রবিনের ডায়েরিঃ সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৬ -
আমি অলৌকিকতা বিশ্বাস করি না। কিন্তু, আজকের ঘটনার কোন ব্যাখ্যা নেই। রাত আটটার দিকে কি মনে করে জানি গেষ্ট রুমের টয়লেটে গেলাম। বেলী ফুলের তীব্র একটি গন্ধ নাকে এসে লাগল। হয়তো বাথরুমে রাখা কোন কাপড় থেকে আসছে ভেবে, ধোয়ার জন্য রাখা কাপড়গুলো শুকে দেখলাম, নেই। মাঝে মাঝেই গন্ধ তীব্র হচ্ছে। বাথরুমে কাপড় বাদে লিকুইড নীল, কাপড় কাঁচা সাবান আছে, সেখানেও নেই। হটাৎ ছোট্ট একটি মোজো কোলার বোতলে সাদা রংয়ের লিকুইড দেখে ভাবলাম সেটি। গন্ধ শুকে দেখলাম স্পিরিট। তাহলে? কোন ধরনের এয়ার ফ্রেশনারও নেই। একটু খটকাই লাগল।
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬ -
হাল্কা, খুবই হাল্কা গন্ধ পেলাম দুই একবার, ভুল হতেই পারে।
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬ -
আজও মনে হয় একবার পেলাম, এরপরে নেই। মনের ভুল কি?
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬
আমি এরপরে আরও দুই দিন এসে হাল্কা গন্ধ পেয়েছি। কিন্তু আজ আবার প্রথমদিনের মত তীব্র সুন্দর বেলি ফুলের গন্ধ। আমার আজ শরীরটা ছমছম করে উঠল। আমি আমার রুমে চলে আসলাম। ছোটবেলায় মিথিলা নামের একটি মেয়ে আমাকে বলেছিল - ভালবাসি। আমরা দুজনেই পড়তাম ক্লাস এইটে তখন। মিথিলা নাইনে ওঠার পরে একটি রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল। মিথিলা খুব বেলী ফুল ভালবাসত। কিন্তু মিথিলা কেন আসবে? গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের একবছরের একটি জুনিয়র মেয়ে লাবনী, নোট নিতে এসে টেবিলে বেলি ফুলের একটি ছোট্ট মালা রেখে গিয়েছিল। তাহলে কি মিথিলা লাবনী দ্বন্দ্ব? দুজনই বেলী ফুল ভালবাসে। আমি ভাবতে চাচ্ছি না।
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৬ -
গত তিনচারদিন আসিনি বাথরুমে। খুব অস্থির লাগছে। আজ আসলাম। হাল্কা গন্ধ পেলাম। আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না।
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬
আজ পাশের বাসার এক মহিলা এসেছেন এই বাসায়। তিনি মাকে বলেছেন, এই বাসাটা তৈরী করবার সময় নাকি দুজন মিস্ত্রি মারা গিয়েছিল। এখানে নাকি অনেক আগের একজন পরহেজগার মহিলার কবর ছিল। বাবা শুনে রাগ হয়েছেন, উড়িয়ে দিয়ে উল্টো রাগারাগি করেছেন। বাবার মত আমারও এসবে কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু, বেলী ফুলের গন্ধে বড্ড ভয় লাগছে। আমরা মাস ছয়েক আগে বাসা বদল করে এদিকে এসেছি, ছোট বোনের কলেজ কাছে জন্য। ব্যপারটি বন্ধু শামীমের সাথে শেয়ার করা দরকার। শামীম পরহেজগার এবং স্বপ্নের অর্থ নিয়ে ও বেশ পড়াশুনা করে।
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬ -
আজ শামীমকে বললাম। শামীম বলল -এরকম ঘটনা নাকি আগেও সে শুনেছে। সেক্ষেত্রে একজনের জীবননাশের হুমকি আছে। আমার খুব অস্থির লাগছে। তারমধ্যে আজও তীব্র গন্ধ পাওয়াতে, আমার সত্যই ভয় লাগতে শুরু করেছে। রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমালাম।
অক্টোবর ২, ২০১৬ -
আজ মাকে বললাম একটু অন্যভাবে, পাশের বাসার ঐ মহিলার ব্যপারে। মা বললেন - যেদিন মহিলা তাকে বলেছিল, তার পরপর দুই দিন নাকি মা একজন মহিলাকে স্বপ্নে দেখেছেন। দুদিনই নাকি দুপুর বেলা ঘুমে। শক্তিশালী প্রেতাত্নারা নাকি দিনেও আসতে পারে। আমি মাকে বললাম -
- এসব কিচ্ছু না। ভয় পেও না।
এই বলে নিজ ঘরে এসে ভাবতে লাগলাম পুরো বিষয়টি নিয়ে।
অক্টোবর ৫, ২০১৬ -
আমি বুঝতে পারছি আমার মধ্যে একটা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এভাবে চললে পাগল হয়ে যাব। আজও হাল্কা গন্ধ পেলাম। তবে, ডাইরি পড়তে গিয়ে আমার একটি বিষয়ে চোখ আটকে গেল। ডায়েরিতে লেখা তারিখগুলোর মধ্যে একটি বিষয় আমার চোখে আসল। প্রতিদিনই হাল্কা গন্ধ পেলেও, প্রথম তীব্র গন্ধ পেয়েছিলাম সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে। এরপরে সেপ্টেম্বরের ২৩ ও ৩০। ঠিক সাত দিন পরপর। সেই হিসেবে আবার তীব্র গন্ধ পাবার কথা অক্টোবরের ৭, অর্থাৎ পরশু দিন। অস্থির লাগছে।
অক্টোবর ৬, ২০১৬
আমি ধর্মীয় আচার পালন না করলেও আস্তিক একজন মানুষ। আমি আজ রাতে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। মেট্রিক পরীক্ষার সময় পড়তাম। ফল পেয়েছিলাম। তবে, মনে সাহস পেতাম, এটিই বড় মনে হত। ঘরের দরজা বন্ধ করে নামাজ পড়লাম। মন শক্ত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই মৃত মিথিলার সুন্দর মুখ, লাবনীর মুখ, আর তার সাথে মায়ের স্বপ্নে দেখা মহিলা। পরহেজগার হওয়াতেই মনে হয় ঘোমটা টানা থাকায় মা মুখটা দেখতে পারেননি। দিনের বেলাও আসে তারা। ঘুম আসছে না, বড্ড অস্থির লাগছে। হে প্রভু, রক্ষা কর মোরে।
রবিনের রাতে ঘুম না হওয়াতে একটু বেলা করেই উঠেছে। হাতের কিছু কাজ সারতে বাইরে গিয়েছিল। দুপুরে ফিরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়েছে খানিকক্ষণ। স্বপ্নে রবিন ফিরে যায় ছোটবেলায়, মিথিলাদের বাসায় -
- রবিন অবাক হয়ে দেখে, মিথিলা আর লাবনী বসে গল্প করছে। কি আশ্চর্য্য!! তার ভালবাসার দুজন মানুষ। মিথিলা চেচিয়ে বলে -
- মা, দেখ রবিন ভাইয়া এসেছে।
খালাম্মা এলেন। খালাম্মাকে দেখে রবিন চমকে ওঠে। খালাম্মা ছিলেন হাসিখুশি মানুষ। উনি এতদুর ঘোমটা টেনেছেন যে মুখই দেখা যাচ্ছে না। রবিনের হটাৎই মনে আসে মায়ের স্বপ্নে দেখা সেই মহিলার কথা। রবিন ভয় পেয়ে - "খালাম্মা আসি" বলে দৌড়াতে শুরু করে, কিন্তু রবিন এগোতে পারছে না কোনভাবেই। পেছনে খালাম্মারুপী সেই মহিলা তার দিকে ছুঁটে আসছেন অর নাকি গলায় বলছেন -
- মিথিলা, লাবনী তোরা রশিটা নিয়ে আয়। অইজ রবিনরে বাইন্ধা কাঁচা মরিচ দিয়ে মজা করে খাব।
মহিলার পায়ের আওয়াজের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে। রবিন বুঝতে পারে, মহিলা এখনই তার ঘাড় মটকে দিবেন। প্রচন্ড ভয পেয়ে রবিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। রবিন দেখে ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে।
ফ্যান সর্বোচ্চ স্পিডে দিয়ে রবিন একটু ধাতস্থ হবার পরে প্রচন্ড পানির পিপাসা অনুভব করে। ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি পান করবার পরেই নাকে তীব্র বেলী ফুলের গন্ধ এসে এক পলক লাগে। আজ অক্টোবরের ৭ তারিখ। রবিনের গা ছমছম করে ওঠে। মনে পড়ে এরা শক্তিশালী প্রেতাত্না, দিনেই আসে। রবিন মন্ত্রমুগ্ধের মত গেষ্ট রুমে ঢুকতেই ফুলের গন্ধের তীব্রতা একটু বেশী মনে হয়। দেখে বাথরুমের দরজা বন্ধ। খুলতে যাবার আগেই রবিন শব্দ শুনে -
- কেউ পানির কল ছেড়েছে।
রবিন দৌড়িয়ে মায়ের ঘরে যেয়ে দেখে মা নেই। মনে আসে, মা দুপুরে খাবার সময় বলছিলেন, ছোট বোনকে নিয়ে নিউ মার্কেটে যাবেন। বাবা অফিসিয়াল ট্যুরে চিটাগং। রবিন তারপরেও মায়ের মোবাইলে ফোন করে নিশ্চিত হয়, মা নিউ মার্কেটে। মায়ের সাথেই ছোট বোন আছে। বাসায় সে আর কাজে সাহায্যকারী ছেলেটা কুদ্দুস। রবিন দ্রুত কুদ্দুসকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, কুদ্দুস ড্রইং রুমের কার্পেটের উপর বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। তাহলে গেষ্ট রুমের টয়লেটে কে? রবিনের শিরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু একটি বয়ে যায়। রবিনের আজ জেদ চেপে যায়। বুকে সাহস নিয়ে রবিন গেষ্ট রুমের দিকে রওনা করে।
গেষ্টরুমে ঢুকেই ভয়ে লাফ দিয়ে পেছাতে গিয়ে, রবিন বিছানায় বসে পড়ে। রবিনের ঠোট কাপছে। বেলী ফুলের তীব্র গন্ধ। বাথরুমের দরজা সামান্য খোলা। সেই খোলা দরজা দিয়ে রবিন দেখে -
- একগাছি চুড়ি পরিহিত একটি হাত পানির কল বন্ধ করল। মহিলার মাথায় ঘোমটা, ঠিক একটু আগে স্বপ্নে দেখা মহিলার মত। রবিন বুঝতে পারে, তার কথা বলা দরকার। নতুবা হার্ট এটাক হয়ে যেতে পারে। রবিন যদিও চেচিয়ে বলে, কিন্তু সেটি ফ্যাসফেসে গলায় উচ্চারিত হয় -
- কে? বাথরুমে কে? বেলী ফুলের গন্ধ কেন?
দরজা ঠেলে মহিলা বের হয়ে আসে। ঘোমটা টেনে দেওয়াতে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। রবিনের স্বর বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরেও রবিনের গলা দিয়ে ক্ষীণস্বরে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ - কে? কে? বেরিয়ে থেমে গেল।
মহিলা হাত দিয়ে ঘোমটা টানতে যেয়ে চুড়ির ঝনঝনে আওয়াজ হয়। সেই আওয়াজ যেন রবিনের বুক ছিদ্র করে ফেলে। রবিন শ্বাস নিতে পারছে না, বুঝতে পারছে সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহুর্তে মহিলা খুবই সুন্দর ও সুরেলা কণ্ঠে বলে -
- ভাইজান, আমার নাম ময়নার মা। বেলী ফুলের গন্ধ ঐ কমোড ধোয়া নতুন হারপিকের। গত তিন সপ্তাহ যাবত আমি প্রতি শুক্রবার আপনাগো বাসার বাথরুম ধুইয়া দেই। ভাইজান বাথরুমে যাইতে পারেন। আসসালামুঅলায়কুম।
রবিন ধাতস্থ হয়ে ভাবে, টয়লেটের এইসব বর্জ্য ধেয়ার জিনিসে কি দরকার বেলী ফুলের গন্ধ দেবার?
- "আরেকটু হলেই তো আজ বেলী ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে, বাসায় আগরবাতির গন্ধ ও ধোঁয়া উঠত!!"
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩১