চলতি বাসের পেছনের সীটে বসে ঢলাঢলি করলেও
মেয়ে দুইটার ঠোঁটে নিকোটিনের দাগ ছিল না,
ছেলে তিনটার কব্জিতে পিতলের ব্রেসলেট কিংবা পকেটে ইয়াবা জাতীয় কোন ড্রাগস ছিল না।
সকলেই দেখতে খুব ভদ্র-সভ্য। অভিজাত পাড়ার বখে যাওয়া কোন ডিজে পার্টির মাল নয়। সবক'টা নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান।
সেই তুলনায় আমাকেই বরং একটু উগ্র দেখাচ্ছিল। ঠোঁটে কড়া নিকোটিনের ছাপ। হাতে পিতলের খাড়ু। বাম কানে পাথুরে পদ্ম।
ওদের পাঁচজনের বিপরীতে আমি একা। আজিমপুর বাস স্টপ থেকে গাড়িতে উঠেছি। গন্তব্য মিরপুর।
দীর্ঘ পথে একা চলাচল করলে আমি সাধারণত পেছনের সীটে বসি।
কানে হেডফোন গুজে গান শুনব, আর বই পড়ব। সময়টা কাজে লেগে যাবে।
তীব্র যানঝটের বিরক্তি আমাকে স্পর্শ করবে না। এই হল প্রশান্তি।
একদম পেছনের সীটে জানলার পাশে গুছিয়ে বাসার আগেই টের পেলাম,
উঠতি-বয়সী তরুণ-তরুণীরা সমস্ত বাস ফাঁকা রেখে হৈ-হল্লা করতে করতে একেবারে পেছনে
আমার ঠিক ওপাশ থেকে গাদাগাদি করে বসতে শুরু করেছে।
অবাক হলাম। ওরা এত পেছনে এসেছে কেন? ওরা কি আমার থেকেও দূরে যাবে?
নীলক্ষেত পাড় হওয়ার আগেই গাড়ি যাত্রীতে ভরে গেল।
ততক্ষণে তরুণ-তরুণীদের পেছনে বসার কারণটাও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।
এরা খুব বিচ্ছিরিভাবে একে অন্যের গায়ের উপর ঢলে পড়েছে। অস্ফুট স্বরে হাসাহাসি, এলোপাথাড়ি হস্ত চালাচালি করছে।
এইসব দৃশ্য দেখে এখনও আমার খুব অস্বস্তি হয়।
দিনে দিনে আমরা আকাশ সংস্কৃতির সভ্য হচ্ছি... ছেলে-মেয়েরা স্বাধীনচেতা হচ্ছে... ছোটখাট জামা পরা মেয়েদের ডেকে নিয়ে পত্রিকাওয়ালা "সাহসী কন্যা" বলে খেতাব দিচ্ছি... তবুও...
একুশ শতকের তীব্র প্রগতির পাদমূলে দাঁড়িয়ে থেকেও কেন যে "পাবলিক-প্লেস"-এ এইটুকু ঢলাঢলি দেখেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলি, কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছিলাম না!
আসাদগেটের কাছে এসে আরও কিছু যাত্রী উঠল গাড়িতে।
সীট নেই, তাই দাঁড়িয়ে আসতে হচ্ছে তাদের।
পেছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক এবং মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বারবার আড়-চোখে পেছনে তাকাচ্ছিলেন।
যুবক-যুবতীরা পাত্তা দিচ্ছিল না। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক একসময় গলা খাঁকারি দিয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, তাতেও ওরা গা করল না।
ঢলাঢলি এবং হস্ত চালাচালি, অস্ফুট হাসির আওয়াজ, খুব চলিতেছে...
আমাদের ঠিক সামনের সীটে বসা ক'জন ভদ্রলোক। তাদেরও অস্বস্তি হচ্ছিল। চোরা-চোখে পেছনে তাকায়।কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পায় না...
অবিকল আমারই মতো একটুখানি পেছনে তাকিয়ে চতুর্গুণ লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের ঊরুসন্ধিতে মাথা গুজে দেওয়ার চেষ্টা করে।
সমস্ত নাটকটা দেখে মেজাজ খানিকটা বিগড়ে গেল। নিজেকে জাফর ইকবাল স্যারের চাইতেও অবলা এক লেখক বলে মনে হল।
আজ যদি তিনটা বইয়ের লেখক না হয়ে, তিনটা পিস্তলের মালিক হতে পারতাম... বদমাইশের বাচ্চাগুলিকে...
কিন্তু নাহ, এইটা হল ভুল চিন্তা। একজন লেখকের কাজ হল নির্বিকার চাহনি ফেলে চারাচরের দৃশ্যগুলি দেখে যাওয়া।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা কুকুর যদি কোন কুকুরীর সাথে সঙ্গম করে, এলাকার ছেলেমেয়েরা লাঠি নিয়ে তেড়ে যাবে... ভ্রুকুটি করে এড়িয়ে যাবে...
কিন্তু একজন লেখক তা করবেন না।
লেখকের চোখের ভাষা হবে সরল... অন্তঃকরণ হবে নিরপেক্ষ...
জাতের লেখকরা কখনো ভ্রুকুটি করে না... পারিপার্শ্বিক ঘটনার উপর নিজের মতামত পেশ করে না...
নিজেকে মোটিভেশন দিলাম। আমাকে আরও বেশি নির্মোহ হতে হবে। আরও বেশি নির্লিপ্ত হতে হবে।
আমার কাজ শুধু দেখে যাওয়া, আর লিখে যাওয়া...
শপথ করলাম, আগামীকাল থেকে জাতের লেখক হব। আজকে, শুধুমাত্র আজকের জন্য নিজের লেখক পরিচয় ভুলে গিয়ে সনাতনী মাতব্বর টাইপ একটা কাজ করব...
শেওড়াপাড়া বাস-স্টপের পাশেই একটা গলির মুখে, রকে বসে কয়েকটা গুণ্ডাপাণ্ডা টাইপ বন্ধু আমার নিয়মিত ধুম্র-সেবন করে।
তাদেরই একজনকে ফোন দিয়ে চড়া গলায় হুংকার দিলাম,"এই শালা ফকিন্নির-ভাতার, তুই কই?"
"রকে।"
"সঙ্গে ঘোড়া আছে?"
"না।"
"টেডার কাছে জিগা ত, ওর পকেটে আছে কিনা?"
"কেন মামা?"
"গেল বসন্তে এক বান্দীর মাইয়্যা টেডার লগে ঝুলাঝুলি কইরা টাকা-পয়সা খসাইয়া আরেকটা সাদা-চামড়ার লগে ভাগছিল, মনে আছে?"
"হ্যা।"
"সুন্দর মত দেখতে যে-ই বান্দীর পুলার সঙ্গে ভাগছিল, তারে মনে হয় পাইয়া গেছি। একেবারে কব্জির মধ্যে পাইয়া গেছি। তোরা ওয়েট কর। আমি এখন তালতলার কাছাকাছি... দশ মিনিটের বেশি লাগব না!"
ফোনে কথা বলতে বলতেই লাল-চোখে একবার ওদিকে চাহনি ফেললাম।
আশপাশের প্রতিটা মানুষের ঘাড়ের রোয়া খাড়া হয়ে গেছে।
আর আমার গা ঘেঁষে বসা যুবক-যুবতীদের চেহারা... জলে ডুবা মরা মানুষের মুখের মতো একেবারেই ফ্যাকাশে,
ছেলে তিনটা, আর মেয়ে দুইটা... নলের মতো সোজা হয়ে বসে আছে। টুঁ-শব্দটিও করছে না।
সকলেরই চোখে মুখে বিপন্ন ভয়ের ছাপ...
আহা, এই মুহূর্তে এদের দিকে যে কেউ তাকালে বলবে,
এদের চাইতে নিষ্পাপ মানুষ জগতে আর একটাও হয় না!
টেডা, সাকি, ফাহাদ এবং আরমান ভাই সহ... সকলেই বাস স্টপে এসে ওঁৎ পেতে ছিল
একেবারে শেষবেলায় এসে সিদ্ধান্ত বদল করলাম। এইগুলা একটাও ঘাঘু পাপী নয়। ক্ষমা করা যায়। ক্ষমা করে দিলাম...
ওদের আমি ঠিকই ক্ষমা করে এসেছি। কিন্তু নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না কিছুতেই।
সত্যিকারের লেখকেরা দূর থেকে জগতে শ্লীল বা অশ্লীল- সব ধরণের ঘটনাপ্রবাহ শুধু দেখে যাবে, আর লেখে যাবে...
অংশ গ্রহণ তো করবেই না, ভালো-মন্দ কোন মন্তব্যও করবে না...
দীর্ঘ ১২ বছর ধরে সাধ্য-সাধনা করেও এখনও মানুষই রয়ে গেলাম, লেখক হতে পারলাম না।
পত্রপত্রিকায় ডজনখানেক গল্প, দুইখানা পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাস ছাপা হবার পরেও নিজের লেখক সত্ত্বাটাকে সম্মান করতে পারলাম না... বরং নিজের ভেতরকার সনাতনী গুণ্ডাটাকে জাগিয়ে তোলবার পায়তারা করছিলাম...
এইটা আমি কেন করলাম?...
দিনে দিনে সকলেই উদার হচ্ছে, আমি হচ্ছি সনাতনী।
কেন?
এই রকম প্রাচীনপন্থী অন্তঃকরণ লইয়া আমি কি করিব নিরঞ্জন? আমি কি কোনকালেই স্মার্ট হইতে পারিব না?
সত্যিকারের লেখক হবার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকাটা কি তাহলে নেহাতই একটা লস প্রজেক্ট? আপাদমস্তক লস প্রজেক্ট?
প্রশ্ন আসে ভুরিভুরি, উত্তর আসে না।
নিরঞ্জন আড়ালে বসে শুধু তামাশা দেখেন, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন না...
আফসোস... গ্রেট আফসোস...
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:০৮