"নায়িকার পিঠ উদাম করে দর্শকদের দেখাচ্ছেন। এক ধরণের যৌন সুড়সুড়ানি দিচ্ছেন। এইটা কি ইসলামে জায়েজ?"
পোড়ামন দুই সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফিকে এই প্রশ্ন কেন করা হল? কারণ তিনি একজন কোরআনে হাফেজ। হাফেজ কেন সিনেমা বানাবেন?- এই প্রশ্ন আমাদের অনেকের ভেতরের জাগতে পারে। বিষয়টা সত্যিই খাপছাড়া!
এই ছবির নায়ক সিয়ামের কাছে প্রশ্ন করা হল,"জীবনের প্রথম ছবিতেই বাজিমাৎ করে ফেলেছেন। ছবিটা কি আপনার আব্বা-আম্মাকে দেখিয়েছেন? তাদের অনুভূতি কি?"
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নায়ক সিয়ামকে একটু যেন থমকে যেতে হয়। দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়। যদিও সিয়ামের জবাবে কোন জড়তা ছিল না। সে সহজ গলায় উত্তর দিল,"এই ছবিটা আমি আমার আম্মাকে দেখাতে চাই না। কেননা, তিনি এইটা সহ্য করতে পারবেন না!"
সিয়ামের উত্তরে শুনে আমাদের আঁৎকে উঠতে হয়। মনে সন্দেহ জাগে, পোড়ামন দুই কি খুব অশ্লীল একটা ছবি? খুব বেশি যৌনতা ঘেঁষা? উত্তর নেই জানা। কেননা, বাংলা সিনেমা আমি খুব বেশি একটা দেখি না। সিনেমার গল্পটা তাই অজানা।
"পোড়ামন-২ সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলফেল নায়িকা শাবনূর!" পত্রিকার পাতায় এই শিরোনাম দেখে অবাক হইনি। পত্রিকাওয়ালারা খামাখাই খবর তৈরি করতে ভালোবাসে।
পোড়ামন-০২ সিনেমার নায়ক হিসেবে সিয়ামকে নেওয়ার আগে আরও তিনজনকে সিলেক্ট করে গ্রুমিং করানো হয়েছে। পরিচালক রায়হান রাফি নিজেই এইটা করিয়েছেন। কিন্তু কেউই তার গল্পের ধার ও ভার অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারছিল না। একে একে তিনজনই বাদ পড়ে।
সিয়াম হলেন এই ছবির সর্বশেষ সংযোজন এবং ছবিটা দেখার পর আমার নিজেরও মনে হল এইটা ছিল পোড়ামন দুই ছবির বেস্ট কালেকশন!
সত্যি বলতে কি, আমরা অনেকেই বিশেষত আমি নিজে, পোড়ামন দুই সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম শুধুমাত্র সিয়ামকে দেখার জন্য। কিন্তু সিয়ামের আবির্ভাবের হয়, গল্পটা শুরু হওয়ার পনের মিনিট পর। তার আগে, ওদের বাচ্চাকালের কিছু ঘটনা দেখানো হয়।
ঘটনাটা অনেকটা এই রকম:
খুব সুন্দর মতো একটা মেয়ে কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক ও বিয়ের গহনা পরে মধ্যরাতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। মেয়েটার গায়ে ম্লান জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে। সুনসান চরাচর। নিশিপাওয়া কুকুর আর কিছু তক্ষককের ডাকাডাকি শুনা যাচ্ছে। এমনই ঘোরলাগা এক পরিবেশে মেয়েটা নেশাচ্ছন্নের মতো হেঁটে হেঁটে মস্ত বড় একটা বট-অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। একহাতে গুটিয়ে রাখা দড়িটার ভাজ খুলে গাছের ডালে বেধে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ে।
পরদিন ভোর হতেই মেয়েটাকে নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়। আদিরসাত্মক গালগল্প ছাড়ায়, কিন্তু সেইগুলা হল গল্পের অবজেক্ট, গল্পের সাবজেক্ট তথা সুজন শাহের বাল্যকালের কিছু ঘটনা এই সময় দেখতে পাই আমরা।
সুজন এবং পরী মক্তবে পড়ে। দেড়ি করে মক্তবে পৌঁছানোর কারণে সুজনকে কানে ধরিয়ে একপায়ে খাড়া করিয়ে রাখা হয়েছে। ওদিকে বিয়ের আগে পেঁটে বাচ্চা বাধিয়ে অল্প বয়সী যে যুবতী কন্যা ফাঁস নিয়েছে তার জানাজা পড়ানো হবে-কি হবে না- তাই নিয়ে মক্তবের আঙিনায় চলছে নানা বাহাছ। তীব্র ছিঃ-চিৎকার!
পোড়ামন ০২ ছবিটার বীজবাণী লুকিয়ে আছে এই বাল্যকালেরই প্রথম পনের মিনিটে। ফাঁস নেওয়া মেয়েটার জানাজা তো হয়ই নি, তাকে গ্রামের গোরস্তানে দাফন করার অনুমিতটাও দেওয়া হয় নি।
এরফলে দেখা যায়, ফজলুর রহমান বাবু ( নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র!) তার মৃত কন্যাকে নিয়ে নদীর চরায় দাফনের ব্যবস্থা করছেন। বিশাল ফ্রেমে.. ড্রোন-ক্যামেরায় ধারণকৃত এই দৃশ্যটি যখন দেখি... দুইপাশের বন-বনানীর প্রেক্ষিতে জনমানব শূন্য এক নদীর চরা... ক্লান্ত ও অপমানিত এক দুঃখী পিতাকে যখন নিজের কন্যার লাশ পাশে নিয়ে হাহাকার করতে দেখি, আমার নিজেরই কেমন কান্না পাচ্ছিল...ইচ্ছে করছিল, ছুটে গিয়ে হতভাগা এক পিতার পাশে দাঁড়াই.. জানাজায় শামিল হই..
এই সময় একটা ম্যাজিকের জন্ম হয়। ফজলুর রহমান বাবু যখন বালুচরে মাটি খুঁড়ে মেয়ের লাশ পাশে নিয়ে জানাজায় দাঁড়ান... কাশবনের আড়াল থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বেড়িয়ে আসে। ভীরু ভীরু পায়ে এগিয়ে এসে বাবুর পাশে দাঁড়ায়। জানাজায় শরিক হয়। ছেলেটা সুজন শাহ। সমস্ত দৃশ্যটা এত সুন্দর করে ধারণ করা হয়েছে, বাবুর কান্নামাখা মুখ আর হৃদয় বিদারক আবহসঙ্গীতের প্রেক্ষিতে সুজনের আগমন দেখে হঠাৎই মনটা আনন্দে ভরে উঠে।
তীব্র স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে গাঢ় আবেগের সাথে ভেবেছি, কেউ না আসুক, একজন ত এসেছে.. হোক সে অল্প বয়সী একটা ছেলে.. একদিন সে অবশ্যই বড় হবে...
নাহ, পোড়ামন-২ কোন বিপ্লবের ছবি নয়। মারমার কাটকাট করা একশন ছবিও নয়। এতে বেহুদা যৌন সুড়সুড়ি পাই নি। খুব উচ্চমার্গীয় গালগল্প দেবার মতোও কিছু পাই নি।
সমস্ত সময় জুড়ে ভরপুর বিনোদন পেয়েছি। ছবির প্রথম অর্ধেক জুড়ে পূজা, বাপ্পারাজ, নাদের চৌধুরীর দুর্দান্ত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েও সিয়ামের কাছে গিয়ে থমকে যেতে হয়েছে। বারবার সুর কেটে যাচ্ছিল। তবে গল্পের প্রতিটা পরতে পরতে পরিচালকের যত্নের চিহ্ন দেখে অনুমান করতে ভুল হয় নি যে, শেষ খেলাটা সিয়ামই খেলবে.. হয়েছেও তাই!
গুরু সালমান শাহের অভিনয় নকল করে সারা গ্রাম মাতিয়ে রাখা সুজন শাহ একদা মধ্যরাতে রিহার্সাল দিতে এসে বারবার ঠেকে যাচ্ছিল...
সিয়ামের চেহারা, এমনকি জামাকাপড় থেকেও হাস্যরসের পালকগুলি খুলে যেতে শুরু করল... গল্পের গতিধারা এইখানে এসে একেবারেই বদলে গেল..
যাত্রাপালার হিরো সুজন শাহ কল্পনার পৃথিবী থেকে মাটি ঘেঁষা মানুষের মানচিত্রে নেমে আসে...
এরপর কি হয়? এরপরেতে কি হইছে?
রাজা হইছে, রানী হইছে। উজির হইছে, জল্লাদ হইছে। খুনাখুনি হইছে...
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটা স্পয়লার দিয়ে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি। সামলানো উচিৎ। পরিচালক রায়হান রাফিকে যখন প্রশ্ন করা হয়,"আপনি হাফেজ মানুষ, সিনেমায় এলেন কেন?" তিনি ভয়াবহ সুন্দর একটা উত্তর দিতে পারতেন।
উত্তরটা তার ছবির শেষ পনের মিনিটে আছে। তিনি উত্তর দেন নি। তিনি হয়ত চাইছিলেন, মানুষ হলে গিয়ে যখন ছবিটা দেখবে, উত্তরটা নিজে থেকেই পেয়ে যাবে।
নায়ক সিয়াম তার আম্মাকে কেন এই ছবি দেখতে নিষেধ করেছেন, তার উত্তরও শেষ পনের মিনিটে এসে পেয়ে গেছি।
নাহ, অশ্লীলতা ছিল না। খুব বেশি রক্তরক্তিও ছিল না। অফুরান ভালোবাসা ছিল, আর কি ছিল? আর..
আগুন ছিল, আগুন..!
এই আগুনে মানুষের জামাকাপড় পুড়বে। নগরে কিংবা দেবালয়ে ভাঙন ধরাবে না!
এই আগুন, ভালোবাসার আগুন। মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মগজ থেকে কিছু বিষাক্ত কীট ও ক্ষতকে বহিষ্কৃত করে শুদ্ধতম আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম পাথেয়, এই আগুন!
ছবিটা দেখার পর আমি, আমার এক বন্ধু সাকিব এবং খুব কাছের এক ছোটভাই আরাফাত প্রিয়- আমরা তিনজনেই বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেছি। ঝিম ধরে বসেছিলাম অনেকটা সময়। ভাবছিলাম..
আর আমি, জীবনে এই প্রথম, সিনেমার শেষের দিকের একটা জায়গায় এসে চিৎকার করে কেঁদেছি উঠেছি, কান্নামাখা গলায় চিৎকার বলতে বাধ্য হয়েছি..
"এই ত আমি চাই! এইবার ঠিক হইছে! রক্ত ঝরা! কুপিয়ে ফালাফালা করে দে...!"
এভাবেই যুগে যুগে আমাদের বুকের ভেতরকার শুভবোধটাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমাদের পিতাগণ শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছেন। আমাদেরও ঝরাতে হবে,
রক্তের বিনিময়ে প্রেমিকার দেহ
কিনে নেই...
প্রেমিকার দেহ থেকে গোলাপ ফুটাই। গোলাপের সুরভি দিয়ে পৃথিবী সাজাই...
আগামীর পৃথিবী, শুদ্ধতম পৃথিবী!
পরিশিষ্ট:
কোটি টাকার প্রশ্ন: আকাশের চাঁদ উঠলে মেয়েদের কি উঠে?
দুই পয়সার উত্তর: আকাশে চাঁদ উঠলে ছেলেমেয়ে বুড়াবুড়ি সকলেরই চাঁদ উঠে। জ্যোৎস্নার ভেতরে সূর্য কিংবা যৈবতি কন্যার দেহ খুঁজতে গিয়ে অতি আতেল আর অতি আহাম্মকেরা ভুল করতে পারে। আমরা কেন ভুল করব? আমরা ত আতেল নই। আহাম্মকও নই। আমরা তো শুধুই মানুষ। সহজ মানুষ। তাই না?
© মুহম্মদ নিজাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ২:০৮