মেয়েটি বলল,'আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখুন। আমি নষ্ট মাল।'
কথার বলার ধরন দেখেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। বললাম, 'খবরদার, আমার সামনে স্ল্যাং শব্দ উচ্চারণ করবে না। আমি স্ল্যাং নিতে পারি না।'
'কেন, আপনি কি ফেরেস্তা? নাকি মক্কা ফেরত আল্লামা?'
আমি কি বলব ভেবে পাই না । মেয়েটা বলল,'এসেছেন সিনেমা করতে। খামাকা এত সাধুগিরি দেখাবেন না। সাধুগিরি আমি নিতে পারি না !'
'মজা নিচ্ছেন?'
'না। মজা দিতে এসেছি-।'
আমি ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত দুইটা। আমরা আছি বান্দরবান। উচাং ভিটা। একটা আইটেম গানের দৃশ্য ধারণ করা হবে। বৃষ্টির কারণে আপাতত শ্যুটিং বন্ধ। আশ্রয় নিয়েছি অস্থায়ী তাবুর নিচে।
আমি একজন সামান্য এডি। বাংলায়, সহকারী পরিচালক। এই বনে জঙ্গলে রাত দুপুরে হঠাৎ বাদলা দেখে পুরনো প্রেমিকার কথা মনে পড়ে গেল। একান্তে ওকে নিয়ে ভাবব ভেবে ডিরেক্টরদের দল ছেড়ে তাবুর একটা প্রান্তে চলে এসেছি। এই সময় এসে জুটল আপদ একটা। মেয়েটার নাম হেলেন। আমাদের আইটেম গানের মূল নায়িকা।
হেলেন বলল,'আপনি এত বোকা কেন?'
'জানি না।'
'আপনি কি সত্যই বোকা? না-কি বোকা মতন অভিনয় করেন?'
'তোমার কি মনে হয়?'
হেলেন উত্তর দেয় না।
হঠাৎ উদাস গলায় বলে,'সবাই আমাকে নিয়ে কত মজা করে। আপনিই করেন না। মাঝে মঝে এমনভাবে তাকান, যেন আমি একটা নর্দমার কীট।'
মনে মনে বললাম,'তুমি আসলে তাই।'
হেলেন বলল,'জানেন, আমি আগে এমন ছিলাম না। যৌনতাকে আমিও এক সময় আপনার মত ভয় পেতাম-।'
ওর কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলাম,'হেলেন, আমি একটু একা থাকতে চাই। তোমার সাথে অন্য কোন দিন গল্প হবে।'
হেলেন ধপ করে জ্বলে উঠল। বলল,'আপনি একটা মূর্খ !'
'হয়ত তাই।'
'আপনি কি জানেন না, কাপড়ের ভেতর প্রতিটা মানুষই নগ্ন?'
'জানি।'
'তাহলে নগ্নতাকে এত ঘৃণা করেন কেন?'
'আমি যদি ঘৃণা করেই থাকি তোমার তাতে কি?'
হেলেন হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। আমি অবাক। মেয়েটা কাঁদছে কেন ? আমি উশখুশ করতে লাগলাম। আড় চোখে আমাদের টীমের অন্যদের দিকে তাকালাম। না, কেউ খেয়াল করছে না। সবাই চা সিগারেটে আড্ডায় মগ্ন।
তাছাড়া হেলেন কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। হঠাৎ মুখ থেকে হাত সরিয়ে ধরা গলায় বলল,'নূর, তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পার নি? নাকি চিনেও না চেনার ভান করছ?'
গলার স্বর শোনে চমকে উঠি। কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। যদিও দশ বছর হয়ে গেছে ওর সাথে দেখা নেই...। আমি ভয়ে ভয়ে হেলেনের দিকে তাকাই। এতদিন একই টীমে থেকেও যার মুখের দিখে ভাল করে তাকাই নি, তারই দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার বুক ধড়ফড় করে। গলা শুকিয়ে যায়। কে এই মেয়ে? দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটা? আমার হারানো প্রেমিকা তানহা?
আমি কাঁপা গলায় বলে উঠি,' তানহা!'
মেয়েটা তখনও কাঁদছে। চোখ ভরা জল নিয়েই সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। সে-ই তানহা। আমার ভাষা হারিয়ে যায়। বোধ শক্তি অচল হয়ে যায়। কিছু না ভেবেই ছুটে গিয়ে তানহাকে বুকে জড়িয়ে ধরি।
তানহা এতটা ভাবতে পারে নি। সে লাজুক স্বরে আপত্তি জানায়,'এই ছাড়। সবাই তাকিয়ে আছে।'
আমি উদাস গলায় বলি,'তবে তাই হোক। দেখুক সবাই।'
আমি তানহাকে নিয়ে ক্ষুদ্র তাঁবুর আড়াল ছেড়ে বাইরে চলে যাই।
বাইরে তখন গভীর রাত। অঝর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। শোঁ-শোঁ শব্দে বইছে ঝড়ো হাওয়া।
তানহা উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল,'সবাই তো জেনে গেল। এখন কি হবে?'
আমি দরাজ গলায় উত্তর দিলাম,'উই মাস্ট লাভ ইচ আদার, ওর ডাই!'
এই ঘটনার ঠিক দুইদিন পর ঢাকা থেকে রিংকু ভাইয়ের ফোন পেলাম।
ফোন রিসিভ করতেই রিংকু ভাই হুংকার দিয়ে বলল,"সিনেমা করতে গেছিস ভালো কথা, কিন্তু এইসব হাবিজাবি করে বেড়াচ্ছিস কেন নিজাম? "
হাবিজাবি কি করলাম, বুঝতে পারি না। রিংকু ভাই ম্লান গলায় বলে,"তোরে ভালো ছেলে বলেই জানতাম। এখন তো উল্টো কথা মনে হচ্ছে!"
"কি কথা ভাই?"
"মনে হচ্ছে তুইও আর পাঁচটা ছেলের মতো সুযোগের অভাবে ভদ্রলোক। এতকাল সুযোগ ছিল না, তাই ভদ্র শান্ত মানুষের লেবাসে ঘুরে বেড়িয়েছিস। যেই একটা আউটডোরে যাওয়ার সুযোগ পেলি, তাও এত বড় বড় আর্টিস্ট থাকতে শেষমেশ একটা সস্তা আইটেম গার্ল এর সঙ্গে..!"
চঠাস করে কেউ যদি কানের উপর হঠাৎ একটা থাবড়া বসিয়ে দিত তবুও এতটা চমকে উঠতাম না। এতটা লজ্জাও পেতাম না।
অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম, রিংকু ভাইকে এই খবরটা কে জানিয়েছে? কতদূর জানিয়ছে? আমি ভুল ভাবছিলাম। আমাদের টিমের কেউ জানায় নি। খবরের কাগজের দুইজন রিপোর্টার এসেছে ছবির উপর নিউজ করতে। তারাই সমস্ত ব্যাপারটাতে ইনিয়েবিনিয়ে রঙ লাগিয়ে পত্রিকায় ছেপে দিয়েছে।
খবরটা পাঠ করে খুব মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু ওদের দুষ দিতে পারি না। হেলেন এখন মন্দ মেয়ে। কেউ বলে আইটেম বোম, কেউ বলে সেক্সবোম।
এতদিন এইসব নিয়ে ভাবী নি। আজ বাধ্য হয়েই ভাবতে বসেছি। আজ থেকে মাত্র দশ বছর আগে, এই তানহা কী ভীষণ মিষ্টি ও নিষ্পাপ একটা মেয়ে ছিল। ক্লাসের বইগুলি বুকের কাছে চেপে ধরে মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে কলেজে আসত। কানের পাশ দিয়ে বন্দুকের গুল্লি চলে গেলেও মুখ তুলে তাকাত না। প্রিয়তম বইগুলির ভাঁজে ময়ূরের পালক গুঁজে রাখত।
দশ টাকার টিফিন দুইজনে ভাগাভাগি করে খেয়েছি, ক্লাশের পড়া বুঝে নেওয়ার অজুহাতে ওর বাসায় গিয়েও কতবার দেখা করেছি। ভালোবাসার কথা কোনদিন মুখ ফুটে কেউ কাউকে বলি নি। এইসব বলার দরকারও ছিল না।
কারণ আমার একে অন্যের হৃদয়ের অক্ষরভরা ভাষাটা খুব ভেতর থেকেই জানতাম।
সেইসব দিন কোথায় ভেসে গেল!
জুয়াড়ি জীবন মানুষকে নিয়ে কত বিচিত্র খেলা যে খেলে, তার হিসেব মিলানো কঠিন। সেদিনের সেই আদুরে কিশোরী তানহা আজকের ডাকসাইটে আইটেম বোম, হেলেন। এই শহরের সবচাইতে নষ্টা মেয়েগুলির একজন।
মাঝেমধ্যে খুব জানতে ইচ্ছে হয়, নিজেকে সে এইভাবে হাঁটেবাজারে বিকিয়ে দিল কেন? ক্ষণেক্ষণে নিজেকে সামলে নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে।
আজকের পর থেকে আবার ভালো কিছু হবে, তানহাকে ঠিক আগের মত শান্তসৌম্য ও মায়াময় জীবন ফিরিয়ে দেব, এই হল আমার প্রার্থনা। শুনেছি মন থেকে চাইলে কোন চাওয়া নাকি বৃথা যায় না। আমিও মন থেকেই চাইছি, খুব করে চাইছি!
জুয়াড়ি জীবন এই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক খেলেছে, এইবার একে নিয়ে আমি জোয়ারে উজানে পাড়ি দেব, এই হল আমার আখেরি শপথ! আপনারা সবাই দোয়া করবেন আমাদের জন্য...!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ২:৩৪