বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক সফল ছবির রেকর্ড, ১৯৮৯ সালে নির্মিত "বেদের মেয়ে জোৎস্না" ছবিটির। ১৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে এই ছবিটি। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তখন গড়ে টিকেটের মূল্য মফস্বল শহরগুলিতে ৮ - ১০ টাকা ছিল। আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ২০১৪ সালে মাহিয়া মাহির অগ্নি সিনেমাটি। মোট ১২ কোটি টাকার ব্যবসা করে, যখন ঐ মফস্বল শহরের একই সিনেমা হলগুললোতে টিকেটের মূল্য ছিল ৩৫ - ৪৫ টাকা। তাই, জনপ্রিয়তার তুলনা করতে হলে আপনাকে Appleto Apple তুলনা করতে হবে। টিকিটের মূল্যকে normalise করলে অগ্নি সিনেমাটির ব্যবসায়িক মূল্য দাড়ায় তিন কোটি টাকার মত। অর্থ্যাৎ, প্রথম স্থানে থাকা ছবিটির জনপ্রিয়তা, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ছবিটির জনপ্রিয়তার পাঁচগুন ছিল। বর্তমানে দেশের সিনেমার বেহাল দশার কথা চিন্তা করলে, এটি নিশ্চিত বলা যায় যে -
- "বেদের মেয়ে জোৎস্না" ছায়াছবির রেকর্ড, বাংলার মাটিতে অম্লান থাকবে সারাটি জীবন।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে "বেদের মেয়ে জোৎস্না" সিনেমাটির অভাবনীয় সাফল্যে, পশ্চিমবঙ্গের ছায়াছবি নির্মাতারা ছবিটি রিমেক করার লোভ থেকে নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। উড়িয়ে নিয়ে যান বাংলাদেশের দর্শকদের প্রানের নায়িকাকে কলকাতায়। চিরঞ্জীবের সাথে জুটি বেঁধে নির্মিত হয় ১৯৯১ সালে আবার সেই - বেদের মেয়ে জোৎস্না। বেদের মেয়ে জোৎস্না ও অমিতাভের হাম ছবিটি একই দিনে মুক্তি পায় পশ্চিমবঙ্গে। বেদের মেয়ে জোৎস্না ছবিটি পশ্চিম বঙ্গে এতটাই হিট করে যে, সম্পূর্ণ ফ্লপ হয় অমিতাভের হাম ছবিটি। কাছাকাছি বছরে, একই নামের দুটি সিনেমা, দুটি ভিন্ন দেশে তৈরী এবং হিট হবার ঘটনা, পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আর নেই। তাই, এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সন পর্য্যন্ত, এপার বাংলা ওপার বাংলা, দু জায়গাতেই সমানতালে সিনেমায় অভিনয় করে যান বাংলাদেশের একজন নায়িকা। তিনি বাংলাদেশের কোটি দর্শকের প্রানের অভিনেত্রী - অঞ্জু ঘোষ, The beauty queen. যিনি নিলো নামে পরিচিত ছিলেন চলচ্চিত্রের অঙ্গনে।
যমুনার কোল ঘেষে ভাঙ্গা, ফরিদপুর জেলা। নদী তারবর্তী অঞ্চলে ধুলিঝড় নিত্য নৈমত্তিক একটি ব্যপার। কিন্তু, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে কি ভাঙ্গায় সেই ঝড়টি একটু জোড়েই হয়নি? তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। তবে, হয়তো হয়েছে। কারণ, সেদিন বাংলার আকাশ বাতাসে ঝড় তুলতে, সুধন্য ঘোষ ও বীনাপানি ঘোষের ঘরে ঝড় হয়ে এসেছিল এক কন্যা সন্তান - অঞ্জলী ঘোষ। কিশোরী বয়সেই অঞ্জলী যখন বিভিন্ন যাত্রাদলে অভিনয় করেন ও গান গাইতেন, তখনই দর্শকরা তার নাম অঞ্জলী ঘোষ থেকে অঞ্জু ঘোষ রাখে। । অঞ্জু ঘোষ গানও গাইতেন খুবই ভাল। সঙ্গীতকে তিনি কণ্ঠে ও হৃদয়ে ধারন করেছেন রক্তের মাধ্যমে, পিতামাতাও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। অঞ্জু ঘোষ সিনেমায় বহু গানের সুরে সাহায্য করেছেন, স্ক্রিপ্ট লেখনিতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন, কিন্তু তার নিজের নাম লিখেননি কোথাও। কতটাই উদার, প্রচারবিমুখ ও মহৎ একজন শিল্পী হলেই এটি সম্ভব! তার একমাত্র ভাই পংকজ ঘোষ। বোন - মঞ্জু ঘোষ (বোস), স্বর্গীয় দেবলীনা ঘোষ ও ঘোষ (দত্ত)। পরিবারের সবাই কলকাতায় সেটলড। অঞ্জু ঘোষ ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত ধর্মকেই সমান শ্রদ্ধা করত বলে জানা যায়। বর্তমানে কলকাতার সল্ট লেকে বসবাস করছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক সময়ের সারা জাগানো এই নায়িকা।
অঞ্জু ঘোষ ব্রাক্ষনবাড়িয়ার ভোলানাথ যাত্রা দলে অভিনয় ও গান পরিবেশন করতেন কিশোরী বয়সে ১৯৭১ এর আগে। ১৯৭১ এ তার পরিবার ফরিদপুর থেক আসে বন্দর নগরী চট্রগ্রামে। চাটলার মেয়ে হিসেবে স্বাধীনতার পরে শুরু করেন মঞ্চ নাটক ও যাত্রাপালাতে অভিনয়। সেখানে তিনি দুবাইওয়ালা, রিকশাওয়ালা, সাতভাই চম্পা, রূপবানসহ প্রচুর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মঞ্চায়িত নাটকে অভিনয় করেন এবং একশ্রেণির দর্শকের কাছে রীতিমতো ক্রেজে পরিণত হন। তার সঙ্গে এসব নাটকে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন চট্টগ্রামের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা পংকজ বৈদ্য। যিনি পরবর্তীতে সুজন নামে ‘উজান-ভাটি’সহ বেশ কটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
১৯৮২ সালে এফ কবীর চৌধুরীর প্রযোজনায় সওদাগর ছবির মধ্য দিয়েই বাংলা ছবির জগতে প্রবেশ অঞ্জু ঘোষের। প্রথম ছবিতেই বুঝিয়ে দেন, তিনি দেশ কাপাতে চলচ্চিত্রে এসেছেন। ছবিটি হিট হলে, একই বছরে এফ কবীর, অঞ্জু ঘোষকে নায়িকা করে একে একে তৈরী করেন তৈরী করেন - আবে হায়াত, নরম গরম, আশীর্বাদ, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা সিনেমাগুলি। সবগুলো ছবিই সুপার ডুপার হিট করে। কথিত আছে - ব্ল্যাকাররাও কালো বাজার থেকে টিকেট কিনতে বাধ্য হয়। প্রথম বছরেই অঞ্জু ঘোষ উড়িয়ে দেন সমস্ত নায়িকাকে। অঞ্জুর এহেন সাফল্যে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক মহিউদ্দিন, নায়করাজ রাজ্জাকের বিপরীতে অঞ্জুকে নায়িকা করে ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখেন। তৈরী করেন - বড় ভাল লোক ছিল। সিনেমাটিও হিট করে। অঞ্জু ঘোষ সম্মন্ধে ততদিনে লোকজন বলতে শুরু করেছিল - তিনি অশ্লীলতার উপরে ভর করে টিকে আছেন। যারা এই কথা বলেছিল, এই সিনেমায় গ্রামের একটি সহজ সরল বধুর চরিত্রে দু্র্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে, সেইসব মানুষদের তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন - তিনি অভিনয় শিল্পেও পারদর্শী। বুঝিয়ে দেন - তিনি যেন তেন পাথরের সৃষ্টি নন। সারা বাংলায় উচ্চারিত একটিই নাম তখন - অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জু ঘোষ আর অঞ্জু ঘোষ - যে নামে আকাশ বাতাস কাপতে শুরু করে। একের পর এক সিনেমা তৈরী করতে শুরু করেন তিনি। সংস্কৃতিপ্রেমী অঞ্জু ঘোষ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, হাসিখুশী ও মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ।
১৯৮৬ সালে এসে কিছুটা কারণ ব্যতীত ছন্দপতন ঘটে। কারণ অজানা। হতে পারে রাশিফল, হতে পারে যাদুটোনা। তবে, অঞ্জু ঘোষ আবার স্বরুপে আবির্ভুত হন পরের বছরেই ১৯৮৭ সালে। এরপরে মুক্তি পায় তার ১৪টি সফল ছবি।
এরপরে ১৯৮৯ সালে বেদের মেয়ে জোৎস্নার কথা তো আমরা সবাই জানি।
জন্ম, মৃত্যুর মত একটি কঠিন সত্য হচ্ছে মানুষের বয়স। ১৯৯১ সালে শাবনাজের মত যৌবনের শুরুতেই নায়িকারা আসতে শুরু করেন, তখন ৩৫ বছর বয়সী অঞ্জু ঘোষের প্রকৃতির নিয়মেই এজিং ইফেক্ট শুরু হয়ে গেছে। যদিও তিনি তখন এপার বাংলা ওপার বাংলায় সিনেমা করে যাচ্ছিলেন।
১৯৯৫ সালের দিকে তিনি, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদুর রহমান সাঈদের মাদক বিরোধী একটি চলচ্চিত্র "নেশা" ছবিতে কাজ শুরু করেন। ঐ সময় নবাগত নায়িকাদের আগমনে অঞ্জু কিছুটা কোনঠাসা ছিলেন। তাই, কিছু পরিচালক ও স্থানীয় গড ফাদারদের দীর্ঘদিনের চাপা লোলুপ দৃষ্টি পরে অঞ্জু ঘোষের উপর। বাংলাদেশে কিছুটা মন্দা গেলেও অঞ্জু ঘোষের তখনও পশ্চিম বঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়তা। তাই, ১৯৯৬ সালে সপরিবারে অঞ্জু ঘোষ চলে যান কলকাতা। সেখানে তাপস পাল, চিরঞ্জীব, রঞ্জিত মল্লিক সহ সমস্ত প্রথম সারির নায়কদের সাথে জুটি বেঁধে একের পর এক তৈরী করতে থাকেন সিনেমা এবং সবগুলিই হিট। পশ্চিমবঙ্গেও সেই একই, বয়স ও নবাগতদের আগমনে জীবনের নিয়মে অঞ্জু ঘোষের চাহিদা কমতে থাকে। অঞ্জু ঘোষ শুরু করেন তার জীবনের প্রথম শিল্পী হিসেবে যে যাত্রা শুরু হয়, সেই যাত্রাপালা। যাত্রাপালাতেও তিনি সাফল্য পান প্রচুর। এরপরে বর্তমানে বয়সের কারণে তিনি যাত্রাপালাতে নায়িকার চরিত্র না পেলেও, মাসি পিসি ও মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন কিংবদন্তী এই শিল্পী - বিশ্ব ভারকী নামক একটি যাত্রাপালা দলের সাথে।
অঞ্জু ঘোষের বিয়ে সংক্রান্ত গুজব থাকলেও তিনি সেভাবে সংসারী হননি কখনও। তার প্রথম বিয়ের কথা প্রচারিত হয় চিত্র পরিচালক এফ কবীরের সাথে, যিনি তাকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। কিন্তু, পরের দিনই অঞ্জু ঘোষ তার সেই বিয়ে অস্বীকার করেন। সেই সময় প্রিন্ট মিজিয়া সহ সব মিডিয়াত্ই একটি চাঞ্চল্যকর খবর ছিল এটি। এরপরে জনশ্রুত আছে যে, অঞ্জু ঘোষের সাথে সত্যিকারের প্রেম হয় চিত্রনায়ক মাহমুদ কলির। ছবি পাড়ায় সবাই বিষয়টি জানত। এক্ষেত্রে মাহমুদ কলিই অঞ্জুর সাথে বেঈমানী করেন। তারপরে বিভিন্নরকম গুজবের খবর পাওয়া গেলেও, নিশ্চিত কোন বিয়ের খবর অঞ্জু ঘোষের পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি অঞ্চলের স্থানীয় পত্রিকায় অঞ্জু ঘেষের ১৪টি বিয়ের খবর ছাপানো হয়। অঞ্জু ঘোষের বোন জামাই বাংলাদেশে আসলে সেটি জানেন ও পত্রিকাটি নিয়ে যান। গুনী নায়িকা অঞ্জু ঘোষ মনে তীব্র কষ্ট পান ও বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে এর প্রতিবাদ জানান ও বলেন - আমি আপনাদের ভালবাসি।
- অঞ্জু ঘোষের আমাদের প্রতি ভালবাসা ও আমাদের অঞ্জু ঘোষের প্রতি ভালবাসার মধ্য দিয়েই চিরজীবন এই গুনি শিল্পী বেঁচে থাকবেন জনগনের হৃদয়ে, বেদের মেয়ে জোৎস্না হিসেবে।
পরিশিষ্ট - ক
বাংলাদেশে অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম -
সওদাগর, নরম গরম, আবে হায়াত, প্রাণ সজনী, ধন দৌলত, রক্তের বন্দী, আওলাদ, মর্যাদা, চন্দনা ডাকু , নিয়ত, দায়ী কে?, কুসুমপুরের কদম আলী, অবরোধ, রাজ সিংহাসন, পদ্মাবতী, রাই বিনোদিনী, সোনাই বন্ধু, বেদের মেয়ে জোছনা, আয়না বিবির পালা, বড় ভালো লোক ছিল, আশা নিরাশা, শিকার, রঙ্গীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, মালা বদল, চোর ডাকাত পুলিশ, আশীর্বাদ, শঙ্খমালা, আদেশ, আয়না বিবির পালা, এই নিয়ে সংসার, গাড়িয়াল ভাই, প্রেম যমুনা, ইত্যাদি....
পরিশিষ্ট - খ
কলকাতায় -
১৯৯১ - বেদের মেয়ে জোৎস্না, ১৯৯২ - বেদেনীর প্রেম, ১৯৯৩ - রাজার মেয়ে পারুল, ১৯৯৫ -কুমারী মা, ১৯৯৬ - প্রাণ সজনী, ১৯৯৭ - আদরের বোন, ১৯৯৮ -প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ১৯৯৯ - কাঞ্চনমালা, কালি আমার মা, ২০০০ - এই ঘর এই সংসার, প্রানের চেয়ে প্রিয়, দিদি আমার মা, গরীবের সংসার, ত্রিশূল, ২০০২ - স্ত্রীর মর্যাদা ইত্যাদি...
লেখার পেছনের কথা -
১৯৯৬ সালে দেশ ত্যাগের পরে অঞ্জু ঘোষ, দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পরে গত অক্টোবর, ২০১৬ সালে দেশে আসেন গোপনে। এই কথাটি বলবার পরে দেখা যায়, অনেক মানুষই জানেন না যে, অঞ্জু ঘোষ দেশে ছিলেন না। এই সংক্রান্ত আরও দুই একটি তথ্য জানতে উইকিতে সার্চ দিয়েও সেরকম তথ্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন ব্লগে ও ইন্টারনেট সাইট থেকে এই নায়িকা সম্মন্ধে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য, এক স্থানে করাটাই ছিল মুল উদ্দেশ্য। সেটিই এই লেখা। তাই, বলা যায় - অঞ্জু ঘোষ সম্মন্ধে এই লেখার চেয়ে বেশী তথ্য, অন্য কোন নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে নেই। শিল্পীর অনেক কিছুই পছন্দ না হতে পারে, সমালোচনা থাকবেই, কিন্তু দিনশেষে রেকর্ডের খাতাই কথা বলবে। তাই, গুনী এই শিল্পীর জন্য রইল ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৪:৩৫