১৯৮৩ /৮৪ সালের দিকে
বিবিসি বাংলা থেকে একটি খবর প্রচারিত হয় -
- ববি নামক একটি কুকুরের মৃত্যুর কারণে, কুড়িগ্রাম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নামক একটি স্কুল আধাবেলা ছুটি ঘোষনা করে।
স্কুলের হেডমাষ্টারের পছন্দের কুকুর ছিল ববি, পোষা বলছি না। হেডস্যার এলাকায় সবারই স্যার। পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দুর থেকে এই প্রাইভেট স্কুলে ছাত্রীরা পড়তে আসত, পথিমধ্যে গভ: গার্লস স্কুল সহ আরও কিছু স্কুল পেরিয়ে। এই মানুষটি আজীবন খেঁটে গেছেন স্কুলের পেছনে। যতদিন তার শরীর চলেছে, তার সার্ভিস বর্ধিত করা হয়েছে।
উজ্জল ফর্সা এই মানুষটির উচ্চতা ছিল ছয় ফুটের কাছাকাছি। খাড়া নাক। তাকে রিক্সায় উঠতে কেউ সেভাবে দেখেনি। পুরো শহরে যেখানেই যেতেন, হেঁটেই যেতেন। পরনে সবসময় ধবধবে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবী। কথা বলতেন অসম্ভব আস্তে। তাকে কখনই কেউ রাগ করতে দেখে নাই, কিন্তু তাকে ভয় পেত না, এমন ছাত্র ছাত্রী নেই। হেডস্যার হলেও তিনি নাইন টেনের ইংলিশ ক্লাস নিতেন, কোন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনি যেতেন সেই ক্লাসে। এমনকি তিনি ইসলাম ধর্ম ক্লাস পর্য্যন্ত নিয়েছিলেন। নাম তার শ্রী প্রানবল্লভ করঞ্জাই (স্বর্গীয়)
স্কুলের নিয়ম কানুন ছিল অসম্ভব কড়া পড়াশুনার ব্যপারে। স্কুলই ছিল স্যারের প্রাণ। কোন একটি অজ্ঞাত কারণে তিনি চিরকুমার ছিলেন। স্কুলে অহেতুক ঐচ্ছিক ছুটি তিনি দিতে চাইতেন না। ক্লাস, স্কুলের রেজাল্ট, বিল্ডিং, ফুলের বাগান, ঘাস, গাছপালা সবই ছিল তার নখদর্পনে।
হেডস্যার কখনই পশুপ্রেমী ছিলেন না। স্কুলে একটি কুকুর বাচ্চা প্রসব করেছিল। একটু বড় হবার পরে চলে যায়। কিন্তু একটি বাচ্চা কোনভাবে রয়ে যায় স্কুলে। একদিন বাচ্চাটিকে স্যার, তার সাথে থাকা বিস্কিট দিয়েছিলেন খেতে। পরের দিন হেডস্যার স্কুলে আসার পরে, কুকুরের বাচ্চাটি তার পিছে পিছে আসে। তিনি বিপদেই পড়েন। আবার বিস্কিট। এভাবে কয়েকদিন দেবার পরে স্কুলে জানাজানি হওয়াতে, ধীরে ধীরে শিক্ষক শিক্ষিকা ও মেয়েরাও কুকুরের বাচ্চাটিকে খাওয়াতে শুরু করে। এটি ছিল হেডস্যারের প্রতি ভালবাসা থেকে। ধীরে ধীরে কুকুরটি বড় হতে থাকে। হেডস্যার নাম দিলেন ববি। তিনি কখনও কোলে নেয়া বা শরীরে হাত দিয়ে আদর করতেন না।
ববি কি করে যে সময় বুঝত? আশ্চর্য্যের ব্যপার। বাচ্চা অবস্থাতেই, হেডস্যারের স্কুলে আসবার সময় হলে, ববি যেয়ে গেটের কাছে দাড়াত। স্যারকে এসকর্ট করে রুমে নিয়ে আসত ও ছুটির সময় এগিয়ে দিয়ে আসত গেট পর্য্যন্ত। স্কুলে চোর ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল ববির কারণে। ববির চিৎকার আর নাইট গার্ড দু:সাহসী কাচু ভাইয়ের কাস্তে হাতে ভয়ংকর রুপ। ববি কিছুটা বড় হলে হেডস্যারের বাসার বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকত। স্কুলের গেটের পরিবর্তে ববি বাসা থেকে স্যারকে নিয়ে আসত ও পৌঁছে দিয়ে আসত। সাদা ও লালচে কালোর ছোপ ছোপ রংয়ের ববি, সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবী পরিহিত হেডস্যারের পেছনে হেডস্যারের মতই ভাব নিয়ে হাঁটছে - একটি সাধারন দৃশ্য। হেডস্যারের পিএস হয়ে উঠল ববি। স্কুলের নাড়ি নক্ষত্রের খবর কি করে যে ববি হেডস্যারকে বোঝাত, তা আশ্চর্য্যের একটি বিষয়। মাঝে মাঝে দেখা যেত হেডস্যার চেয়ারে বসে, কিছুটা ঝুকে মনে হয় ববির সাথে কথা বলছেন। যে কোনভাবেই হোক, তিনি ববির কথা বুঝতেন। হেডস্যার একদিন একজন শিক্ষিকাকে প্রয়োজনীয় কথা বলার পরে জিজ্ঞেস করলেন -
- দিদিমনি, আপনারা কি আজ কমনরুমে সিঙ্গারা খেয়েছেন?
- জ্বী স্যার। আপনি কি করে জানলেন?
- আপনারা আজ ববিকে খেতে দেননি। এই দেখুন, সে ঠোঙ্গাটি এনে আমার কাছে কমপ্লেইন করেছে।
সমস্ত শিক্ষিকার লজ্জায় মাথা নত। এরপরে সিদ্ধান্ত হল, স্কুলের আয়া যখনই খাবার কিছু কিনে আনবে, আগে ববিকে দিয়ে তারপরে কমনরুমে আসবে।
একদিন সকালে হেডস্যার স্কুলে আটটা বাজতেই চলে এলেন। সেদিন তিনি পরিপাটি অবস্থায় নেই। তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। এরকম বেশে কেউ স্যারকে কখনই দেখেনি। হেডস্যারের রুমের দেয়াল ঘড়ি সহ আরও কিছু চুরি হয়েছে। চোররা ববিকে বল্লম দিয়ে মেরে ফেলেছে। সকাল আটটা থেকে তিনি ববির দেহের সামনে নিশ্চুপ বসে রইলেন। হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন এসে কুকুরটি নিয়ে গেল এগারোটার দিকে। ববিকে নিয়ে যাবার পরে, জীবনে প্রথমবারের মত এই চিরকুমার মানুষটিকে সবাই দেখল -
- তিনি কাঁদছেন।
- স্কুল শুরু হলেও তিনি তার চেয়ারে বসে রইলেন।
- বারটার দিকে অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। তিনি কখনই একদিন বা একবেলার জন্যও আগে অসুস্থ্য হন নাই।
- টিফিন পিরিয়ডের আগেই তিনি বাসায় চলে গেলেন, জীবনে প্রথমবারের মত স্কুল চলাকালীন সময়ে।
ছাত্রীদের মন এমনিতেই খারাপ ববির জন্য। স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা কাঁদছিল। শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও চোখ ভেজা। স্কুলের নাইট গার্ডের মরা কান্না। শেষে টিফিন পিরিয়ডের পরে -
- "ববির সম্মানে সেদিন প্রথমবারের মত স্কুল ছুটি ঘোষনা করা হল আধাবেলা।"
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৫