দুটো ঘটনা বলব।সত্য না হলেও অনেকটা সত্যের মতো।এই যেমন ‘মেড ইন চায়না’ না হলেও ‘মেড এ্যাজ চায়না’
ঘটনা এক
শামীম সাহেব তার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসে ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘তোর ছেলে একটা জিনিয়াস।বড় হলে মন্ত্রী না হলেও নিদেনপক্ষে এমপি হবে।’
বন্ধুতো খুশিতে বাকবাকুম।
‘কি করে বুঝলি?’
‘মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে বন্ধুদের সংগে যে ভাষায় কথা বলছিল, ঘেন্নায় প্রায় বমি করে ফেলেছিলাম।’
ঘটনা দুই
চৌধুরী সাহেব মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে আত্নীয়ের বাসা মহাখালী যাবেন।ড্রাইভার গাড়ি আসাদ গেট দিয়ে বের হয়ে মিরপুর রোড থেকে বামে মোড় নিতেই চৌধুরী সাহেব আঁতকে উঠে হাঁক দিলেন, এই ড্রাইভার গাড়ি ঘোরাও।দেখনা এখন অধিবেশন চলছে! অপ্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ নিষেধ।সাথে আমার আণ্ডা-বাচ্চা আছে!
সংসদে বিরোধী দলের যোগদানের পরপরই আমাদের উভয় দলের মাননীয় সংসদ সদস্যরা যে ভাষায় কথা বললেন, তাতে সমগ্র জাতি স্তম্ভিত।আমাদের রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার উদাহরণ খুব কম থাকলেও পারস্পরিক অভদ্র কথা ছোড়াছুড়ির ঘটনাও নতুন নয়।কিন্তু এবারকার ঘটনা সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে।অনেকেই তাই বলাবলি করছেন, এটা কি সংসদীয় ভাষা নাকি প্রাপ্তবয়স্কদের ভাষা।
বলা বাহুল্য, বিরোধীদলীয় নেতার একটা সুনাম আছে তিনি কম কথা বলেন এবং সেই অনুপাতে তার অমার্জিত ভাষা প্রয়োগের উদাহরণও কম।সেদিক বিবেচনায় সরকারদলীয় প্রধানের তীর্যক ভাষার ব্যবহার প্রায় প্রাত্যহিক।বাজারে এই বিষয়ে কৌতুকও প্রচলিত আছে।শেখ হাসিনার কথাই নাকি তার বড় শত্রু।
কিন্তু কৌতুকের সেই বিজয় ঠেকাতেই বুঝি পাপিয়াদের আবির্ভাব।সংসদে তিনি এবং সাথে আরো কয়েকজন যে ভাষা প্রয়োগ করলেন সেটা কল্পনাতীত।অনেকেই বলছেন, সরকারপ্রধানসহ বিশেষ করে আশরাফ, হানিফ, কামরুলদের বিএনপি, খালেদা জিয়া এবং জিয়া সম্পর্কে একের পর এক অব্যাহত শিষ্টাচার বহির্ভূত কটূক্তিতে পাপিয়ারা প্ররোচিত হয়েছে।
এ ব্যাপারে ফোনে কথা হচ্ছিল বিএনপির এক তরুণ নেতৃত্ত্বের সাথে।বলছিলাম যে, বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পরে এবং সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক আচরণের ফলে বিরোধী দলের অবস্থা যখন ভালোর দিকে তখন হঠাৎ করে পাপিয়াদের মাঠে নামানো হলো কেন?
তিনি প্রথমেই পাপিয়ার আচরণকে অশালীন মেনে নিয়ে নিন্দা করেও কিছু বাড়তি প্রশ্ন তোলেন। যেগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে।তিনি বলেন, পাপিয়ার বক্তব্যের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ‘কোলে বসিয়ে ক্ষমতায়’ আনা কথাগুলোর পার্থক্য কতোটুকু? রাজনীতিতে বাজে কথা আমদানিতে কারা ভূমিকা রাখছে বেশি? তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, নিকট অতীতে প্রধানমন্ত্রী, হানিফ, আশরাফ, মতিয়া, সাজেদা, কামরুলসহ আরো অনেকের কিছু অশোভন মন্তব্যের কথা।ওরা একের পর এক খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি নিয়ে রাজনৈতিক কথার বিপরীতে কুরুচিকর কথা বলে চলেছে।পাপিয়ার মতো বিএনপির তৃতীয় কাতারের নেতারা সেখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দেন, কোল বিষয়ক পাপিয়ার বাজে মন্তব্য এবং নিষিদ্ধ পল্লীবিষয়ক কথার অবতারণা কারা করেছে প্রথম? মিডিয়া কেন চুপ মেরে বসে থাকে যখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে খালেদা জিয়ার ’৭১ সালে ক্যান্টনমেন্টে থাকা নিয়ে একের পর এক মিথ্যা বানোয়াট কুরুচিপূর্ণ কথা বলা হয়? হাসিনা, মতিয়া, সাজেদাদের মতো বর্ষীয়ান নেতা, নারী হয়েও নারী সম্পর্কে কি করে এমন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন? খালেদা জিয়ার মুখ থেকে একটিবারের জন্যও তো হাসিনা সম্পর্কে বাজে কোনো মন্তব্য বের হয়নি! অথচ একজন নারীকে এর আগে এতোগুলো পুরুষ এবং লজ্জাজনকভাবে কিছু বিকৃতচারী নারী কর্তৃক সংসদ ভবনে যখন একের পর এক ৭১-এ ক্যান্টমেন্টে থাকা নিয়ে বাজে বাজে মন্তব্য করা হচ্ছিল, তখন খালেদার ‘চুপ বেয়াদব’ কথাটা নিয়ে মিডিয়া হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল।সবাই মিলে খালেদা জিয়াকে যে পরিমাণ লাঞ্ছিত করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে মিডিয়া ছিল অসম্ভব রকম চুপ। এই সেদিনও খালেদা জিয়ার ‘ল্যাংড়া, খোড়া’ মন্তব্য নিয়ে আলোড়ন পড়ে যায়।তার বিপরীতে হাসিনার ’কোলে বসানো’ মন্তব্য কতোটুকু সমালোচিত হয়েছে? খালেদা জিয়ার বক্তব্য যদি হয় দায়িত্বজ্ঞানহীন, তবে হাসিনার করা প্রায় বক্তব্যই হচ্ছে, অশালীন, কুরুচিপূর্ণ, কটাক্ষপূর্ণ। আজ মিডিয়া পাপিয়ার মতো তৃতীয় কাতারের নেত্রীর বক্তব্য নিয়ে দেশ কাপিয়ে ফেলেছে।আওয়ামী লীগের শুধু হাসিনার বক্তব্য নিয়ে এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখালে দেশে ভূমিকম্প হয়ে যাবার কথা।
উক্ত নেতা কথা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি আপত্তিকর বক্তব্যের উদাহরণ টানেন।কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে শেখ মুজিবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দেওয়া আলোচনা সভার ভাষণে মন্তব্য করেন,
‘বিএনপি নেত্রীর জন্ম এদেশে নয়, ভারতে। তার স্বামী জিয়াউর রহমানেরও জন্ম ভারতে, লেখাপড়া করাচিতে আর সেখানেই কমিশন পেয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়েছেন। তাদের বাবা-মায়ের কবর কোথায়? নানা-নানির নাম কী? এদেশের মাটির প্রতি তাদের দরদ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। পরাজিত শক্তির টাকা খেয়ে দালালি করলে দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকে না। জিয়াউর রহমান ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা হলেও উনি (খালেদা জিয়া) তো মুক্তিযুদ্ধেই যাননি।’
এরপরেই তিনি প্রশ্ন রাখেন, শেখ হাসিনা তখন কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন?
ধৈর্য ধরে তার কথা শোনার পর আমি ছোট্ট একটা প্রতিক্রিয়া দেখালাম।বললাম, বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের অশালীন মন্তব্যের প্রতিফলন তো ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে আগেও দিয়েছে।মিডিয়া চুপ থাকলেও বক্তব্যগুলো জনগণ কর্তৃক সমালোচিত হচ্ছে। সাক্ষাত এই নেতিবাচক ফলাফল দেখেও আপনারা কেন তাদের অনুসরণ করছেন।আমার কথাটা মেনে নিয়ে তিনি বললেন, দলীয় ফোরামে আরো অনেক ইতিবাচক মানসিকতা সম্পন্ন নেতারা বিষয়টা দলের শীর্ষ পর্যায়ে তুলবেন যাতে তিলে তিলে তৈরি করা আন্দোলনের ফসল দুই-এক জনের কারণে হাতছাড়া হয়ে না যায়। সাথে সাথে তিনি আমাকেও আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, কারো কারো অপরাধ এভাবে মিডিয়া কর্তৃক চেপে যাওয়া হলে তার একটা সামাজিক প্রতিক্রিয়া আছে।কোন কোন সাংবাদিকের লেখা পড়ে মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের ভাষা এই প্রথম উচ্চারিত হলো।সমসাময়িক সময়ে এ ধরনের অভদ্র ভাষা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে অনেকেই করেছেন।শুধুমাত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপনা করা উচিত নয় যে বাকিগুলো চাপা পড়ে যায়।এতে করে অন্য পক্ষকে আবারো একই কাজে উৎসাহ দেওয়া হবে।
দলকে বাঁচিয়ে কথা না বলে অপেক্ষাকৃত সুন্দর উপস্থাপনার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালাম।আসলেই আমাদের রাজনীতিতে সেদিনের যে ঘটনা সেটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার অংশ।রাজনীতিকে কটাক্ষ এবং অশালীনতার এই চক্র থেকে বের করে আনতে সংবাদপত্রের একটা নিরপেক্ষ, গঠনমূলক ভূমিকা জাতি প্রত্যাশা করে।ঘটনাভিত্তিক সমালোচনার পাশাপাশি রাজনীতিতে চলমান সার্বিক অশালীন পরিবেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এমনিতেই বর্তমানে রাজনীতিতে ভদ্র লোকেরা আসতে চায় না।এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যারাও বা এখনো আছে, দুদিনবাদে তারাও সটকে পড়বে।কিছুদিন আগে খালেদা জিয়া সুশীল সমাজকে রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।কিন্তু তার দলের কতিপয় জুনিয়র নেতাদের যে ব্যবহার সবাই প্রত্যক্ষ করল তাতে সুশীল সমাজের পরিবর্তে দুর্জনদেরই কাছে পাবেন তিনি।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত এরকম অশালীন আপত্তিকর মন্তব্য দিয়ে গেলেও সেগুলো নিয়ে মিডিয়া কিংবা তথাকথিত সুশীল সমাজে অতো বেশি সমালোচনা নেই।কারণ তারা আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সমালোচনা করতে ভয় পান।এর আগেও এদের কাজের সমালোচনা করে অনেকে নাজেহাল হয়েছেন।২০ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কণ্ঠেও সেই একই সুর শোনা গেল।তিনি বলেছেন, সরকারের সমালোচনা করলে তারা খেপে যায়।আ’লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নাও সে কথা স্বীকার করে বলেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ এখন কথা বলা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কারণ সত্য কথা বললে তাকে নানা হয়রানিতে পড়তে হয়।
এই পরিস্থিতিতে থেমে গেলে চলবে না।রাজনীতির নামে এ ধরনের কথা বা আচরণ কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে ইতিবাচক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে খালেদা জিয়ার কথাবার্তার মধ্যে কিছুটা হলেও শালীনতা রয়েছে।কিন্তু দলে পাপিয়াদের মারকুটে অবস্থান চলতে থাকলে সেটা বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না।খালেদা জিয়া আরেকটা রাজনৈতিক উদারতা দেখালেন সমুদ্র বিজয় উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে যেটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একেবারেই বিরল ঘটনা।এর বিপরীতে আবারও প্রধানমন্ত্রী কটাক্ষমূলক বক্তব্য দিলেন এই বলে যে, বিরোধী দলের নেত্রী অন্যের রচিত উপন্যাস গড়গড় করে পড়ে গেলেন।
সে যাই হোক, রাজনীতিতে অব্যাহতভাবে শ্রুতিদূষণ ঘটাতে থাকলে ভবিষ্যতে সমাজে এর কি প্রভাব পড়তে পারে সেটার একটা ফ্যান্টাসি হযে যাক এবার:
পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে, আমদের নেতানেত্রীদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি বর্ণনা কর।প্রশ্ন পড়েই একজন খিক খিক করে হেসে বলে, আমার বয়স আঠার হয়নি।
অন্যজন তো লিখেই বসল, ছিঃ! স্যার কত্তো খারাপ! খাচ্চর খাচ্চর কথা লিখতে বলেছে।
[email protected]
Click This Link