কিছু লিখতে হবে... লিখতেই হবে... তবে দুই যুগের প্রতিটা দিনের কথা একটা নোটে লিখা সম্ভব না। তবুও চেষ্টা করছি, নিজের জন্য। কখনো কখনো মুখে অনেক কিছু বলতে পারিনা, গলা কাঁপে, অনুভূতির আলোড়নে কথা হারিয়ে যায়। অনেক কিছু বলতে চাই কাউকে, কিন্তু কাউকেই শেষ পর্যন্ত বলা হয় না কথাগুলো। বুকের ভেতর একটা পাথর জমে গেছে মনে হয়, আর পাথরের আকার প্রতিটা দিন বাড়ছে, কি হারে বাড়ছে তা নাহয় নাই বললাম। আমার জীবনের সবথেকে পুরানো যেই স্মৃতিটা মনে পড়ে তা মনে হয় মা আর আমি রাজশাহীতে মামার বাসায় গেলাম, আমার খালুর কোলে ছোট্ট একটা বাবু। এটা কি সবথেকে পুরানো নাকি মা আর আমি শীতের মধ্যে রাজশাহীতে লেপের ভিতর, ঘুম ভাংলো আমার খালাতো ভাইয়ের ডাকে। টাইমটেবিলটা ঠিক মেলাতে পারছি না। যাই হোক, ছোটোবেলায় মাকে খুব ভয় পেতাম। আমি খুব একটা দুষ্টু ছিলাম না, তবে আমি অনেক বোকা ছিলাম। আমার বোকামীই আমার মার খাবার একমাত্র কারণ ছিল বেশীরভাগ সময়। মার খেয়ে রাগ করে মাঝে মাঝে মার ডায়রীতে বকা দেওয়ার মতো কথা লিখে রাখতাম। এখনও মার সেই ডায়রী আর আমার হাতের অদ্ভুত লেখাগুলো আছে সেভাবেই!
আমি মাকে কখনো খুব একটা ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। প্রথমবার দেখেছিলাম আমার জন্য। আমাকে উত্যক্ত করত একটা লোক, আমি তখন মাত্র এইটে পড়ি। আমাদের এলাকাতেই থাকত। যাই হোক, মোটকথা, ঐ লোকের আপন বোন অন্য একটা মানুষকে বলেছিল, "এত পড়া পড়া করে না, দেখবো ওর মেয়েকে কি এত পড়া্য় আর কোথায় বিয়ে দেয়।" আমার মনে হয়, বাংলাদেশের ৮০% মেয়েই আমার মতো কপালগুণে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার সুযোগ পায় না। আমার মা সবসময় চাইতেন তার মেয়েরা যাতে অনেক বেশি ভালো পড়ালেখা করার সুযোগ পায় আর ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়তে পারে। মেয়েদের জন্য মার কেয়ারটা একটু বেশি হওয়ার কারণ ছিল তার নিজের ক্যারিয়ার তিনি আমাদের জন্য বলিদান করেছেন। আমার মাকে আমি শেষবার ভেঙ্গে পড়তে দেখি আমার বাবার অসুখের সময়। তার নিজের অসুখের সময়ও তাকে এতটা ভাঙ্গতে দেখিনি। তিনি বলতেন , "মরণকে আমি ভয় পাই না!"
মা আর মেয়ের যে কতটা ভালো সম্পর্ক হতে পারে তা হয়তো আমার থেকে ভালো কেউ জানে না, কারণ আমার মা শুধু আমার মা ছিলেন না, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর মেন্টর ছিলেন। আমরা অনেক ফ্র্যান্কলি অনেক কথা শেয়ার করতাম। মা আমাকে বলতো যে তিনি অনেক এমন মা দেখেছেন যারা মেয়েদের সাথে পিরিয়ডের কথা শেয়ার করতেও লজ্জাবোধ করেন। আশ্চর্য !! তাই না? আমি অবাক হতাম এসব শুনে, তবে তখনও আসলে বুঝিনি যে কত বড় রত্ন আমার জীবনে আমি পেয়েছিলাম শুধু ভাগ্যগুণে। আমি আমার জীবনে যদি একটা জিনিসের জন্য বিধাতার কাছে কতজ্ঞ থাকি তা হবে আমার মা ভাগ্য।
আমার মার ভালো গুণ বলে শেষ করা যাবে না। আমার মাঝে যেই কয়টা আছে তা তার গুণের একটা কণাও না। মা সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন খুব সহজেই। সত্যবাদী ছিলেন বরাবরই। মা খুব সুন্দর করে হাসতে পারতেন, অনেক কষ্টের মাঝেও তাকে হাসতে দেখেছি আমি। মার সেন্স অব হিউমার অনেক ভালো ছিল। (আমার বাবার মধ্যে যদি এই জিনিস এক কণাও থাকে তাহলে সেটা মার অবদান!!!) মা চেষ্টা করতেন মানুষের উপকার করার। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, সেটা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক। হ্যা, তার শেষজীবনে হয়তো এই একটা কাজের জন্য তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে, সত্যি বলি মা, তোমার কদর যারা বুঝেনি তারা অভাগা, এপারে তাদের হাজার হাজার দুয়াও বিফলে যাবে তোমার এক ফোঁটা চোখের জলের জন্য।
মা কতটা ভালো মানুষ ছিলেন তা আসলে কয়েকটা কথা না বললে কেউ বুঝবে না। মা বলতেন ,"চলতে ফিরতেই যেন মরে যাই।" আমার মা শয্যাশায়ী ছিলেন না। মা বলতেন, "এত কষ্ট করে তোদের আমার লাশ টানতে হবে না। আঞ্জুমানে মফিদুলে দিয়ে দিস, ওরাই দাফন করবে।" মার কবর হয় রাজশাহীতে , ঢাকা থেকে রাজশাহীতে মার লাশ যেই গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তা আঞ্জুমানে মফিদুলের একটা অ্যাম্বুলেন্স। মা বলতো, "যদি আমার লাশও পড়ে থাকে তবুও পরীক্ষা থাকলে দিয়ে তারপর আমাকে কবর দিবি।" সত্যি বলতে আমার বোনকে তাই করতে হয়েছে। ওর পরীক্ষার দিনই মা চলে গেলো। আমরা কেউ ওকে হলে যাবার আগে জানতেও দিইনি যে মা নেই। ও পরীক্ষা দিয়ে এসে মাকে দেখতে পেয়েছে। মাঝে মাঝে বলতো ,"আমি মরলে, তোরা কেউ আমার মুখে পানিও দিতে পারবি না রে!" আমরা আসলেও অনেক অভাগা, মার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় আমরা তিন ভাইবোনের একজনও তার পাশে ছিলাম না।
আমার জীবনে আসলে মার বিচরণের পরিধি অনেক বেশি ছিল, কারণ আমি একটু বেশি অস্হিরমনা, আর নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য খুব কঠিন একটা কাজ। আমি খুব অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ি, তবে মার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বললেই আমার ঐ ভাংগা অবস্হা ঠিক হয়ে যেত। গত কয়েক বছরে আমি মার সাথে কিছু শেয়ার না করে থাকিনি একদমই। মার সাথে আমার শেষ কয়েকটা দিনের কথা আমি কখনোই ভুলবো না। মার সাথে হসপিটালে থাকতে আমার এক মুহুর্তের জন্যেও বোরিং লাগতো না। বরং সত্যি বলতে হসপিটালের বেডেই আমার সবথেকে আরামের ঘুমগুলো হয়েছিলো। এক ঘুমে রাত শেষ এমনটা আসলে খুব কমই হয় আমার। সবথেকে বেশি মনে পরে যেই কথাটা তা হলো প্রতিদিন মা নাস্তা দেওয়ার সময় হসপিটালের স্টাফের কাছ থেকে একটু চিনি চেয়ে নিতেন। আমি আবার চা পাগল , বলতে গেলে মার ভাষ্যমতে আমি "চাখোর"। চা আমার নেশা!! মা কে ডায়বেটিক ডায়েট দেওয়া হয়েছিল, তাই তার নাস্তায় চা থাকলেও চিনি এলাউড ছিল না। শুধু আমার জন্য তিনি চিনি নিতেন, স্টাফরা মার হাসিভরা আব্দার ফেলতে পারতো না। এমন না যে আমি নিচে গিয়ে চা খেয়ে আসতে পারতাম না, তবে মাকে রেখে নিচে যেতে আমার ইচ্ছা করতো না। আমার এখনও মনে পড়ে , কেবিন ভবনের ছয় তলা থেকে নিচে মেডিসিন স্টোরে মেডিসিন নিতে গেলেও মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতেন। আমি অবশ্য নিচে গিয়ে মাকে হাত তুলে "হাই" দিতাম। মাকে জোর করে স্যুপ খাওয়ানো, দুধ খাওয়ানো, ভাত খাওয়ানো, মার বোতলে পানি ভরে দেওয়া ... বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের ঝগড়া দেখা একসাথে... এইগুলোই অনেক ভালো সময় ছিল। কি হতো আমাকে আরেকটু সেবা করার সুযোগ দিলে? সারাজীবন শুধু আমাদেরকেই দিয়েই গেলে?
আমার মা আমাদের তিন ভাই-বোনকেই বাবু বলে ডাকতেন। আমি মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে বলতাম,"মা, তুমি বড় বাবু, মেজো বাবু, ছোটো বাবু বলে ডাকতে পারো না?" মা হাসতো। এখন আমাদেরকে বাবু বলে ডাকার কেউ নেই! আমি মনে হয় সেই মানুষ যে অনেক বড় হয়েও মার কোলে বসে থাকতাম। আমার এসএসসি পরীক্ষার আগের রাতে আমি খুব অসুস্হ ছিলাম। আমার মনে আছে আমি মার কোলে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। মাও অনেক কষ্ট পাচ্ছিলেন মনে মনে, কিন্তু মুখ আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার এইচএসসি পরীক্ষার মাঝেও আমি অনেক অসুস্হ ছিলাম। মা না থাকলে হয়তো পরীক্ষাগুলোই দেওয়া হতো না। আমি এই দিক থেকে আমার ভা্ই আর বোনের থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান।
মা কে আমি অনেকদিন থেকেই কিছু গিফট দিব বলে চিন্তা করছিলাম। ফেব্রুয়ারীর ২০ তারিখ রাত একটার পর মনে হয় আমি মা কে আমার নিজের টাকায় কেনা একটা কানের দুল গিফ্ট করেছিলাম। সবসময় ওটা পরে থাকতে বলেছিলাম।মে মাসের ২ তারিখে ঐ কানের দুলটা আমার মার নিথর দেহ থেকে খুলে ফেলা হয়। আমার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল ৪ তারিখ। মা একটা আব্দার করেছিলেন। আমার , আমার বোনের আর মায়ের একইরকমের তিনটা রূপার আংটি। যখন মার চলে যাওয়ার খবরটা শুনি, তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সবাইকে বলছিলাম, আমার মা আমার সাথে কথা না বলে যেতে পারেনা। আমি তো মার জন্যে গিফট কিনেছি, আমার মা যেতে পারেনা।
আমি এখনও মেনে নিতে পারিনা। হয়তো কোনোদিন পারবোও না। এই জীবনের পরে যদি আরেকটা জীবন থাকে তাহলে হয়তো দেখা হবে আমাদের। হয়তো আর কখনোই হবে না।
মানুষ কত ছোটো ছোটো কারণে জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়... হয়তো বাবা-মা বকেছে, তাই বিষ খেলাম; গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে তাই হাত কেটে রক্তের বন্যা বইয়ে দিলাম... আবার অনেক মানুষ আছে কত কষ্ট সহ্য করেও শেষ সময়টুকু পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়। নিজের জন্য না, হয়তো যে মানুষটার সে ছাড়া আর কেউ নেই তার জন্য... হয়তো তার উপরে থাকা কতগুলো কর্তব্যের দায়ভার ধরে রাখার জন্য... নিজের জীবনের এই অদ্ভুত ছোটো ছোটো দুঃখকে বড় করে দেখার আগে ভেবে দেখো, হয়তো তোমার পাশের বাসায় বাস করছে কয়েকজন মানুষ... দিন শেষে রাত আসলে চার জন চার খাটে শুয়ে জোর করে দু'চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর জোর চেষ্টা করছে... ছেলেটার চোখে তার মায়ের শেষবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার স্মৃতি, জোর করে তা ভুলে যাওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা... মেয়েটার মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার অনুভূতিগুলো ভুলার চেষ্টা... যে মানুষটা লোকটাকে একটা ঘর দিয়েছিল, পরিবার দিয়েছিল তার শূন্যতায় লোকটার বারবার এপাশ ওপাশ ফিরে শোয়া... আর পাশের খাটে একটা মেয়ের বোবা কান্না, বাবার দীর্ঘশ্বাসগুলো শুনেও না শোনার ভান করে ঘুমানোর ভান করা... চারটা খাটে শুয়ে কেউ কাউকে না জানতে দেওয়া যে কারো চোখে ঘুম নেই... একটা মৃত্যু , কিন্তু লাশ পাঁচটা ... তারপরেও প্রতিদিন সকালে উঠে জীবনের জন্য বেঁচে থাকা... জীবন কি জানিনা, তবে শেষদিনটা পর্যন্ত নিজের হাতে শেষ করবো না... দুঃখবিলাস বলতে পারেন... কত দুঃখ আছে দেখতে চাই... সুখ আসলেও জোর করে আমি দুঃখী থাকতে চাই... ক্ষত শুকানোর আগে খুঁচিয়ে আমি রক্ত বের করে সেই ক্ষতকে নতুন বানাবো... শুকোতে দিবো না... সেই দগদগে ক্ষত নিয়েও বাঁচবো... শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত...