নারীর ক্ষমতায়নের তত্ত্ব বনাম বেনিয়া স্বার্থ এবং আমাদের বিক্রিত-বিকৃত নতজানু মিডিয়া
পারসোনা সহ তথাকথিত ’এ’ ক্যাটাগরীর পারলারগুলো নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে প্রথমত এ রকম দাবিকে বিনয়ের সঙ্গে খারিজ করতে চাই। কারণ নারীর ক্ষমতায়ন শুধু একটি দৃশ্যমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নয়। একজন কোথাও চাকরির সুযোগ পেলেন। দিনের শেষে নগদ টাকা পেলেন। তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়লো। তাতেই ঐ নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন হয়ে গেল। ব্যাপারটি এতখানি সরল নয়। তা হলে পুঁজিবাদী দুনিয়ার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চলমান যৌনবাণিজ্য এ ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি পেত। কারণ তাতে বিপুল কর্মসংস্থানও হয়। ক্রয় ক্ষমতাও বাড়ে। তারপরও কিন্তু সেটি ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি পায় নি। এর কারণ নারীর ক্ষমতায়ন যেমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া একই সাথে এটি মতাদর্শিক ইস্যুও। বিউটি পারলার যে মতাদর্শের ওপর ভর করে বিকশিত হয়েছে সে মতাদর্শের প্রথম চোখটি মুনাফার চোখ। দ্বিতীয় চোখটি হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের। এ পুরুষতন্ত্র অবশ্যই ধর্মাশ্রিত সনাতন পুরুষতন্ত্র নয়, আধুনিক পুঁজিবাদি পুরুষতন্ত্র। ধর্মাশ্রিত পুরুষতন্ত্রও নারীকে বিষয় নয়, কেবল বস্তু, শরীর হিসেবে বিবেচনা করে। এবং আপদমস্তক ঢাকতে চায়। বন্দী করতে চায়। অপরদিকে পুজিবাদি পুরুষতন্ত্র নারীকে গৃহবন্দী করতে না চাইলেও নারীর অতখানি মুক্তি চায়, যতখানি মুক্তি হলে তার মুনাফা নিশ্চিত হয়। এটিও নারীকে বিষয় নয়, বরং শরীর হিসেবেই বিবেচনা করে। পার্থক্য হচ্ছে সনাতন পুরুষতন্ত্র যেখানে গৃহবন্দী করতে চায় সেখানে পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্র নারী শরীরের পন্যায়নের প্রক্রিয়াকে জারি রাখে। বেগবান করে। নানা ফন্দী-ফিকিরের মাধ্যমে। মৌলিক চাহিদার পরিবর্তে একটি কৃত্রিম অনুভূত চাহিদা তৈরির মাধ্যমে। এ কৃত্রিম চাহিদার মনোজগতটি তৈরি করে মুনাফাবাদি দুনিয়ার সব চেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার গনমাধ্যম, যে গনমাধ্যম আসলে কখনো গনের নয়, মানে জনগনের নয়। বেনিয়া গোষ্ঠীর। সুতরাং পারলার কেন্দ্রীক বিউটি চর্চা সে ফন্দি-ফিকিরেরই অংশ। অতএব গত দুই দশকে আমাদের নাগরিক জীবনে বিকশমান যে বিউটি বানিজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোটি তৈরি হয়েছে তার পুরোটাই পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে। ফলে আমার ব্যক্তিগত প্রথম অনুসিদ্ধান্তটি হচ্ছে চলমান এ বিউটি বাণিজ্যের দৃশ্যমান মালিকানা নারীর হলেও মতাদর্শিক দিক থেকে তারা সবাই ভোগবাদী ও মুনাফাবাদী পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। পারসোনার মালিকও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। সুতরাং পারসোনার বননী শাখায় সংঘটিত ঘটনার পরবর্তী দিনগুলোতে পক্ষ-বিপক্ষের যে মেরুকরণ হয়েছে, বিশেষ করে প্রথম আলো সহ তথাকথিত মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাকে মূলত: একই শ্রেণীতে অবস্থানকারী মুনাফাবাদী মতাদর্শের যুথবদ্ধ প্রচেষ্টা হিসেবে পাঠ করতে চাই। মুনাফাবাদী ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম কোনটি প্রকাশ করবে অথবা করবে না সেটিও তারা নির্ধারণ করে তার সাথে সংশ্লিষ্ট স্বার্থবাদী উপাদানগুলো বিবেচনা করে।
পুরুষতন্ত্র: নারী উদ্যোক্তার শত্র“ ও মিত্র
তার মানে কি যারা পারলার উদ্যোক্তা হিসবে ইতোমধ্যে একটি অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন তারা পুরুষতন্ত্রের শিকার হন না? এ উত্তরটিও নেতিবাচক নয়। তারা বানিজ্য স্বার্থের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্রের ব্যবহার, সৃজন ও পুনসৃজনে যুক্ত থাকলেও তারাও আবার পুরুষতন্ত্রের শিকার হন। নিরবিচ্ছিন্ন টার্গেটও। তার অন্যতম উদাহরণ গত কয়েকদিনে পারসেনায় সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদ কারীদের একটা বড় অংশ কানিজ আলমাসকে তার শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নয়, একটি কর্পোরেট বিউটি হাউজের মালিক হিসেবে নন, বরং রক্তমাংসের নারী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এবং এমন সব মন্তব্য করেছেন যা মূলত সনাতন পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী। এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও বিবেচনা করি না। প্রায় একটানা তিন বছর নারী উদ্যোক্তাদের ওপর একটি গবেষণা কাজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলতে পারি, কানিজ আলমাস কেও পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে লড়তে হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকার জন্য। আবার একই সাথে তার ব্যবসাটাও বিকশিত হয়েছে আরেকটি ভিন্ন ধরনের পুরুষতন্ত্রের ওপর ভর করে। এখানে পুরুষতন্ত্রের সাথে তার/তাদের সম্পর্কটা হচ্ছে শত্র“ ও মিত্রের। আর এ কারণে পারসোনার ঘটনা নিয়ে তার যে অবস্থান, বিশেষ করে ফেইসবুকে স্ট্যাাটাস এবং অন্যান্য জায়গায় যেসব বক্তব্য এসেছে সে সব বক্তব্য শতভাগ কর্পোরেট অস্তিত্বের চিন্তা থেকে উৎসারিত। এখানে তিনি কোনভাবেই নারীর প্রতিনিধি নন, তিনি কেবল ব্যবসায়ী প্রতিনিধি। সুতরাং নারীর ক্ষমতায়ন কেন্দ্রীক যে বক্তব্য এবং শত শত নারী কর্মীদের ভবিষ্যত এর কথা এ সবই সত্য বলে অনুমান করতে দ্বিধা হয়। এবং এ দ্বিধাটা আমাদের স্বাভাবিক প্রতিবাদও।
পত্রিকার যৌথ বিবৃতি ও পারসোনার সনাতন পুরুষতন্ত্রের কাছে ফিরে যাওয়া
শুরুতেই বলেছি, মুনাফাবাদিতা একটি মতলবী ও কৌশলী মতাদর্শ। মুনাফার জন্য এটি মূল্যবোধ ভাঙে, গড়ে আবার পুরাতনের কাছে ফিরে যায়। আজকে বিভিন্ন পত্রিকায় যে যৌথ বিবৃতি এসেছে তাতে মূল ভিকটিম হিসেবে যিদি পারসোনা ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন কোন স্বাক্ষর বা নাম নেই। তার কোন বক্তব্যও নেই। তাতে বক্তব্য দিয়েছেন কানিজ আলমাস। পারসোনার স্বত—বাধিকারী হিসেবে। আর সাক্ষর দিয়েছেন তার স্বামী। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য থেকে যতটুকু জেনেছি তাতে জানি যে তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। আর পারসেনার ভোক্তাদের শ্রেণীগত অবস্থান বিবেচনা করে এমনিতে বলা যায় তিনি লেখাপড়া জানেন। তারপরও বিবৃতি দিয়েছেন তার স্বামী। কেন? উত্তর পুরুষতন্ত্র। এখানে মূলত: আবার ফিরে যাওয়া হয়েছে সনাতন পুরুষতন্ত্রের কাছে। যে মতাদর্শ মনে করে পুরুষ অভিভাবক। কানিজ আলমাস নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও এখানে তিনি তার স্বামীকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন, কারন সংবাদটি দেশ জুড়ে প্রচার হওয়ার পর বিষয়টি চলে গেছে সনাতন পুরুষতন্ত্রের হাতে। যেখানে স্বামীর কথা, পুরুষের কথা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
( যে সব সহযোগী ব্লগার এর সৌজন্য ঘটনাটি সম্পর্কে প্রথম জেনেছি তাদের সকলের প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ক্যামেরা ব্যবহারের প্রাসঙ্গিতা, পারসোনার অবস্থান এর অসারতা এ সব বিষয়ে ইতোমধ্যে অনেক আলাপ হয়েছে বিধায় সে সব প্রসঙ্গ ইচ্ছে করে বাদ দিয়েছি। তবু এ টুকু বলতে চাই, সেবাগ্রহীতা/ভোক্তাকে না জানিয়ে যে কোন ধরনের ক্যমারা ব্যবহার ভোক্তা অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সাংবিধানিক নিশ্চয়তার লঙ্ঘন বলেই মনে করি। এবং সে কারণে এর প্রতিবাদ করি।)