসিডেন্ট ও শান্তি ঘোষ সেক্রেটারি ছিল সেটির। শান্তি ও সুনীতি গোপনে যুগান্তর পার্টি হতে গোপনে অস্ত্র চালনার ট্রেনিং গ্রহন করেন। ঐ বছরের অর্থ্যাৎ ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল মাষ্টারদা সূর্য সেন চিটাগংয়ে অস্ত্রাগার লুট করেন এবং এই ঘটনা শান্তি সুনীতি সহ সব নেতৃবৃন্দের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
১৯৩১ সালের মে মাসে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু ত্রিপুরায়, Tripura Students Conference এ প্রধান অতিথি হয়ে এলেন। সেখানে প্রফুল্ল নন্দিনী, শান্তি ও সুনিতা সহ অন্যান্য মেয়েদের সাথে নিয়ে নেতাজীকে বলেন -
- আমরা মেয়েরা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহন করতে চাই। আপনার মতামত কি?
- আমি মেয়েদের সামনের সারিতে দেখতে চাই।
এরপরে প্রফুল্ল নন্দিনী নেতাজীর কাছে অটোগ্রাফ চাইলে, নেতাজী লিখেন -
- তোমাদের সম্মান রক্ষার্থে তোমরা হাতে অস্ত্র তুলে নাও, হে মা।
নেতাজীর এই অনুপ্রেরনা সবার মনে পুনরায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তার দুমাস আগেই ত্রিপুরায় নতুন মেজিষ্ট্রেট হিসেবে জয়েন করেছেন, ৩৯ বছর বয়স্ক খাতারনাক, দুঃশ্চরিত্রের অধিকারী CGB Stevens। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় নারীদের ধর্ষনের অভিযোগ ছিল এবং তিনি সেটি অনেকটা প্রকাশ্যেই তার অধিকারবলে করেন, এমন কথাচি বলতেন বলে শোনা যায়। তিনি এসেই বিপ্লবীদের ব্যাপক ধরপাকড় করেন। বাধ্য হয়ে পুরুষ বিপ্লবীরা কিছুটা অত্নগোপন ও লুকিয়ে চলা শুরু করেন। তাই, ঐ সময়ে বাংলার বুকে বৃটিশবিরোধী নারী বিপ্লবের প্রথম আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয়। টার্গেট CGB Steven।
ডিসেম্বর ১৪, ১৯৩১, শীতকাল। শাল পরিহিতা সাড়ে চৌদ্দ ও পনের বছর বয়সের যথাক্রমে সুনীতি ও শান্তি নামের দুজন কিশোরী এল মেজিস্ট্রেট CGB Steven এর বাংলোতে। সদর দরজায় তাদের আগমল্র হেতু ও পরিচয় জিজ্ঞেস করা হল। উত্তরে তারা বললেন -
- তারা নওয়াব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী। তারা তাদের স্কুলে মেয়েদের সাতার প্রতিযোগীতা আয়োজনে সহায়তা ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবার জন্য কথা বলতে এসেছে। অনুমতি মেলে, মেদিষ্ট্রেটের অতিথি কক্ষে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। CGB Steven আসলে তারা একই কথা বলে তাকে প্রোগ্রামের ব্যপারে দাওয়াতপত্রটি পড়তে দেয়। CGB Steven এর নজর যখন পত্রের দিকে, তখন শান্তি ও সুনীতি তাদের শালের ভেতরে রক্ষিত পিস্তল বের করে এনে তাক করেন। সুনীতির প্রথম গুলিটিই Steven এর মাথায় বিদ্ধ হয়। সাথে সাথে তার শরীরে শান্তি গুলি করে। এরপরে অরো গুলি করলেও এক পর্য্যায়ে তাদের সেখানেই ধরা হয় ও এই কিশোরী দুজনকে বেদম মারধর করা হয়। এর দুদিনের মধ্যে সুনীতির ভাই শিশির, প্রফুল্ল নন্দিনী সহ আরও কিছু নেতাকে গ্রেফতার করা হয় ও তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমান না থাকায় তারা সবাই মুক্তি পায়। কিন্তু, প্রফুল্ল নন্দিনীকে ১৭ই এপ্রিল, ১৯৩৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে ত্রিপুরায় তার বাসায় নজরবন্দী/গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। সেইসময়েই তার এ্যাপেনডিক্সের সমস্যা ধরা পরে। নিয়ম অনু্যায়ী কোন গৃহবন্দীকে যদি কোন চিকিৎসার কারণে ডাক্তার দেখাতে হয়, তাহলে স্থানীয় SDO সাহেবের অনুমতি লাগবে। সেই অনুমতি সবার জন্য মিললেও SDO সাহেবের দেখা পান না প্রফুল্ল নন্দিনীর বাবা। দেখা পাওয়াটা সম্ভব ছিল না, কারণ সেটি ছিল ইচ্ছাকৃত। তারপরেও তার বাবা একবার মাত্র একদন জাক্তার বাসায় আনতে পারেন। ২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৭ সালে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে মারা যান এই বিপ্লবী প্রথম নারী নেত্রী।
সেদিনের সে আক্রমনে গতি পেয়েছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। সারা দেশে ছড়িয়ে পরে শান্তি ও সুনিতীর নাম। রাজশাহীতে শান্তি ও সুনিতীর ছবি সম্বলিত পোষ্টার লাগানো হয় ও সেটির এক কপি পুলিশ স্টেশনের ভেতরে পাঠানো হয়।
সেখানে শান্তি ও সুনীতিকে জাতীয় বীর উল্লেখ করে, ছবি ও নীচে লেখা হয় -
"THOU ART FREEDOM'S NOW, AND FAME'S" এরপরে Robert Burn এর কবিতার দুটি লাইনের উদ্ধৃতি দেয়া থাকে -
"Tyrants fall in every foe!
Liberty's in every blow!"
শান্তি ও সুনীতিকে গ্রেফতার করে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হয়। একজনের সাড়ে চৌদ্দ, অপরজনের পনের বছর বয়স। কি অমানবিক! অথচ, এই দুজনকে যখন কোর্ট থেকে জেলে, জেল থেকে জেলে স্থানান্তর করা হচ্ছিল, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে দুজন এক সাথে দেশাত্নকবোধক গান গাচ্ছিল। দুজনের মুখেই পরিতৃপ্তির হাসি। তাদের সেই হাসি ঠোঁট থেকে মুছে যায় যখন তাদের বয়সের কারণে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। শান্তি ও সুনীতি আদালতে চিৎকার করে বলে - আমাদের দেশের জন্য শহীদ হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হল। এই ঘোড়ার আস্তাবলে থাকার চেয়ে মরনই ভাল ছিল। তার আগে তারা দুজনই হত্যাকান্ডটি স্বীকার করে বলে - Steven আমাদের মা বোনদের শ্লীলতাহানি করেছে। তাদের যখন জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তারা দুজনই জেলখানায় একইসাথে গাইতে গাইতে ঢোকে -
- কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট.....
সাত বছর জেল খাঁটার পরে শান্তি ও সুনীতি, ১৯৩৯ সালে বৃটিশদের সাথে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তি পায়।
জেলে সুনীতিকে একটি নির্জন কক্ষে একা রাখা হয়। সাতটি বছর সবকিছু থেকে দুরে রেখে তাকে মৃত্যুদন্ড থেকেও বড় শাস্তি দেবার চেষ্টা করা হয়। এদিকে, তার বাবার কোন কারণ ছাড়াই পেনশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তার বড় দুই ভাইকে কোন ধরনের ট্রায়াল ছাড়াই জেলে পুরে রাখে। তাদের পরিবার না খেয়ে মরতে বসে। এক পর্য্যায়ে অপুষ্টিতে ভুগে তার একমাত্র ছোট ভাইটি মারা যায়। এহেন পরিস্থিতিতে সুনীতি লেখাপড়াকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করে। কলকাতায় গিয়ে এমবিবিএস করে গরীব দুঃখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেন বাকী জীবনটি, যেটির মধ্যেও দেশপ্রেম ছিল। দেশভাগের বছরে, অর্থ্যাৎ ১৯৪৭ সালে, তৎকালীন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা প্রদ্যোৎ কুমার ঘোষকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন।
শান্তি ঘোষও কলকাতায় বেঙ্গলী উইমেন্স কলেজে পড়াশুনা করেন ও বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৫২ -৬২ ও ১৯৬৭ - ৬৮, তিনি পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যসভার সদস্য এবং ১৯৬৩ -৬৪ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন দাসকে বিয়ে করেন। তিনি "অরুন বাহিনী" নামক একটি বই লিখেন। ১৯৮৯ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
বৃটিশরা অদ্যাবধি মাষ্টারদা সহ সমস্ত বিপ্লবীকে Terrorist বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে, দেশপ্রেমিক নয়। দেশ প্রেমিক স্বীকৃতি পেয়েছে গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ। এই দুজন নারীকে নিয়ে এবং মাষ্টারদাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মান করছে ভারতের পরিচালকরা - হে মাতা। তাদের আর্কাইভে আছে সমস্ত বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেতৃদের জীবনকাহিনী। আমরা মনে হয় এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত। তারা কুমিল্লায় জন্মগ্রহন করলেও, কুমিল্লার ম্যাজিষ্ট্রেটকে হত্যা করলেও, তখন তো নাম ছিল ত্রিপুরা। এখন ত্রিপুরা নাম তো আমাদের নেই। ভবিষ্যতে আমাদের ভৌগলিক অবস্থানে কোন পরিবর্তন এলে, আমাদের বীরদের নামও কি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা ভুলে যাবে? যাক, তখন তো আর আমরা বেঁচে থাকব না -
ধনীর আদরে গরব না ধরে এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোন চিহ্ন।
তবে, আমরাও ভুলিনি। কুমিল্লা শহরের একটি গলির নাম আজও শান্তি সুনীতি আছে। আমরা জাতি হিসেবে এসব ভুলি না।
আমরা হয়েছি আলোকিত, আমরা হয়েছি প্রগতিশীল। আমরা অন্ধকারে নেই। তাই, শান্তি, সুনীতির মত পুরনো ইতিহাস ঘেটে লাভ কি? কুমিল্লা নয়, ত্রিপুরা নামের কারণে, তাই হয়তো ভারতই তাদের ইতিহাস রক্ষক। আমরা বর্তমানে বিশ্বাসী। তাই, বাংলাদেশী পিতার রাশিয়ান নাগরিক কন্যা -
- মার্গারিটার অলিম্পিকের সোনাটা নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করে বড্ড সুখ পাই।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:১৪