(আমার এই প্রবন্ধটি সাদাত ভাইয়ের এই পোস্ট পড়ে অনুপ্রাণিত হবার ফল স্বরূপ কাজেই এই পোস্টকে সাদাত ভাইয়ের পোস্টের সম্পূরক পোস্ট হিসাবে দেখে নিলে খুশি হব।)
[ইসলাম শুরু হওয়ার পর থেকে কিছু কায়েমি স্বার্থের লোক ও কিছু ধর্মবিদ্বেষী সম্প্রদায় বংশানুক্রমে তাদের বিদ্বেষমূলক প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা অব্যাহতভাবে জারি রেখেছেন। একাজ করতে গিয়ে তারা অনেক বই-পুস্তক পড়েন। তাদের পাঠে কেবল সেসব বস্তুই দেখতে যান যা তাদের বিদ্বেষী প্রোপাগাণ্ডায় সহায়ক উদ্ধৃতি হয়ে কাজ করতে পারে। এজন্য তারা কখনও প্যারা, বাক্য ও বাক্যাংশকে তার আপন অর্থবোধক কাঠামো ও ধারা থেকে সরিয়ে, কেটে-ছেঁটে, নিজেদের কথার সমর্থনে দাঁড় করাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। মূল উৎসে একটি বিষয়ে দশটি তথ্য থাকলে সেগুলো অতিক্রম করে হয়ত কেবল সেই বর্ণনার দিকে মননিবেশ করবেন যেটিকে তারা manipulate করতে পারবেন, কিন্তু (একই উৎসে বর্ণিত) বাকী বর্ণনাগুলোকে কেন গ্রহণ করতে যাননি, কেন বাকী বর্ণনাগুলো তাদের মনঃপুত হয়নি–এর কোন ব্যাখ্যায় যাবেন না। কেননা সে ব্যাখ্যায় গেলে তাদের ‘উপন্যাস’ গড়ে ওঠেনা। এদিক থেকে তাদের সব পাঠ প্রোপাগাণ্ডার অংশ হয়েই থাকে, নিরপেক্ষ কোন অধ্যয়ন-গবেষণা হয় না। যা হয় তা হল তাদের পূর্ব লালনকৃত বিদ্বেষী ধারণার পক্ষে মসলা সঞ্চয়। অর্থাৎ তাদের হলুদ চোখে ইসলামের ফাঁক-ফোকর বের করার বহুবিধ প্রচেষ্টার একাংশ। তারা কখনও কোরআন নিয়েও কথা বলেন এই উদ্দেশ্যে যে তা আল্লাহর বাণী নয়। কিন্তু কোরআনের আয়াতের পটভূমিতে যাবেন না, কোন্ অর্থে সে যুগের মানুষ আয়াতগুলো বুঝেছিল, কোন্ অর্থ সেদিনের বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, এক আয়াতের সাথে অনুরূপ অন্যান্য আয়াতের কী সম্পর্ক, কোথায় তাদের নাসেখ-মানসূখের স্থান, এগুলো দেখাতে যাবেন না। কারণ, তাদের এধরণের যোগ্যতা খুব কমই থাকে, নাই বললেই চলে। তাদের প্রচেষ্টার মধ্যে এও থাকে যে কোরআন পূর্ববর্তী গ্রন্থদ্বয়ের অর্থাৎ তৌরাত ও ইঞ্জিলের নকল কপি!
তাদের প্রোপাগাণ্ডার অন্যতম টার্গেট হল ইসলামের চূড়ান্ত প্রচারক মুহাম্মদ (সাঃ)। তারা তাঁকে খাটো করে দেখাতে চায়। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সময়ে ঘটিত অঘটিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে, সত্য-মিথ্যার তাল-গোল পাকিয়ে, বরং মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে, এক কালের মানুষের যাপিত জীবনাচারের ব্যবহারকৃত পদ্ধতিকে অন্যকালের মানুষের যাপিত আচারের সাথে তুলনা করে নতুন নতুন ‘আবিষ্কার’ বাজারে প্রচার করেন।
এইসব জণ্ডিসখানের (ইসলাম বিদ্বেষী) বংশবদরা ভার্চুয়াল জগতেও তাদের প্র-পিতামহদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জণ্ডিসের চাষাবাদ করে যাচ্ছেন। তাতে আমাদের তরুণ যুব সমাজকে তারা সহজে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হচ্ছে। এই প্রবন্ধ কোন জণ্ডিস খানদের জন্য নয়, এইটি সেই সব মুসলিম তরুণদের জন্য যারা সত্য কী জানতে আগ্রহশীল তাদের জন্য। আজকের আলোচনা ও তেমনি একটি বিষয়–উরিয়ান গোত্রের কিছু লোককে দেয়া চরম শাস্তির ঘটনা। যে ঘটনা দিয়ে তারা মুহাম্মদ সাঃ-কে নিষ্ঠুর, নির্দয়, বর্বর ব্যক্তি হিসাবে প্রচার করতে অন্যতম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।]
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বিষয়টি কয়েকজন উরিয়ানদের নিয়ে।
মদিনাতে উরিয়ান গোত্র থেকে কিছু লোক আসে রাসুল সাঃ এর কাছে এবং তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে, পরে তারা মদিনার আবহাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন তারা রাসুল সাঃ এর কাছে অসুস্থতা থেকে উদ্ধার পেতে উটের দুধের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। রাসুল (সাঃ) তাদের প্রতি সহমর্মী হয়ে তাদেরকে মদিনা থেকে ৬ মাইল দূরে ‘আইর’ এর নিকটবর্তী ‘কুবা’র সংলগ্ন ‘যুল জাদর’ নামক স্থানে, যেখান থেকে আসহাবয়ে সুফফারদের জন্য খাদ্যের যোগান দেয়া হত সেই উটের খামারে তাদের পাঠিয়ে দেন, সেখানে তাদের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। এবং প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে তারা উটের দুধ এবং মূত্র পান করেন। বেশ কিছু দিন পরে তারা সুস্থ-সবল হয়ে উঠে। তারপর একদিন তারা সুযোগ বুঝে চরম বিশ্বাস ঘাতকতা করে- যে রাখাল তাদেরকে রুগ্ন অবস্থায় পরিচর্যা এবং আহার পানির সরবরাহ করে এসেছিল সেই রাখাল ইয়সেরকে বর্বর ভাবে দুচোখ তপ্ত লৌহ শলাকা দিয়ে গেলে দিয়ে হাত পা কেটে তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে চরম তৃষ্ণার কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে হত্যা করে। হত্যা করার পর সকল সদকার উট নিয়ে চম্পট দেয়। যখন এই খবর রাসুলের (সাঃ) এর কাছে পৌঁছে তখন তিনি তাদেরকে ধরে আনার জন্য কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী (سرية كرز بن جابر الفهري) : নেতৃত্বে ২০ জন অশ্বারোহী সহ অভিযান প্রেরণ করেন। প্রেরিত সেনাদল তাদের গ্রেফতার করেন এবং দুপুরের মধ্যে মদিনায় নিয়ে আসেন। রাসুল সাঃ এর আদেশে এদেরকে চরম শাস্তি হিসাবে তারা যেভাবে রাখালকে হত্যা করেছিল, সেই একই ভাবে তাদেরকেও হত্যা করা হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল ৬ষ্ঠ হিজরির শাওয়াল মাসে।
এই ঘটনাটি নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীরা অনেক প্রপগাগাণ্ডা করে থাকেন, যদিও এক্ষেত্রে সংঘটিত বিচারটি ন্যায্যই ছিল। এখানে বিষয়টি বুঝার স্বার্থে সেদিনের সামাজিক নির্মমতার দুই-একটি করুণ ঘটনার উল্লেখ করব ও ইসলাম কীভাবে সেই সামাজিক অবস্থার মোকাবেলা করেছিল তা দেখতে যাব। পরে অবশ্য উরিয়ানদের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসব।
প্রাক ইসলামিক যুগে আরব উপদ্বীপে গোত্রে-গোত্রে হত্যা বিবাদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লেগে থাকত, প্রতিশোধ নেবার ডিগ্রী কোন নৈতিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সীমাবদ্ধতা ছিলনা। যার কারণে এক হত্যার বদলে অনেকগুলো হত্যা ঘটে যেতে পারত। শুধু তাই নয়, সেই দ্বন্দ্ব যুগের পর যুগ ধরে চলত।
অহুদের যুদ্ধের সময় যুদ্ধে মুসলিমদের অনেক শহীদ হয়েছিলেন। মক্কার কাফিররা এই সব শহিদানদের নাক কান লিঙ্গ কেটে বিকৃত করেছিল। বিশেষ করে রাসুল (সাঃ) এর চাচা হামজা (রাঃ) এর পেট ছিঁড়ে কলিজা বের করে ওতবা বিন রাবিয়া’র মেয়ে ও আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ চরম প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মুখে নিয়ে তা চিবিয়েছিল পর্যন্ত। রাসুল (সাঃ) তা দেখে ভয়ানক ভাবে রেগে গিয়ে তাদের প্রতি চরম প্রতিশোধের ওয়াদা করে ফেলেছিলেন। এবং তখন থেকে এই প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করতে সেই সময় এই সমতার আইনের আয়াত নাজিল হয়েছিল-
“আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।” (১৬:১২৬)
শুধু এই আয়াত নয় আরো কয়েক যায়গায় অনুরূপ আয়াত পাওয়া যায়-
“বস্তুতঃ যারা তোমাদের উপর জবর দস্তি করেছে, তোমরা তাদের উপর জবরদস্তি কর, যেমন জবরদস্তি তারা করেছে তোমাদের উপর।” (২:১৯৬)
পাঠকদেরকে মনে রাখতে হবে উপরের আয়াত দ্বারা শুধু প্রকাশ্য যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সৈন্যদের যারা অপরপক্ষ সৈনিক এবং একজন অসামরিক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য একজন অসামরিক ব্যক্তির সহিত অপরাধ করবে তাদের জন্য তা প্রয়োগযোগ্য হবে। কিন্তু যারা পরিচয় গোপন করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে অ-যোদ্ধা নিরীহ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় আইনকে লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অংশ গ্রহণ করে, তাদেরকে ইসলাম যোদ্ধা হিসাবে মূল্যায়ন না করে সন্ত্রাসী হিসাবে বিচার করে থাকে। এদের প্রতি হারাবাহ নামক শাস্তি প্রয়োগ করে থাকে।
আল-কোরআনের সমতার আইন, হারাবাহ/সন্ত্রাসী অপরাধের দণ্ড অনুযায়ী তারা রাখাল ইয়াসাররের প্রতি যা যা করেছিল ঠিক একই ভাবে অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। এই ধরণের শাস্তি তাদের উপর ন্যায্য ছিল এবং যন্ত্রণা দায়ক মৃত্যু দিয়ে তারা সেইটি উপলব্ধি করে গেছে যে যন্ত্রণা দায়ক মৃত্যু দরিদ্র রাখাল উপলব্ধি করেছিল। এই উপলব্ধি করে যাওয়াটি ছিল তাদের প্রাপ্য।
এবারে আবার উরিয়ানদের কথায় আসা যাক। উরিয়ানদের ঘটনার উপর বর্ণিত হাদিস থেকে নিম্ন উল্লেখিত খণ্ড খণ্ড চিত্রগুলোর বর্ণনা পাই-
১। উরিয়ানিয়ান লোকেরা মদিনায় এসেছিল।
২। ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামি রাষ্ট্রের আনুগত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল।
৩। তারা অসুস্থ হয়েছিল।
৪। সুস্থতার জন্য তাদের উটের খামারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
৫। তারা সুস্থ সবল হয়েছিল।
৬। তারা রাখালকে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল।
৭। তারা উটগুলো লুট করে নিয়ে গিয়েছিল।
৮। তাদেরকে ধরতে একদল সৈন্যকে পাঠান হয়েছিল।
৯। তাদেরকে বমাল ধরে আনা হয়।
১০। শাস্তি কার্যকরের প্রত্যক্ষ বর্ণনার চিত্র পাওয়া যায়।
১১। এই হাদিসে অপরাধী কর্তৃক রাখালের চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনা না পাওয়া গেলেও সেই একই রাবী কর্তৃক বর্ণিত অন্য হাদিসে রাখালের চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনা পাওয়া যায়।
আনাস(রা.) হতে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) তাদের চোখ উপড়ে ফেলেন কারণ তারাও রাখালের চোখ উপড়ে ফেলেছিল। [সূত্র: Muslim Book: 16, Chapter: 2, Number: 4137]
ঘটনার ক্রমবিন্যাসকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় ঘটনার শুরু থেকে তাদেরকে লুণ্ঠন করা উট সহ ধরে আনার মধ্যে ২৪ ঘণ্টার কম সময় লেগেছিল।
আমরা যারা এই ঘটনার বিচার করতে বসেছি তাদেরকে অবশ্যই এই একবিংশ শতাব্দীর আলো ঝলমল ‘সভ্য’ দুনিয়ার মানদণ্ডের কথা ভুলে সেই ১৫শত বছর আগের আরব উপদ্বীপের জীবন ধারণের মানদণ্ডে বিষয়টিকে মূল্যায়ন করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না সেই সময়ের বিশ্বের অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থায় সভ্যতা যতটুকু ধারণ করেছিল, তার চেয়ে ১০০০ বছরের পুরানো বুনো আদিম মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল গোটা আরব উপদ্বীপ। সেখানে ছিলনা কোন রাষ্ট্র যন্ত্র, তাই ছিলনা আইনের শাসন, ছিলনা থানা, পুলিশ, হাকিম আদালত, ছিলনা কোন কারা প্রাচীর। তাই তাদের কাছে ছিল মাইট ইজ রাইট নিয়মের অধীনে চরম অনিশ্চয়তায় মধ্য দিয়ে জীবন ধারণ করে যাওয়া।
একথা বলা জরুরি যে অপরাধী ব্যক্তিকে উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে ট্যাক্স-পেয়ারের টাকায় আজীবন দুধ-কলা খাইয়ে জেলে রাখাতে ‘ইনসাফ’ কায়েম হয়ে যায় না। যে ব্যক্তি নির্মমভাবে বলীর শিকার হল, তার কথা ভুলে গিয়ে, অপরাধীর প্রতি সহানুভূতি দেখাতেও সামাজিকভাবে ‘ন্যায়-প্রতিষ্ঠার’ চিত্র প্রস্ফূটিত হয়না।Criminals must be seen to have been punished –এটা সামাজিকভাবে জরুরি যে অপরাধীদেরকে দেখা যাবে যে তারা শাস্তি পেয়েছে। নাস্তিক্যবাদ সমর্থিত আইন কোথাও এখনও অপরাধ কমাতে পারে নি, বরং বাড়িয়েই দিয়েছে।
আজকের দুনিয়ার কায়েমি স্বার্থবাদী সকল ইসলাম বিদ্বেষীদের মত সেদিনও আরব উপদ্বীপের সকল ধর্ম-গোত্র এক হয়ে গিয়েছিল ইসলামকে ধ্বংস করে দিতে। কারণ, ইসলাম কোন প্রথাসিদ্ধ দুনিয়াকে ভুলিয়ে দেওয়া পরলৌকিক মুক্তির নিছক ধর্ম দর্শন ছিলনা। ইসলাম দিয়েছে সকল প্রকার অন্যায় বঞ্চনা আর কুপমুন্ডক্তাময় প্রচলিত কায়েমি স্বার্থকে ধ্বংস করে করে নতুন এক সমাজ রাস্ট্র দুনিয়া গড়ার ঘোষণা। এবং সেই ঘোষণার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ-পরিকর। কাজেই সেই সময়ের কায়েমি স্বার্থে তা প্রচণ্ড আঘাত করে। এবার দেখি কী ছিল ইসলামের সেই বিপ্লবী ঘোষণাগুলো-
১। এক আল্লাহর উপাসনা করতে হবে; তাই তার প্রার্থনা রীতিতে ২য় কোন ব্যক্তির সহযোগিতার প্রয়োজন নেই, এই এক বিপ্লবী ঘোষণায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত ধর্ম ব্যবসায়ীদের মূলে কুঠারোঘাত করে।
২। দুনিয়ার সব মানুষ সমান – এখানে কেউ বড় কেউ ছোট নেই, সবার পরিচয় হবে তার কর্মে তার আমল দ্বারা। তাই জন্ম জন্মান্তরে যে সব মানুষ দাস হয়েছিল তারা মানুষের মর্যাদা লাভ কোন অবস্থায় সেই সময়ে অর্থশালী ব্যবসায়ী ভূস্বামীদের স্বার্থকে চুরমার করে দেয়।
৩। শ্রেণী প্রথা ও বর্ণ প্রথা রহিত করলে অভিজাত আশরাফদের মূলে আঘাত করে।
৪। সুদ প্রথা রহিত করলে ব্যাংকাররাও ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবসা রক্ষা করতে মাঠে নেমে আসে।
৫। মদ খাওয়া নিষেধ করলে মদ ব্যবসায়ীরাও পথে বসে। তারাও তাদের স্বার্থকে রক্ষা করতে অন্যান্যদের সাথে একাট্টা বাঁধে।
৬। চির বঞ্চিত নারী জাতিকে যে অধিকার দেয়া হয়েছিল, তখনকার আরব কেন পৃথিবীর আর কোথাও কেউ এর আগে পরিচিত ছিলনা। তাই এর প্রতিক্রিয়া পুরুষরা যুগ যুগ ধরে তাদের প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে রাজি হয় নাই, তাই তারাও ইসলামের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়েছিল।
৭। আরব উপদ্বীপের অভিশাপ আন্তঃ গোত্রীয় ক্ষুদ্র চিন্তা চেতনাকে ভাংতে ইসলামের সব জাতি গোত্র মিলে এক উম্মাহর ঘোষণা একদিকে গোত্র প্রথাকে ভেংগে চুরমার করে দেয়।
৮। আগে বিভিন্ন নবীর প্রচারিত ধর্মকে খণ্ডিত এবং সাময়িক ধর্ম ঘোষণা করে ইসলামকে আল্লাহ্ প্রেরিত ধর্মের পূর্ণ প্রকাশ বলে ঘোষণা করে, এই ঘোষণার কারণে ইহুদি, খৃষ্টানরা ইসলামকে প্রতিহত করার যুদ্ধে সামিল হয়।
৭। নিষিদ্ধ করা হয় মাইট ইজ রাইট নিয়মের সন্ত্রাসী প্রথা হারাবাহ।
আরবি শব্দ হার্ব মানে যুদ্ধ, আর এই হার্ব থেকে হারাবা আসে, যা দলিয়/গোত্রের একাধিক ব্যক্তি দ্বারা সশস্ত্র ভাবে আক্রমণ করে নিরীহ অসামরিক মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং সম্পদ ধ্বংস করাকে বোঝায়। বুনো সময়ে এই প্রথা ছিল বেশ কিছু মানুষের রোজগারের একমাত্র পন্থা।
মুসলিমদের সাথে প্রথমতঃ মক্কার কুরাইশদের সংঘাত সৃষ্টি হলেও পরে ইসলামের বিঘোষিত নীতির বিপক্ষে গোটা আরব উপদ্বীপের কায়েমি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এক হয়ে ইসলামকে নির্মূল করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। উপরের উল্লেখিত কারণে মুসলিমদেরকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে হিজরি ৫ বছরে ১০ হাজার সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে বসে। সেই সময়ে মুসলিমদের এত জনবল বা অর্থবল কিছুই ছিলনা সেই আক্রমণ মোকাবেলা করার। তখন একমাত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ ছিলনা মুসলিমদের সামনে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা তা ছিলনা। তাই তো সেই সময়ে আক্রমণকে শুধু থামিয়ে দেয়ার জন্য মদিনার উত্তর পাশে অহুদের ময়দানের দিকে গভীর খাল কেটে নেওয়া হয়। যার ফলে সম্মিলিত বাহিনী মুসলিমদেরকে আক্রমণে বাধা পায়।
সেই দীর্ঘ ১ মাস ব্যাপী অবরোধ এবং বানু কুরাইজাদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে অলৌকিক ভাবে মুসলিমরা রক্ষা পেলেও মুসলিমরা অনুধাবন করতে পারে যে – তারা যে মিশন নিয়ে মাঠে নামতে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে সেখান থেকে পিছে হঠে আসার কোন উপায় নাই। শক্তিই তখন জীবন মরণ আর বেঁচে থাকার একমাত্র নিয়ামক পন্থা হয়ে যায়, তখন ডু অর ডাই ছাড়া কোন দর্শন কাজ করেনা! তাছাড়া রাসুল (সাঃ) এর মূল পরিকল্পনা ছিল হাজার হাজার বছর ধরে সদা সর্বদা হানাহানি লিপ্ত মানব সমাজের আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন। তাই রাসুল (সাঃ) বুঝে নিয়েছিলেন বুনো আরবের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়তে হলে ক্ষিপ্রগতিতে ভয়ংকর ভাবে বিপক্ষকে আক্রমণ করে নির্মূল করে দিতে হবে, যাতে করে এই অরাজকতা পেরিয়ে নতুন আইন আর মূল্যবোধের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তা প্রতিষ্ঠা করতে যেন মানব সমাজ বার বার যুদ্ধের মুখে পতিত না হয়। সেই কারণেই বানু কাইনুকা ও বানু নজিরকে ক্ষমা করে দিলেও বানু কুরাইযাকে আর ক্ষমা করা হয় নাই। তাই নজির সৃষ্টিকারী শাস্তি তাদেরকে দেয়া হয়েছিল।
মুসলিম রাষ্ট্রটি বদরের যুদ্ধ থেকে মক্কা অধিকার সময় কাল এক মহা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে যাচ্ছিল। বানু কুরাইজাদের ঘটনা বা উরিয়ানিদের সশস্ত্র বিদ্রোহের ঘটনায় যদি সামান্যতম ভুল ভূমিকা নেয়া হত তাহলে ইসলাম এখন ইতিহাসে পাওয়া যেত কিনা তা এক বিরাট প্রশ্ন বটে।
বানু কুরাইজাদের ঘটনা থেকে উরিয়ানদেরকে চরম শাস্তি দেয়ার ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলনা। বানু কুরাইজাদের ঘটনা থেকে উরিয়ানদের ঘটনার মধ্যবর্তী ৯/১০ মাসের পুরা সময়টি মুসলিম বাহিনী লাগাতার বিভিন্ন শত্রু বাহিনীর হয় আক্রমণ মোকাবেলা বা আগাম আক্রমণের ষড়যন্ত্র জানতে পেরে নিজেরাই প্রতি আক্রমণে নিয়োজিত ছিল। এই সময়ের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রায় ১৬টি অভিযানে যেতে হয়েছিল। তাছাড়া ঐ সময় গোটা মুসলিম সমাজ তার সকল প্রতিবেশী দ্বারা একঘরে হয়ে পড়েছিল। তাই তাদের তখন প্রায় উপোষ করে থাকতে হত, যার সব চেয়ে বেশি ধাক্কা স্বয়ং রাসুল (সাঃ) এর ঘরে এসে লাগে, সেই সময় মদিনার মসজিদ চত্বরে আগত মুসাফির এবং প্রায় ৭০ জন আসহাবে সুফফার অবস্থান ছিল, তাদের প্রতিদিনের খাদ্য সংগ্রহ করা বিরাট এক অসাধ্য সাধন হয়ে পড়েছিল।
উপরের ঘটনার প্রেক্ষিতে বুঝা যায় ঐ সময়ে গোটা মুসলিম সমাজ সম্পূর্ণ যুদ্ধাবস্থায় ছিল। বানু কুরাইজাদেরকে চরম শাস্তি দিয়ে যে ম্যাসেজ সারা আরব উপদ্বীপে পাঠান হয়েছিল, সন্ত্রাসী কায়দায় উরিয়ান গোত্রের লোকদের দ্বারা চরম বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ণভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রের স্নায়ু কেন্দ্রে রাষ্ট্রে শক্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে সশস্ত্র বিদ্রোহ মূলক কাজ সেই ম্যাসেজকে নস্যাৎ করে দিতে পারত। সে কারণে বানু কুরাইযাদের প্রতি আরোপিত শাস্তির চেয়ে একধাপ উপরের চরমতম শাস্তি তাদের প্রাপ্য হয়ে পড়েছিল। এই প্রকার শাস্তি তা নতুন কোন শাস্তি ছিলনা। এই ধরণের সন্ত্রাস প্রতিরোধী প্রচলিত হারাবাহ আইনে অপরাধীদেরকে ভয়ংকর শাস্তি দেয়ার বিধান প্রচলিত ছিল। এবং মুহাম্মদ (সাঃ) সেই শাস্তি তাদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন। যার দ্বারা পুরা আরব উপদ্বীপকে ২য় বারের মত বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল বিশ্বাস ঘাতকতাময় বিদ্রোহকে কোন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হবে না।
কিন্তু এই ঘটনাটির পর পর আল্লাহতালা হারাবাহ অপরাধীদের জন্য আগের শাস্তিকে পরিবর্তন করে নতুন নির্দেশ করে আয়াত নাজিল করেন-
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্ত পদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।” (৫:৩৩)
“কিন্তু যারা তোমাদের গ্রেফতারের পূর্বে তওবা করে; জেনে রাখ, আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়ালু।” (৫:৩৪)
উরিয়ান দ্বারা যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্টতঃ কোরআনে রাজনৈতিক অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে। দেশে বিশৃঙ্খলা এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তি হিসাবে অপরাধীদেরকে আল কোরানের নির্দেশিত পথে শাস্তি দেবার কথা বলা হয়েছে।তাই, কোরআনের পরবর্তী নির্দেশ মত শুধু মাত্র পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র পারে অপরাধীকে নিম্নে উল্লেখিত সাজাগুলো থেকে একটি মাত্র সাজা দিতে: যথা-
১। হত্যা করা (শীরোচ্ছেদ করা) কিংবা
২। শূলীতে চড়ান, কিংবা
৩। হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া, (মানে অপরাধীর ডান হাত কাটলে বাম পা কাটা হবে, এখানে দুই হাত দুই পা এক সাথে কাটার কোন নির্দেশ নাই) কিংবা
৪। দেশ থেকে বহিষ্কার করা।
সব শেষে আমরা দেখতে পাই উরানিয়ানদের প্রদেয় শাস্তি তৎকালীন আইনের সঠিক প্রয়োগ ছিল মাত্র। যা কোন অবস্থায় মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিজের রাগ অনুরাগের ফলস্বরূপ ছিলনা। তাই জণ্ডিস খানদের প্রচারণা শুধু অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। আবার এ কথাও বলে রাখা দরকার যে কায়েমি স্বার্থের ও ধর্মীয় বিদ্বষী প্রপাগান্ডিষ্টদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কোন বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করলেও তা তারা দেখেও দেখেন না। কেননা দেখতে গেলেই তাদের ‘গল্প’ মাঠে মারা যায়।