একটি রম্য রচনা
সদা সত্য কথা বলিবে। সত্য বৈ মিথ্যা কখনো বলিবে না। মিথ্যা বলা মহা পাপ। এসব কথা আমরা সকলেই পড়েছি, জেনেছি এবং পালন সবসময় করতে না পারলেও নিদেনপক্ষে বিশ্বাস করেছি মন থেকে।
কিন্তু বর্তমান অবস্থা বেশ ভিন্ন। যুগের চাকা যতই জোরে ঘুরছে, ধ্রুবর ধ্রুবতা ততই জোরে কমছে। গত পরশু যা ছিল সত্যের আশা, গতকাল তা দৃষ্টিতে ঝাপসা, আজ বাস্তবে দুর্দশা, আগামীকাল ঘন কুয়াশা, পরশু হয়ত মিথ্যের হতাশা। ছোট বেলায় জ্বর হলে ভাত নিষিদ্ধ, আর এখন তো বলে বেশী করে খেতে। সারাজীবন শুনলাম ফ্ল্যাজিল পেটের অসুখে খায়, সেদিন দেখলাম দাঁতের অপারেশনের পরে এক রোগীকে ফ্ল্যাজিল দিয়েছে। কোথায় দাঁত আর কোথায় ফ্ল্যাজিলের লোকেশন! পরে এক ডাক্তার বন্ধু বলল, খুবই ক্লোজ রিলেশন নাকি দুটোর মধ্যে, যেনতেন না, ফার্স্ট কাজিন। শোনার পরে এই সংক্রান্ত একটা গল্প মনে পড়ে গেল। দুজন ডাক্তারের চেম্বারের দরজা পাশাপাশি। এক দাঁতের রোগী ভুলে ডেন্টিষ্ট এর চেম্বারে না ঢুকে পাশের দরজা দিয়ে পাইলস এর ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়েছেন। ঢোকামাত্রই এসিসট্যান্ট এর নির্দেশ শুয়ে পড়ুন। শুয়ে পড়লেন। দুজন এসিসট্যান্ট একসাথে এসে রোগ হয়েছে লজ্জা কিসের? বলতে বলতেই চার হাত দিয়ে চিত হওয়া অবস্থা থেকে উপুড় করে দিলেন। কিছু বলবার আগেই ডাক্তার গ্লাভস পড়ে রেডি। রোগী বৃথা চেষ্টা করছে চিত হতে। অস্থিরতা দেখে ডাক্তার সহজ করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন -
- ভয় পাচ্ছেন নাকি?
- হ্যাঁ। ডাক্তার বলছেন -
- ভয় কিসে? রোগী বলছে -
- ডাক্তার সাহেব, এত লম্বা রাস্তায় দাঁত তুলবেন?
রিলেশন যখন ফার্স্ট কাজিন, তখন হলেও হতে পারে। এভাবেই অতীতের সব জানাগুলো হয়ে উঠে অজানা, সব ধ্রুব সত্যগুলো মিথ্যে।
দাদার একমাত্র শ্যালক দাদার বাসায় থাকতেন, ক্লাস নাইনে পড়েন। বাবা পড়েন ফাইভে। ফুফুরা সবাই কলেজে, একজনের বিয়েও হয়ে গেছে। দাদার একমাত্র শ্যালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তিনি ধুমপান করেন। দাদা ও দাদি তাকে জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করলেন। বাবা দেখলেন, তার একমাত্র মামাজান মিথ্যে বললেন। এরপরে এক ফুফু জানেন না বললেন, হাল্কা মিথ্যা। আরেক ফুফু তার মামার পক্ষে কথা বললেন। বাবা দেখলেন, তার বাবা মাকে কি কেউই সত্য কথা বলবে না? দৌড় দিয়ে ঘরের পেছনে গিয়ে, সিগারেটের সমস্ত মুড়াগুলো দুই হাতে তুলে নিয়ে এসে বমাল প্রমাণ করলেন -
- মামা ধুমপায়ী, ভাগিনা সত্যবাদী।
এরপরে ইতিহাস! বাকী ভাইবোনেরা বাবাকে ধোলাই দিল সত্য বলার অপরাধে। তাদের যুক্তি - যুদ্ধের ময়দানে নাকি ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল! আজ তাদের মামার জীবনে যুদ্ধ।
তাই মনে হয়, পৃথিবীতে আসলে ধ্রুব সত্য বলে কি কিছু আছে? শুধুই মায়ের ভালবাসা বাদে? সবসময় সত্য বলা কি সেক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক? আমি ঠিক জানি না। কারণ এই সংক্রান্ত কোন গল্প তো জানা নেই। বইতে যা আছে, সবই তো সত্য বলার উপরে। যেমন - কাঠুরের গল্পটা তো ছোট বেলায় আমরা সকলেই পড়েছি। একটু রিফ্রেশ করে নেয়া যাক -
এক কাঠুরিয়া কাঠ কাটছিল। হটাত করে তার হাতের কুড়ালটি পুকুরের পানিতে পরে যায়। গরীব কাঠুরিয়া কিভাবে আবার কুড়াল কিনবে। তাই মনের দুঃখে পুকুরের পাড়ে বসে কাঁদছে। এই সময় তার কান্না শুনে জলদেবতা উঠে এলেন এবং কাঠুরিয়াকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে সব জানতে পারলেন। এরপর চোখের নিমেষে পানির নীচ থেকে একটি সোনার কুড়াল এনে কাঠুরিয়াকে বললেন -
- এটা তোমার কুড়াল?
- না।
তারপর আবার ডুব দিয়ে এবার একটি রুপার কুড়াল আনলেন এবং যথারীতি আগের বারের মত কাঠুরিয়া না বললে জলদেবতা এবার, কাঠুরিয়ার কুড়ালটি নিয়ে এসে দেখালে কাঠুরিয়া বলল -
- জ্বী হ্যাঁ। এটিই আমার কুড়াল।
জলদেবতা কাঠুরিয়ার সততায় মুগ্ধ হয়ে তিনটি কুড়ালই দিয়ে দিলেন পুরস্কার স্বরূপ।
এবার অন্য একটি গল্প শোনা যাক। একবার এক লোক রাস্তায় একটি বইয়ের কয়েকটি পাতা কুড়িয়ে পেলেন এবং দেখলেন সেখানে বিভিন্ন রকম রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণিত। তাই সযত্নে কাগজগুলোকে আলমেরাতে তুলে রেখে দিলেন। কিছুদিন পরে তার স্ত্রীর জ্বর হল। লোকটি কাগজগুলো বের করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে জ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতি পেয়ে গেলেন - একটি লৌহ দণ্ড রক্তের ন্যায় লাল বর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত আগুনে গরম করিতে হইবে। অতঃপর উক্ত লৌহদণ্ডটি দ্বারা পশ্চাতদেশে তিনটি ছ্যাঁকা দিতে হইবে। যেমন লেখা তেমন কর্ম, যেমন কর্ম তেমন ফল। স্ত্রী হাসপাতালে আর লোকটি চৌদ্দ শিকের ভিতরে। লোকটি বারংবার বলার পরেও কেউই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করল না যে এটি বইয়ে লেখা আছে। বাধ্য হয়ে লোকটি তার এক আত্মীয় মারফত বইয়ের পাতাগুলো এনে পুলিশকে দেখাল। পুলিশ পড়ে কিছুটা আশ্চর্য হলেও নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তাররাও পড়ে অবাক। সিনিয়র একজন ডাক্তার পাতাটি উল্টিয়ে দেখলেন পরের পাতায় লেখা - পরবর্তী তিনদিন গরুকে গোসল না করানোই বাঞ্ছনীয়!!
পৃথিবীতে হয়ত ধ্রুব সত্য হিসাবে আমরা যা জানি, দায়িত্ববান কোন ব্যক্তি হয়তোবা ভুল করে হোক, দায়িত্বে অবহেলার কারণেই হোক, পাতাটি উল্টাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঐ একই কারণে হয়তোবা ঐ কাঠুরিয়ার গল্পের বইটি যখন ছাপানো হয়, তখন ছাপাখানায় পরের পাতাটি, অর্থাৎ শেষ পাতাটি না উল্টানোর কারণে পুরোটা ছাপানো হয়নি। আমি মুল গল্পের বাকী অংশ, যেটি ছাপানো হয়নি, সেটি নিম্নে উল্লেখ করছি -
কিছুদিন পরে ঐ কাঠুরিয়ার বউ গোসল করতে গিয়ে, ঐ পুকুরের পানিতেই ডুবে গেল। কাঠুরিয়া আগের মতই চিৎকার করে কাঁদছে আর আহাজারি করছে -
- ও মোর সোনা বউরে, তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে? এই বয়সে বউ হারাইলে তো পুরুষ মানুষও বিধবা হয়ে যায়। আমার এখন কি হবে? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব?
জলদেবতা আগের মতই এলেন এবং শুনলেন। মুহূর্তের মধ্যে পানি থেকে তুলে নিয়ে আসলেন এবং সাথে সাথে আগমনী মিউজিক বাঁজা শুরু হয়ে গেল -
- মাই নেম ইজ শিলা, শিলা কি জাপানী! সাথে ক্যাটরিনার সেই বিখ্যাত কোমর বাঁকানো নাচ। কাঠুরিয়ার চোখের পলক পড়ছে না, শরীরে একটা চিকন ঘাম দিয়ে গেল, হার্ট বিট বেড়ে গেল ও মুখটা কিঞ্চিত ফাঁক করা। জলদেবতা বললেন -
- তোমার বউ?
কোন উত্তর নেই। তাই জলদেবতা এবার জোড়েই বললেন -
- এটা কি তোমার বউ?
ক্যাটরিনার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে, মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটি শব্দ শুধু করল কাঠুরিয়া -
- আহ!
এর সাথে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে ইশারা করল চলে যাবার জন্য। জলদেবতা এবার একটা জোরে ধাক্কা দিলে কাঠুরিয়া জলদেবতার দিকে তাকিয়ে বলল -
- খালি বিরক্ত করেন, কামের সময় আমের দোকান ভাল লাগে না। কি বলতে চান তাড়াতাড়ি বলেন। টাইম নাই। জলদেবতা বললেন -
- মেয়েটা কি তোমার বউ?
- অবশ্যই, আবার জিগায়!
- ছি, ছি, সেদিন তোমার সততায় আমি কত মুগ্ধ ছিলাম, কিন্তু আজ আমি একি দেখলাম? একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল!! দুশ্চরিত্র, লম্পট কোথাকার, তুমি বউ তো পেলেই না, উপরন্তু শাস্তি স্বরূপ তোমাকে দেয়া তিনটি কুড়ালই আমি ফেরত নিয়ে যাচ্ছি।
- হ্যালো, মিস্টার জলদেবতা, মুখ সামলায় কথা বলেন। দেওনের মালিক আপনি, নেওনেরও মালিক আপনি। লইয়া যান। আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু আমাকে কোন সাহসে দুশ্চরিত্র এবং লম্পট বললেন, তা এই পুকুর পাড়ের মাটিতে দাড়িয়েই আপনাকে জবাব দিতে হবে। ইয়ার্কি ডু?
- তুমি একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে নিজের বউকে ভুলে যেয়ে এই মেয়েকেই বউ বলছ? লজ্জা করেনা! ছি, ছি.।
- হ্যালো জলদেবতা আংকেল, আপনার খেলা আমার বোঝা শেষ। এরপরে একটা কম সুন্দরী ও শেষে আমার বউকে আনবেন। আমি হ্যাঁ বলতাম আর আপনি তিনজনরেই আমারে দিয়া দিতেন। তিন বউ নিয়ে যারা সংসার করে, তাদেরই চরিত্র খারাপ, তারাই লম্পট। আমি তো সেই ক্ষেত্রে এই মেয়েকে পাইতামই, সাথে আরও দুইটা বোনাস পাইতাম। তিন বউ মানে সংসারে অশান্তি। আর, আমি যেহেতু সৎ পথে পয়সা উপার্জন করি, তাই তিন বউকে পোষার মত সামর্থ্যও আমার নাই। আমি সৎ এবং চরিত্রবান মানুষ অবশ্যই। আমি আমার সততায় অনড়। আপনার যা ইচ্ছা আপনি করতে পারেন।
জলদেবতা লা জওয়াব। বাধ্য হয়ে জলদেবতা ক্যাটরিনাকে রেখে চলে গেলেন।
কাঠুরিয়া ক্যাটরিনাকে নিয়ে ঘরের ভিতর টুকুস টুকুস করে গল্প করে খানিকক্ষণ, এরপর একটু খিলখিল হাসি, তারপর কিছু সময়ের জন্য নীরবতা। আবার একই ঘটনা, টুকুস টুকুস... খিলখিল...নীরবতা। সাতদিন পর দরজা খুলে বাইরে বের হয় কাঠুরিা। সোনার কুড়াল থেকে চিমটি কেটে একটু অংশ নিয়ে বাজারে যেয়ে বিক্রি করে, একবারে সাতদিনের বাজার করে ঘরে ফিরে। এরপরে আবার সাতদিনের জন্য দরজা বন্ধ। শুধুই -
- "টুকুস টুকুস... খিলখিল...নীরবতা... টুকুস টুকুস... খিলখিল...নীরবতা..... চলছেই... চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:০৯