নীল স্লিপিং পিল
ঠক...ঠক...ঠক...।দরজাটা খোল আর এতক্ষণ ধরে ভীতরে কি করছিস? সেই কখন থেকে দরজায় ক্রমাগত ঠোকা দিয়েই যাচ্ছি।অনিক...অনিক...অনিক... তুই কি আমাকে শুনতে পাচ্ছিস? ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।দেখ আজ কিন্তু আমি তোর নামে আর প্রক্সি দিতে পারবোনা বলে দিলাম।
লম্বা পনেরো মিনিট ধরে ডেকেই চলেছে আকাশ।কিন্তু ভীতর থেকে কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছেনা।কিন্তু অনিক তো এরকম করেনা।আজ ওর কি হয়েছে? প্রতিদিন সে আকাশের রুমে গিয়ে ওকে ডেকে তোলে ভার্সিটি তে নিয়ে যেতো।কিন্তু আজ আকাশ প্রথমবারের মতো অনিককে ডাকতে এসেছে।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যে আকাশ টের পেলো কিছু একটা হয়েছে।হলের পাশের রুমের বাঁকী বন্ধুগুলো ইতোমধ্যেই টের পেয়েছে।সবায় অনিকের রুমের দরজার সামনে এসে হাজির।বুঝতে চেষ্টা করছে কেন অনিক সাড়া দিচ্ছেনা।গতকাল রাতে অনিকের ফেসবুক স্ট্যাটাসও ছিলো একটু অন্যরকম।ছোট্ট একটি শব্দ “আলবিদা”।মন্তব্যে সবাই মজা নিয়েছে কিন্তু অনিক কোন প্রতুত্ত্যর দেয়নি।সাকির ভাইকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল-আকাশ দরজাটা ভাঙ্গ।কিছু বুঝে উঠার আগেই কয়েকজন মিলে আচমকা একটা ধাক্কা দিলো দরজায়।কিন্তু দরজাটার কিছুই করতে পারলোনা।এরপর আরো একবার এবং আরো একবার।
ধড়াম করে দরজাটা পড়ে গেলো রুমের ভীতরে।ভীতর থেকে সিগারেটের কটু গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো।আর তারপর আকাশ যা দেখলে তা হয়তো সে কোনদিন ভুলতে পারবেনা।অনিকের বাম হাতে নিঁখুতভাবে ইংরেজির M অক্ষর লিখা।বামহাতে আরো কয়েকবার ব্লেড চালিয়েছে রগগুলো ভালো করে কাঁটার জন্য।হাত থেকে পড়ে তাজা লাল রক্ত জমাট বেঁধেছে মেঝেতে।ডান হাতে একটা বোতল।লেভেলিং করা আছে POISON লিখে।এছাড়া চারদিকে পড়ে রয়েছে প্রচুর সিগারেটের খোসা , স্লিপিং পিলের পাতার খোসা , আর একটা ছোট্ট নোট ,
“আমায় মনে রাখবি তো আকাশ ? বিদায়।”
কয়েকমাস আগে কোন এক সন্ধ্যাবেলা . . . . . .
আকাশঃ আচ্ছা অনিক তুই সবসময় এমন আনমনে হয়ে থাকিস কেন বলতো? বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়েছিস তো আবার কিসের হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছিস? মজা কর , আনন্দ-ফুর্তি কর , বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে একটু আধটু মিশ।
অনিকঃ হা হা হা......।তুই বরং আজ একটা গল্প শোন।হাতে সময় আছে?
আকাশঃ তোর জন্য আমার হাতে অনেক সময় আছে।এখন বল কি গল্প শোনাতে চাস? প্রেমময় না কি বিরহমাখা?
আনিকঃ কোনটায় নয়।তুই বরং এটাকে একটা অলীক কল্পনা বলতে পারিস।তাছাড়া আমাকে দেখে কি কোন দিক থেকে মনে হয় যে আমি প্রেমিক পুরুষ?
আকাশঃ দেখ অনিক! কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।তবে বারবার ঐ একই উক্তি ঝারিস না।“বাবা-মা পাত্তা দেয়না , শুধু টাকাটা সময় মতো দিয়ে দেয়।কিন্তু তুই কি চাস সেটা তারা কখনো জানতে চায়না , বুঝতে চায়না।মরার আগে অন্তত এমন কেউ থাকবে যে তোকে ভালোবাসবে তুই তার কোলে মাথা রেখে মরতে চাস” ইত্যাদি...ইত্যাদি...ইত্যাদি ......।বিরক্তিকর।
অনিক(মুচকি হেসে) বললঃ তুই তো ভালো করে আমাকে আয়ত্ত করেছিস দেখছি।তা সে যাইহোক তুই বলতে পারিস আমরা এতসব কেন করছি?
শুধু নিজেকে সুখে দেখবার জন্য।নিজের অন্তত একটা দিন ভালো করে কাটানোর জন্য।কিন্তু সেই একটা দিন কবে আসবে বলতে পারিস?
আকাশঃ শান্ত হ।দুঃখ-সুখেরই তো এই জীবন।যদি এই জীবনে শুধু সুখই থাকতো তাহলে মানুষ একঘেয়েমীতে পড়ে যেত।আমরা মানুষ এমনই।আমাদের জীবনে কিছু দুঃখ কষ্ট থাকা দরকার।তা না হলে আমরা নিজেরাই সুখে থেকেও সুখী হতে পারতাম না।হয়তো ভালো থাকার জন্য তখন কষ্টকে খুঁজতাম।আর এমন ভাবে বলছিস যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব দুঃখ এবং কষ্ট তোর বুকের ভীতর বাসা বেঁধেছে।সে যাইহোক গল্পটা শোনা।
অনিক কি যেন ভাবলো।তারপর তার সেই কল্পনায় মাখা গল্প বলা শুরু করে দিলো............
সকাল থেকে ঝমঝমে বৃষ্টি পড়ছে।আকাশটা ভীষনরকম ভয়ংকর কালো রুপ ধারণ করেছে।আমি একা বসে আছি রেলস্টেশনে।ছাতা নেই , তাই বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে।এই রেলস্টেশন সেই ব্রিটিশদের দেয়া।শতবছর পরেও এর কোন পরিবর্তন হয়নি।টিকেট কাউন্টার বলে কিছু নেই।নেই কোন টিকেট মাস্টার , নেই কোন যান্ত্রিক কলকব্জা।ক্রসিং হবার ঝামেলাও নেই।ছোট্ট একটি শ্যাওলা ধরা লাল রঙয়ের বিল্ডিং রয়েছে।আর এই বিল্ডিং এর মাথায় বড় বড় অক্ষরে লিখা আছে “নশরতপুর রেলওয়ে স্টেশন”।নামটায় জং ধরে গেছে।স্পষ্ট করে কিছুই বুঝা যায় না।তাছাড়া দুর থেকে কেউ নামটি পড়ার ক্ষমতা রাখে বলে মনে হয়না।আন্তঃনগর ট্রেন এখানে থামেনা।সকালবেলা এবং সন্ধ্যায় দুটো লোকাল ট্রেনকে থামতে দেখা যায় তাও আবার পাঁচ মিনিটের জন্য।তাই যাত্রী সংখ্যা এই ট্রেনে যে কতজন যাতায়াত করে তা সহজেই অনুমেয়।তবে ট্রেনে উঠার পর টিকেট না থাকার কারণে জরিমানা প্রতিদিনই প্রায় গুনতে হয়।অবশ্য আরো দশটা নিত্যদিনের অভ্যাসের মতো এটাও আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।তাছাড়া জীবন চলার পথে কতকিছুর সাথেই না অভ্যাস্ত হতে হয়।এটা আর তেমন কি !
তবে কলেজে যাবার জন্য এছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই।মাত্র দুই স্টেশন পেরোলেই আমার কলেজ।কিন্তু সকাল ন’টার ট্রেন আজ মনে হয় দশটায়ও আসবেনা।তাই শুধু বারবার ঘড়ি দেখছি আর ভাবছি সময়টা কত স্বার্থপর।অন্তত আমার জন্য তো সময়টা কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারতো।নীলচে ধোঁয়াটা ছড়াইতে বড্ড মন চাচ্ছে।হঠাৎ চোখ চলে গেলো প্লাটফর্মের অপরদিকে।ছাতা হাতে আর সাদা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ভদ্র মহিলা।অনেকটা চেনা চেনা লাগছে।তাই ভালো করে দেখার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।মুখটা অস্পষ্ট থেকে ক্রমাগত স্পষ্ট হতে থাকলো।বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো আমি যা দেখছি তা কি সত্য না কি আমার মনের অলীক কল্পনা মাত্র।এই ভাবাভাবি আর কল্পনার মাঝে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম ঠিক তখন ট্রেনটি এসে হাজির।
পরের দিন।আজ বেশ রৌদ্রজ্বল মাখা একটি দিন।আগের দিনের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করছি।কিন্তু একি! আজও ঠিক একই জায়গায় ছাতা হাতে সাদা শাড়ি পড়া একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।আমি এখন নিশ্চিত এটা সেই মহিলা যাকে আমি আগের দিনে স্টেশনে দেখেছিলাম।তবুও মন বলছে হয়না একই চেহারার দুটো মানুষ।কিন্তু উনি এখানে কি করছেন ? কারো জন্য কি অপেক্ষা করছেন ? কিন্তু এই মূহুর্তে এইখানে মানুষ বলতে শুধু আমিই একজন দাঁড়িয়ে আছি।
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ্য করি ছাতা হাতে এবং সাদা শাড়ি পড়া একজন ভদ্র মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে।মুখটা গম্ভীর , আনমনে , অন্যমনস্ক আর কারো জন্য যে তিনি অপেক্ষা করছেন সেটা দেখলেই অনুধাবন করা যায়।
একদিন আর পারলাম না।সাহস করে মহিলাটির কাছে গেলাম।কিন্তু যা দেখলাম তা ছিলো চমকে দেবার মতো।
আমিঃ মৃণালিনী! তুমি ?
মৃণালিনীঃ এত সময় লাগলো আমাকে চিনতে ? আমি প্রতিদিন এই প্লাটফর্মের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি তোমাকে একবার দুর থেকে দেখার জন্য।অপেক্ষা করি তুমি কখন আসবে।
আমিঃ অভিনয় করা ছাড়বে কবে তুমি ? বাচ্চাদের মতো কথা বলছো।নিজেই চলে গিয়েছিলে একদিন আর এখন এসব কথা তোমার মুখে মানায় না।
মৃণালিনীঃ তুমি আমায় ভুল বুঝতেছো অনিক।তোমাকে ছেড়ে যাবার মত সাহস আমি রাখিনা।তুমি তো আমার অস্তিত্ব আর মানুষ নিজের অস্তিত্বকে ধংস করে দিতে পারেনা কখনো অনিক।
আমিঃ সাহস! হা হা হা...।তুমি জানো বিয়ের দিন আমি তোমায় একবার দুর থেকে দেখতে গেছিলাম।হাতে মেহেদি লাগাচ্ছো আর ঠোঁট জুড়ে রাজ্য জয়ের হাসি।বাসায় ফিরে এসেছিলাম।আমি কান্না করিনি বৃষ্টিতে চোখের জল মুছে গিয়েছিলো।প্রমাণ রাখিনি।ছেলে মানুষদের কাঁদতে নেই তো তাই।
মৃণালিনীঃ সেই দিন , সেই রাত অনেক আগেই পার হয়ে গেছে অনিক।ঐ সব এখন সৃতি।
আমিঃ বাদ দাও এসব।ঘৃণা তো তোমায় আমি করতে পারবোনা।কিন্তু এই সাদা শাড়ি পড়ার কারণ কি ? কেউ কে দুরদেশে পাড়ি জমিয়েছে ?
মৃণালিনীঃ পাড়ি তো তুমি দিয়েছো অনিক।ছোট্ট দুরত্বকে আলোকবর্ষের সমান করে তুলেছো।হাসতে ভুলে গেছ , জোর করে বাঁচার চেষ্টা করছো।আর প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার অভিনয় করছো।
আমিঃ তবুও তো মায়ায় ভরানো মিথ্যে ঠোঁটের উঞ্চতা এখন আর আমায় রাত দুপুরে কাঁদায় না।দিন শেষে পাগলামী করতে হয়না।সত্যটা মানতে কষ্ট হয় তবে মিথ্যের চেয়ে নয়।মিথ্যেগুলো একটু বেশিই কষ্ট দেয়।
মৃনালিনীঃ আরো একবার চেষ্টা কেন করছোনা ? চলার জন্য অনেক মানুষকে সাথে পাবে।
আমিঃ সেটা তো তবেই সম্ভব না যেদিন তোমায় ভুলতে পারবো।এই জীবনে আর হয়তো হবেনা।
মৃণালিনীঃ তোমার ট্রেন চলে যাচ্ছে অনিক।
অনিক...অনিক...অনিক... উঠ! সকাল নয়টা বেজে গেছে।কলেজে যাবিনা !
মায়ের বকবকানিতে স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল।কিন্তু বাস্তবে স্বপ্নের ভাঙ্গন যে এতটা নিষ্ঠুর তা হয়তো বুঝানো সম্ভব না।আর বুঝাতে চাইও না।আমার এই গল্প না হয় আমার মাঝেই থাক।তাছারা সব গল্পের সমাপ্তি টানতে হবে কেন ? হারিয়ে যাবার গল্প কয়জন শুনতে চায়।মৃণালিনী তো ভালোই আছে।মরছি তো শুধু আমি প্রতিদিন এবং প্রতিটা মূহুর্তে।হয়তো আমিও একদিন চলে যাবো না ফেরার দেশে।আমি ক্লান্ত আকাশ।অনেক বেশি ক্লান্ত।
নীল স্লিপিং পিল দিয়ে আর কত রাত চালাবো ?