ব্লগ ও ব্লগার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে থাকা ধারণাটি আংশিক, ক্ষেত্রেবিশেষে একপাক্ষিক। ফলে বাংলা ব্লগের বয়স যাই হোক না কেন তুমুল জনপ্রিয়তার বয়স মাত্র ৩, আর অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠার বয়সটাও ২-এর ঘরে।
ব্লগ অনলাইন জার্নাল। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত ব্লগ থেকে কমিউনিটি ব্লগে রূপান্তর এবং বিস্তারের পর প্রবল জনপ্রিয় হওয়ার শুরু ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ। সে সময়ে অনলাইনে লিখতে পারা, না পারা অধিকাংশই নিজেদেরকে হুট করে ব্লগার পরিচয় দিয়ে গর্বিত হয়েছিল। হুহু করে ব্লগার বেড়ে যাওয়ার সে প্রবণতা অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। এরপর ব্লগারদের বিরুদ্ধে হাওয়াই অপপ্রচারের পর আবার অনেকেই নিজেদের ব্লগার পরিচয়ের দাবিকে রীতিমত অস্বীকারের পর্যায়ে চলে যায়। কুচক্রিমহলের ধারাবাহিক অপপ্রচারের কারণে ব্লগার নামক সম্মানীয় শব্দ ও পরিচয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় জনমানসে। অনেকেই শত্রুজ্ঞান করে ব্লগার শব্দকে, অনেকেই আবার গালি হিসেবেও ব্যবহার করে আনন্দলাভ করে, অনেকেই আবার অশ্রাব্য গালাগালের মাধ্যমে আক্রোশ মেটায়।
বীরোচিত পরিচয় ও শব্দ ব্লগার হুট করে অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে বহুবিধ কারণ হয়ত আছে। তবে প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে ব্লগার পরিচয়ের মর্মার্থ অনুধাবন না করা। এর বাইরে আছে সীমাহীন অপপ্রচার এবং অর্ধশিক্ষিত মানুষের মধ্যকার অসচেতনতা। কারণ সচেতন নয় এমন মানুষজন সামান্য উৎসাহ, স্রোতের অনুকূলে গিয়ে যাকে বা যাদেরকে মাথায় তুলতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে কোন কারণ ছাড়াই অথবা সামান্য ভুল ব্যাখ্যার কারণে পূর্বের অবস্থানের বিপরিতমেরুতেও চলে যেতে পারে। এখানে তাদের মাথার খাটাতে হয় না, যেদিকে স্রোতে ঠিক সেদিকেই নিজেকে সমর্পণ!
২০১৩ সালের গণজাগরণ রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে গণহত্যা চালানো রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, এবং তদীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টির বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ছিল। সে ক্ষোভের প্রকাশ রাজপথে দেখানোর সুযোগ ছিল কম, কারণ সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে তারা ছিল শক্তিশালী অবস্থানে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালত পরবর্তী সময়ে আর কোন প্রকাশ তেরো'র গণজাগরণের আগে হয় নি। মনে হচ্ছিল তাদের সে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব ও শক্তির কারণে মাথানত হয়েছে পুরো দেশের। কিন্তু এ ভয়াবহ বাস্তবতার বাইরে অনলাইনে লেখালেখি ছিল অব্যাহত। সে জায়গায় লিখা হতো, আলোচনা-সমালোচনা হতো, প্রচারণা হতো, যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শিক লোকদের সাথে তুমুল বাক্যযুদ্ধ হতো- সে মাধ্যমই ছিল ব্লগ, খোলাসা করে বললে কমিউনিটি ব্লগ। আর যারা নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে ইন্টারনেট ডাটা কিনে দিনের পর দিন করে যাচ্ছিল তারাই ব্লগার। ব্লগ-ব্লগারদের তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগেও তারা ছিল, জনপ্রিয়তার সময়েও ছিল তারা এবং অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সময়েও তারা ছিল- বদলায় নি একবিন্দুও!
অনেকেই হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন ব্লগে কি কেবল তাই লিখা হতো? উত্তর হচ্ছে- না! ব্লগ বলতে অনলাইন জার্নাল বা ডায়েরি বুঝানো হয়ে থাকে বলে অনলাইনবাসীগণ নিজেদের পছন্দের বিষয়েই লিখত। এর মধ্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রম্য, ফিচার, ভ্রমণকাহিনী, কৌতুক, আড্ডাবাজি, ছবি ধর্মের পক্ষে-বিপক্ষে, রাজনীতি, সংস্কৃতি, নাটক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি সহ ব্যক্তির স্বনির্ধারণী বিষয় থাকত। মোদ্দাকথা, ব্যক্তির লেখনি ইচ্ছায় যা আসত সেটাই লিখা হতো। এখানে কে কী লিখবে, আর কে কী লিখবে না সেটা ছিল ব্যক্তিইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এবং খুব স্বাভাবিকভাবে এখনও তাই আছে!
ব্লগারগণ কর্তৃক ব্লগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে করা লেখালেখিকে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উল্লেখের কারণ ব্লগার শব্দটি প্রান্তিক পর্যায়েও একদা জনপ্রিয় হয়েছিল মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে, এবং একইভাবে অ-জনপ্রিয়ও হয়েছিল একই কারণে; যদিও এ কারণের আবরণে দৃশ্যমান করা হয়েছিল ‘ধর্মের বিরুদ্ধে’ লেখালেখির অভিযোগ নিয়ে অতি-অপপ্রচার।
এটা স্বীকার্য যে, ব্যক্তি হিসেবে কেউ ধার্মিক হোক বা নাই হোক ধর্মের নাম নিয়ে কোন প্রচার-অপপ্রচার চালালে নিজস্ব আচার ভুলে গিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়ায়ই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ব্লগারদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের যৌক্তিকতা এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই দেখে নি। কেউ পড়েও দেখে নি অপপ্রচার চালানোর উপলক্ষ বানানো সে সকল ব্লগ, তবু সবাই ব্লগারদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। এ বাঁকবদলে শরিক হয়েছিল শিক্ষিত সমাজ থেকে শুরু করে অশিক্ষিত সমাজের অনেকেই। এখানে কৌশলি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল দৈনিক আমারদেশ, দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক সংগ্রামের মত পত্রিকাগুলো। আর মাঠে সক্রিয় ছিল হেফাজতে ইসলামের মত ধর্মভিত্তিক একটি সংগঠন।
গণজাগরণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে সকল ব্লগারকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে পুরো আন্দোলনকে টার্গেট করে তারা। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে নিহত হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, ব্লগে যিনি ‘থাবাবাবা’ নামে লিখতেন। এরপর থাবাবাবার নামে আবিষ্কৃত কিছু ওয়ার্ডপ্রেস সাইটের লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে ছাপতে শুরু করে দৈনিক আমারদেশ পত্রিকা, জোরদার হয় ব্লগারবিরোধী অপপ্রচার। ফলে এক সময়কার ব্লগার পরিচয়ধারীদের অনেকেই কে কতটা ধর্ম অনুরক্ত সে প্রতিযোগিতা সামনে চলে আসে। দিন দিন এটা বাড়তে থাকলে হুট করে অনলাইন বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্লগার পরিচয়ধারীরা ভোল পাল্টাতে শুরু করে।
এরই মাঝে আবির্ভূত হয় হেফাজতে ইসলাম নামের ধর্মাশ্রিত একটি গোষ্ঠী। তারা ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ বিরুদ্ধে ঢাকায় লংমার্চ করে। ব্লগ ও ব্লগার সম্পর্কে ধারণা না থাকা এ সংগঠনটি নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা ব্লগ ও ব্লগারদের “বোলোগ ও বলগার” নামে জানত। এবং তাদের অধিকাংশেরই ধারণা ছিল “বোলোগ দিয়ে এন্টারনেট চালিয়ে ইসলাম ধর্ম ও নবী সম্পর্কে কটূক্তি করে”।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে থাকা সমাজের এ অংশ কেবল নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিল তা নয়, তাদের মত দেশের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত অনেকেরই ব্লগ ও ব্লগারদের সম্পর্কে ধারণা ছিল অনুরূপ। ব্লগার মানেই ধর্মবিদ্বেষি এ ধারণা পোক্ত হতে থাকে এদের মধ্যে।
ব্লগে ব্লগাররা অনেক বিষয়েই লিখে থাকেন। একেক জন লেখক একেক বিষয়কে লেখার জন্যে নির্ধারণ করে থাকেন, অথবা একজন একাধিক বিষয়ে লেখালেখিও করে থাকেন। এটা ব্যক্তির একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কবিতা, গল্প থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজনীতি, কিংবা ধর্মের পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা ও সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভরশীল। এখানে লেখার বিষয়নির্ধারণি অগ্রাধিকার সংশ্লিষ্ট লেখকই। লেখক ইচ্ছাস্বাধীনতার প্রয়োগের মাধ্যমে অন্য অনেক বিষয়ের মত ধর্মের পক্ষে অথবা বিপক্ষে লিখতে পারেন। প্রকাশের এ স্বাধীনতা সার্বজনীন এবং জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বলে এখানে বাধা দেওয়ার অধিকার খোদ রাষ্ট্রেরই নেই, বরং প্রকাশস্বাধীনতার এ অধিকার নাগরিক ভোগ করার সম্যক পরিবেশ দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্যভুক্ত। সে হিসেবে একজন লেখকের ইচ্ছাস্বাধীনতা যেমন যেকোনো বিষয়ে লেখার ঠিক একইভাবে পাঠকেরও স্বাধীনতা ও সুযোগ আছে সে লেখাকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করার।
লেখালেখি যেহেতু একজন লেখকের মৌলিক চিন্তার প্রকাশ, যেহেতু সেখানে বিতর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। আর একজন লেখক তাঁর কোন লেখাকেই সর্বশেষ সত্য কিংবা সর্বশেষ মত হিসেবে যেমন ভাবতে ও দাবি করতে পারেন না তেমনিভাবে পাঠকগণও পেয়ে থাকেন আলোচনা-সমালোচনা, মত-প্রতিমত-ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ। এভাবে এক মতের সঙ্গে অন্য মতের সম্মিলন, কিংবা দ্বন্দ্ব যাই হোক না কেন এটা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণের পথ দেখিয়ে দেয়।
খেয়াল করলে দেখা যায় যায়, ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখিই ব্লগারদের কাজ এমন এক ধরনের অতি প্রচার হয়ে যাওয়ার পর থেকে ব্লগাররা ক্রমে অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে থাকেন। এবং এর পর পরই আক্রান্ত হতে থাকেন তারা। প্রকাশ্য রাস্তায়, জনমানবস্থলে, বাসায় ঢুকে চাপাতির আঘাতের মাধ্যমে খুন হন একাধিক ব্লগার-লেখক-প্রকাশক। অভিজিৎ রায়ের মত বরেণ্যে বিজ্ঞান লেখক, অনন্ত বিজয় দাশের মত প্রতিশ্রুতিশীল উজ্জ্বল বিজ্ঞান লেখক-সম্পাদক ধর্মীয় মৌলবাদীদের চাপাতির কোপে নিহত হন। এছাড়াও নিহত হন ওয়াশিকুর বাবু, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (নিলয় নীল)-এর মত তরুণ। নিহত হন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফায়সাল আরেফিন দীপন। হামলার শিকার হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল। লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিম। ঢাকার রাস্তায় খুন হন অনলাইন এক্টিভিস্ট সিলেটের নাজিমুদ্দিন সামাদ।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, প্রতি খুনের পর মিডিয়ায় যখন “ব্লগার খুন” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ-প্রচার হচ্ছিল তখন অনেকেই ব্লগার শব্দের নামে “নাস্তিক” শব্দ উহ্য রেখেই সেভাবেই ভাবছিল। অবস্থা এমন যে নাস্তিক ব্লগার খুন মানেই বুঝি খুনেরও যৌক্তিকতা থেকে যায়? আদতে তেমনই ঘটছে সামাজিক প্রতিরোধ থেকে শুরু করে পুলিশি ব্যবস্থা- সবখানেই ব্লগার খুন মানে খুনির পেছনে ছুটতে মানা!
সাম্প্রতিক সময়ে অন্য এক অপপ্রচার বেশ ডালপালা মেলেছে, ব্লগারেরা ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে নাকি বিদেশ যাওয়ার জন্যে। কিছু শিক্ষিত কপট এর নাম দিয়েছে “পাকা পায়খানার লোভ” বলে। অবাক হয়ে যেতে হয়ে এদের চিন্তার দীনতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা স্রেফ এক “পায়খানা”র মাঝে সীমাবদ্ধ আছে দেখে!
দেশে একের পর এক ব্লগার আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। এ দেশান্তর রীতিমত বাধ্য হয়েই। দেশ ছাড়ার কারণ উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হুমকি, পুলিশ প্রশাসনের অনেকক্ষেত্রে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নসিহত ও বিবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা।
পরবাসে পাড়ি জমানো এসব ব্লগারেরা যদি দেশ না ছাড়ত তাহলে কী হতে পারত তার প্রমাণ অনন্ত বিজয় দাশ। অনন্ত খুন হওয়ার আগে সুইডেন অ্যামবেসি থেকে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। নিলাদ্রি নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে থানায় (পুলিশ স্টেশন) নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু থানার কর্তব্যরত অফিসার জিডি এন্ট্রি না করে বিদেশ চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। নিলয় বিদেশ যেতে পারেন নি, খুন হয়েছেন! নাজিমুদ্দিন সামাদের পরিবার তাঁকে বিদেশ পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সামাদ দেশে থেকেছিলেন বলেই জঙ্গিরা তাঁকে আঘাত করেছে, খুন হয়েছেন প্রকাশ্যে; রাস্তায়। সুতরাং এটাই ত প্রমাণ হয় দেশছাড়া ব্লগার ও দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক ব্লগারেরা প্রকৃতই বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন, ছাড়তে চাচ্ছেন। এখানে কপট, হিংসুকদের পাকা পায়খানার লোভ স্রেফ অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ দলভুক্তদের বাইরে কি কেউ নেই যারা ব্লগার নামে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছে? হ্যাঁ, আছে হয়ত। তবে এটা আমাদের সমাজের মধ্যে থাকা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর একটা চেষ্টা হতে পারে, যা কোনক্রমেই ব্লগার কমিউনিটিকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এ ধরনের সুবিধাবাদী চরিত্রের লোক সমাজের সব পর্যায়েই থাকে বলে একে ব্লগারদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে উদ্দেশ্যমূলক বলা যায়।
সম্প্রতি অনলাইন এক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপ পরবর্তী গুলিতে নিহত হওয়ার পর বিবিসির এক সংবাদে জানা যায়, বাংলাদেশের জীবন ঝুঁকিতে থাকা ব্লগারদের আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সংবাদের পর দেশের ব্লগারবিদ্বেষি শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকজন ব্লগারদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর আরও এক রসদ খুঁজে পেয়েছে। এদের ভাবখানা এমন যে মরলে মরো, তবে বাঁচার জন্যে বিদেশ যেতে হবে কেন? অবস্থা এমন মরেই প্রমাণ করে দেখাতে হবে আসলেই তুমি মৃত্যুঝুঁকিতে ছিলে! অনন্ত, নিলয়েরা প্রমাণ করলেও এরা চায় আরও প্রমাণ; আর এধরনের আরও প্রমাণ মানেই হলো লাশ আর লাশ!
নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দুঃখজনকভাবে খুনিদের ধরার চাইতে সামাদের লেখাগুলো যাচাই করে দেখাকে অগ্রাধিকার ভেবেছেন। একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এমন দায়িত্বকর্তব্যজ্ঞান ভুলে যাওয়ার এ প্রবণতাকে যদি স্বাভাবিক ধরা হয় তবে ব্লগারদের প্রতি দেশের মানুষের মনে অপপ্রচারসৃষ্ট ধারণাকে কি অস্বাভাবিক বলা যাবে?
আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (নিলয় নীল), ফায়সাল আরেফিন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ- এত এত উজ্জ্বল নামের মানুষগুলোকে মেরে ফেলার পর কেবল রাজীব হত্যাকাণ্ডের রায় বিচারিক আদালত থেকে এসেছে। বাকি হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িতরা কবে গ্রেপ্তার হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা সে সম্পর্কে কিছুই নিশ্চিত নয়। হয়ত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার পর বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে, কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ার এ দীর্ঘসূত্রিতা কোনোভাবেই ভবিষ্য অপরাপর হত্যাকাণ্ডগুলোকে আটকাতে পারবে না। যার সবিশেষ প্রমাণ রাজীব হত্যার রায়ের কয়েক মাসের মধ্যে নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ড।
যদি সঠিক সময়ে দ্রুত বিচার হতো, যদি রাষ্ট্র খুনিদের ধরতে এবং এসব খুনকে চিরতরে বন্ধ করতে উদগ্রীব হতো তবেই হয়ত এর রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতো। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই, যেখানে খোদ রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই খুনিদের গ্রেপ্তারকে প্রায়োরিটি না ভেবে খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিটিকেই প্রাথমিক সন্দেহের চোখে দেখছেন!
বর্তমানে সমাজের সকল স্তরেই ব্লগারদের সম্পর্কে এক ধরনের ভ্রান্ত ও একপাক্ষিক ধারণা প্রচলিত। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, ক্ষমতাশালী, ক্ষমতাহীন সকলেই নিজেদের মত করে ব্লগারদের এক ধরনের চিত্র এঁকে রেখেছেন স্ব স্ব মানসপটে। এটা সহসা কাটিয়ে ওঠার মত না বলেই মনে হচ্ছে। এসব ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৎ চিন্তা দ্বারা চালিত না হওয়ায় ব্লগাররা এক ধরনের আস্থা ও বিশ্বাস সংকটে নিপতিত। এ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
কীভাবে বেরিয়ে আসা যায় এটা নিয়ে ভাবতে গেলে বলা যায়, একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের কেউ হয়ত চাইলেই পারবে না, কারণ অনেকক্ষেত্রে তারা লেখা পাঠ সুবিধা থেকে দূরে থাকা জনগোষ্ঠী। শিক্ষিত সমাজ, মিডিয়া, সরকার, প্রশাসন সৎভাবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ, প্রচার না করলে ব্লগারভাবমূর্তি আরও সংকটে পড়বে বলেই আশঙ্কা করি।
এজন্যে শুরুটা করতে হবে সরকার ও প্রশাসন থেকে। সরকার-প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সৎ বিশ্লেষণ করা শুরু হয়ে যায় তখন এর হাল ধরবে শিক্ষিত সমাজ, মিডিয়া। তখন অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত সমাজেও এর প্রভাব পড়বে। তা না হলে একটা সময়ে এটা এক ধরনের জুজু হিসেবেই আবির্ভূত হবে!
লেখক: কবির আহমেদ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১১