'আমার খুব বিপদ। প্লিজ, আমাকে হেল্প করেন।'
'কি ধরণের বিপদ?'
'এখানে বলা যাবে না। চলুন অন্য কোথাও গিয়ে বসি।'
রাত সাড়ে নয়টা।
চারদিকে প্রচুর মানুষ। বিপদের কথা বলার জায়গা এটা নয়। আমি উঠে দাঁড়ালাম। টিএসসি থেকে বেড়িয়ে কলাভবনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মিমি আমার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছে। কথা বলছে না। ওর চোখ মাটির দিকে। মুখ বিষণ্ণ ।
আমরা তখন ডাকসুর সামনে।
মিমি নিচু গলায় বলল,'আপনার কাছে টাকা আছে ? থাকলে প্লিজ, আমাকে কিছু খাবার কিনে দিন।'
কথা শোনে থমকে দাঁড়ালাম।
মিমি আহত গলায় বলল,'গতকাল থেকে আমি না খাওয়া। ও আমাকে মদ ছাড়া কিছু খেতে দেয় নি।'
'ও মানে কে ?'
'একটা ছেলে, যার বাসা থেকে আমি পালিয়ে এসেছি।'
'পালিয়ে এসেছো ! তোমাকে অপহরণ করেছিল নাকি ?'
মিমি কঠিন গলায় বলল, 'না। আমি নিজেই গিয়েছিলাম। সবই বলব। আপনি প্লিজ শাউট করবেন না। আমি চাই না, ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাক।'
'ঠিক আছে শাউট করব না। চল আমার সাথে-।'
'কোথায় ?'
'চানখারপুল যাব। আগে তোমাকে খাইয়ে নিয়ে আসি।'
'না। এতদূর যেতে হবে না-।'
মিমির কথায় কান দিলাম না। দ্রুত একটা রিক্সশা ডেকে ওকে নিয়ে চানখারপুল চলে গেলাম। হাত ধরে রিক্সশা থেকে নামালাম।
মেয়েটা দুদিন ধরে কিছু খায় নি।
ভেবেছিলাম অনেক কিছু খাবে। কিন্তু পারল না। আধখানা নান আর অল্প একটু গ্রিল খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল। আমরা আবার রিক্সশা নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম।
মিমি বলল,'কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।'
'কি ?'
'ঘটনাটা আপনাকে বলতে চাই।'
আমি বাঁধা দিলাম। বললাম, 'ঘটনা বলার জন্য অনেক সময় পাবে। আজ বাদ দাও। পুরো ব্যাপারটা মন থেকে ভুলে যেতে চেষ্টা কর।'
'ভুলে যাব ?'
'হ্যা, ভুলে যাও।'
'দেখুন তো আমার গালে মুখে কোনো আঁচড়ের দাগ আছে কিনা?'
'না। নেই।'
'ভালো করে দেখে বলুন।'
'দেখেই বলছি।'
মিমি মাথা নিচু করে কি যেন ভাবে।
ঘন ঘন কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলি,'রাত বাড়ছে। বাসায় যাবে না ?'
মিমি দ্বিধান্বিত গলায় বলে,'বাসায় ? কীভাবে যাব ? যদি জানতে চায় এই দুদিন কোথায় ছিলাম, কী জবাব দেব ?'
মিমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কি বলব ভেবে পাই না। হঠাৎ করে পুরো ঘটনাটার গুরুত্ব অনুভব করতে পারি। উনিশ বছরের একটা মেয়ে বাসা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। দুই রাত অচেনা একটা ছেলের বাসায় কাটিয়েছে, এখন এসেছে আমার কাছে হেল্প নিতে ?
নিজের গালে কষে একটা থাবড়া দিতে ইচ্ছে করছে।
ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে তো!
মিমির সাথে পরিচয় বছর দুয়েক আগে। মেয়েটার আগুনের মত রূপ। আমার খুব ভালো লাগে। প্রতি রাতে ওকে নিয়ে আমি মনে মনে স্বপ্ন দেখি। গোপনে কবিতা লেখি। মাঝে মাঝে ফোন দেই। মিমি বিরক্ত হয় না। দু চার মিনিট কথা বলে। আমি মিমিকে সুখের স্বপ্ন দেখাই। বুকটা কেটে দেখেতে চাই, ও আমার কত আপন। মিমি হাসি মুখে আমার কথা শুনে যায়। মিমি কি আমাকে ভালোবাসে ? জানি না। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি! একটু আগে মিমি যখন আমাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলল, আমার কী যে ভালো লাগল বলে বোঝানো যাবে না। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে জগতের বাদশা মনে হয়েছিল।
'আপনি আমাদের বাসায় যাবেন?'
'কেন?'
'সবাইকে বলবেন গত দুদিন আমি আপনার সাথে ছিলাম।'
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
কি বলব ভেবে পাই না।
'আমাকে বিয়ে করবেন ?'
'বিয়ে ?'
'হুম।'
মিমি এক বুক আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি প্রসঙ্গ বদল করে জানতে চাই,'তুমি যে ছেলেটার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলে তাকে বিয়ে কর নি কেন ?'
'পালিয়ে যাই নি তো। আমাকে বলেছে ছোট বোনের জন্মদিন। গিয়ে দেখি বাসা খালি।'
'ছেলেটা কে ?'
'আমার ক্লাসমেট। কলেজের বন্ধু।'
আমার খুব রাগ হয়। নির্বোধ মেয়েটার গালে কষে একটা থাবড়া দিতে ইচ্ছে করে।
'করবেন বিয়ে ?'
'না মিমি, তা হয় না।'
'কেন হয় না ? আপনি তো আমাকে খুব ভালোবাসেন। কতবার বলেছেন, আমি চাইলে আপনি নিজের কলিজাটা খুলে হাতে দিয়ে দিবেন ! সাড়া জীবন আমাকে বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দেবেন।'
'হ্যা বলেছি। কিন্তু ওসব হল আবেগের কথা-।'
'আপনি এতদিন মিথ্যে বলেছেন?'
'অহেতু তর্ক করে সময় নষ্ট কর না মিমি। রাত বাড়ছে। বাসায় যাও।'
মিমি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধরা গলায় বলে, 'আপনি আমাকে হেল্প করবেন না?'
'না। তুমি বোকামি করেছো। এর শাস্তি তোমাকে ভোগ করতেই হবে।'
'আমি বোকা?'
'তুমি শুধু বোকা নও, তুমি খুব বাজে একটা মেয়ে। কোথাকার কোন বন্ধু ফোন করে বলল, বাসায় এসো, আর তুমি কিছু না ভেবে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলে-।'
মিমি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল,'আচ্ছা, যাই।'
'কোথায় যাবে?'
'বাসায়।'
'গিয়ে কি বলবে?'
'যা সত্য তাই বলব।'
এতক্ষণ পর আমি আরাম করে একটা সিগারেট ধরালাম। যাক বাবা, আপদ কেটে গেছে।
মাঝরাতে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। আমি জানতে চাই, 'কে?' ওপাশ থেকে মিমির গলা ভেসে আসে।
'কি খবর মিমি?'
'খবর ভালো।'
'বাসায় সব বলেছো?'
'কি বলব?'
'গত দুদিনের কথা !'
মিমি হাসে।
আমি জানতে চাই,'হাসছো কেন?'
মিমি বলে,
'গত দুদিন আমি বাসাতেই ছিলাম। আপনাকে যা যা বলেছি সব বানানো গল্প। আজ আমার উনিশতম জন্মদিন। ইচ্ছে ছিল, এই দিনে খুব পবিত্র মনের একটা ছেলেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নেব-।'
'সব বানানো গল্প ছিল?'
'হ্যা। আপনাকে একটু পরীক্ষা করে দেখলাম, আমার জীবন সঙ্গী হবার যোগ্য কিনা। দেখে হতাশ হয়েছি। সবাই ভদ্রছেলে বলে আপনার খুব প্রশংসা করে। কিন্তু আপনি যে ভদ্রতার মুখোশ পড়া একটা কাপুরুষ-।'
মিমির কথা শেষ হবার আগেই আমি ফোন কেটে দেই।
আমি হেরে গেছি। আমি কি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি? উত্তর নেই জানা!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫০