২০১৫ সালের শুরুর দিককার কথা।
সেইসময়ের কিছু পত্রপত্রিকার শিরোনাম..
*বগুড়ায় পেট্রোল বোমায় দগ্ধ একজনের মৃত্যু... গাজীপুরে পেট্রোল বোমায় পোড়ে গেছে ট্রাক চালক...
*রাজধানীর পরীবাগে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। শুক্রবার সকাল সাতটায় এই ঘটনা ঘটে...
*রাজশাহীতে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ ট্রাক হেলপারের মৃত্যু... মধ্যরাতে বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ একজন...
*পেট্রোল বোমায় দগ্ধ আরও ৪ জনের মৃত্যু। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আশঙ্কাজনক আরও ৫ জন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে...
*রাজধানীতে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ নারী সহ ৩ জন...
সেইসময় বাংলাবাজারের একটা প্রকাশনিতে টেক্সচুয়াল এডিটর হিসেবে কাজ করেছি কিছু দিন।
রোজ সকালে মিরপুর থেকে বাংলাবাজারে যাওয়া...কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে রাত্রি এগারোটায় বাড়ি ফেরা..।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে নিজেকেই রান্নার কাজটা করতে হত। রাতে খেয়ে যে অল্পকটা দানাপানি থেকে যেত তাই দিয়ে সকালের নাস্তা করে আবার ছুটে যাওয়া বাংলাবাজার।
এতকিছুর পরেও আপত্তি ছিল না কোন, অনুযোগ করি নি স্রষ্টার কাছে। শুধু প্রার্থনা করেছি, আর কটা দিন বাঁচিয়ে রাখুন প্রভূ.. এখনও আমি খুব বাচ্চা একটা ছেলে। জীবনের আধখানা দূর হাওর তল্লাটে ফেলে এসেছি, বাকি আধখানা কাটিয়ে দিয়েছি পাঠ্যবইয়ে উরুসন্ধিতে চৈতন্য গুজে।
জীবনের রূপ-রস, স্বাদ-আহ্লাদ কিছুই আরহণ করা হয় নি আমার।
প্রিয়তম মেয়েটির সঙ্গে এখনও দেখাই হয় নি আমার। এখনই যদি পেট্রোলে দগ্ধ করে পুড়িয়ে মারিয়ে ফেলতে চাও, তবে বল, আমি বরং কুকুর হব, মানুষ হব না...
সেইসব দিনের কথা ভাবতে বসে এখনো শিউরে উঠছি।
পৈশাচিক এক ভয়ের কাটা আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে তাড়া করে বেড়িয়েছে।
বাসে চড়তে ভয় হত। জানলার পাশে বসতে ভয় হত। আচমকা কোন মানুষের হল্লা শুনলেই ভয়ে শিরদাঁড়ায় কেঁপে উঠল। এই বুঝি দাউদাউ একটা পেট্রোল বোমা এসে চকিতে আমাদে দগ্ধ করে দিয়ে গেল...
নিজের চোখে চলন্ত গাড়িতে বোমা পড়তে দেখেছি। আগুনে পোড়ে যাওয়া মানুষের আহাজারি এবং দহন যন্ত্রণা দেখে ভয়ে নিজের ভেতর সেধিয়ে গেছি।
একাত্তরের জ্বালাও-পোড়াও অগ্নিদগ্ধ গ্রাম দেখি নাই, কিন্তু ২০১৫ দেখেছি। ক্ষমতার লিপ্সায় মানুষ কতটা বর্বর হতে পারে সেই দৃশ্য নিজ চোখে দেখে গোপনে বিবমিষায় কাতরে উঠেছি...
মাঝেমধ্যে এমনও মনে হয়েছে, নষ্ট মানুষে ঠাসা এই নগররাজ্যে থাকব না আর। গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাই। হাল-গিরস্তি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।
কাজ নেই এইসব নৈরাজ্যের ভিড়ে রাজ্যপাট গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু পারি নাই। ভয়ে আধমরা হয়ে, দেড় কোটি মানুষে কিলবিল করতে থাকা এই নগরে এখনো আমি টিকে আছি। আবারও ক্ষমতা বদলের সময় ঘনিয়ে আসছে..
আবারও কাউকে না কাউকে দগ্ধ হয়ে পৈশাচিক নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে শুয়ে শুয়ে পত্রিকার শিরোনাম হতে হবে।
সুতরাং আমাকে এখানেই থাকতে হবে, এভাবেই বাঁচতে হবে, আর আমার মৃত্যুর মধ্য আবারও এই তল্লাটের রাজ-রাজাদের ক্ষমতা বদলের হিরণ্ময় অধ্যায় সূচিত হবে...
কিংবা কে জানে, দয়াময় স্রষ্টা হয়ত এইবারও আমার প্রার্থনা কবুল করে বাঁচিয়ে দেবেন আমায়।
এখনো খুব আনাড়ি একটা ছেলে আমি। প্রিয়তম মেয়েটির সঙ্গে সবেমাত্র দেখা হয়েছে আমার।
ভাগ্যবতী মেয়েটির সঙ্গে এখনো তেমন করে ভাব-ভালোবাসার কথা বলা হয় নি। হাতে হাত রেখে বসা হয় নি তিলেকদণ্ড। তাইজন্যই আমি বাঁচতে চাই..
রাজা হতে চাই না, রাজ্যপাটও চাই না।
প্রিয়তম মেয়েটিকে শুধু ভালোবেসে নিবিঢ় আলিঙ্গণে জড়িয়ে নেওয়ার জন্যে হলেও আমি বেঁচে থাকতে চাই...
এক জীবনের যাবতীর কান্না ও জ্যোৎস্নার সুগন্ধি ঠোঁটে মেখে একফালি চুমোর স্বাদে আপ্লুত হওয়ার জন্যে হলেও আর কটা দিন বেঁচে থাকতে চাই...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ২:১৪