আমার প্রিয় একটা সানগ্লাস আছে। টেগ হিউয়ার ব্র্যান্ডের। বেশ দামীই বটে। কিনেছিলাম ফ্লোরিডার মায়ামী এয়ারপোর্টের পাশেই অবস্থিত ‘মায়ামী ইন্টারন্যাশনাল মার্চেন্ডাইস মার্ট’ থেকে। মায়ামীর মত শহরে শশুর বাড়ী থাকায় বেড়াতে গেলে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে অনেক সুবিধা গ্রহন করে থাকি। ওই মার্কেটে অনেক নামিদামী ব্র্যান্ডের জিনিষ পাওয়া যায়। তবে দাম অন্যান্য জায়গার চাইতে কিছুটা কম। অনেক আউটডোর একটিভিটি করি বলেই ওই গ্লাস কেনা। লাইফ লং গ্যারান্ট্রি দেয়া আছে। গ্লাসের জীবদ্দশায় যদি কখনও কোন ধরনের স্ক্রাচ পড়ে তাহলে আমেরিকার যে কোন লোকেশনের স্টোরে গেলে গ্লাস বদল করে নতুন একটা দিবে। ওই গ্লাস দিয়ে বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে এক হাজার মাইল সাইকেল চালিয়েছি। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি এমনকি তুষারপাতেও চোখের নিরাপত্তায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। যেখানেই যাই গ্লাস আমার সাথে সাথে যায়।
আমি থাকি মিনেসোটা ষ্টেটে। গত সামারের জুন মাসের কোন এক বিকেলে অফিস থেকে বের হয়েছি। ভাবলাম বাসায় গিয়ে সুন্দর আবহাওয়ায় সাইকেল নিয়ে বের হব। কিছু প্র্যাকটিস রাইড দরকার। দুই দিন পর আমার একশত পঞ্চাশ মাইলের সাইকেল চালানোর ইভেন্ট। অফিসের পার্কিংলটে এসে গাড়ির দরজা খুলতেই সানগ্লাসের বক্সটা পড়ে গেলে। তাড়াহুড়ো করে বক্সটা তুলে ভেতরে রেখে গাড়ী নিয়ে হাইওয়েতে উঠলাম। চোখে কড়া রোদ লাগাতে সানগ্লাসটা খুঁজতে লাগলাম। গাড়ীতে গ্লাসটা সব সময় বক্সের বাইরেই থাকে। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। তাহলে কি গ্লাসটা বক্সের ভিতরেই ছিল। দরজা খোলার সময় পড়ে গিয়েছে। কিন্তু বক্সটা গাড়িতে তোলার সময় আশেপাশে দেখেছিলাম। কিছুই মাটিতে পড়া অবস্থায় চোখে পড়েনি। ভাবলাম আবার ফিরে যাই পার্কিংলটে। যদিও ইতিমধ্যে প্রায় পনের মাইল চলে এসেছি। আবার ভাবলাম অফিস ছুটির সময়ে পার্কিংলট তো ব্যস্ত থাকবে। আর সানগ্লাস যদি মাটিতেও পড়ে থাকে তাহলে সেটা ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই কোন গাড়ীর চাকাতলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। নিজেকে নিজেই সান্তনা দিতে শুরু করলাম। এই পৃথিবীতে মানুষই চিরস্থায়ী নয়। সেই জায়গায় ওটাতো সামান্য একটা সানগ্লাস। হোকনা দামী। তাতে কি। গত কয়েক বছর তো ওকে অনেকটাই ব্যাবহার করেছি। আর কত। নাও লেট হিম ডাই উইথ ডিগনিটি। অবশ্য মৃত্যুর সময় সানগ্লাসটা তার মালিকের সান্নিধ্য পেলে আরও ভাল হতো। এই জন্য হয়ত সে একটু দুঃখও পাবে। মৃত্যুকালে হয়ত কিছু বলে যেতে পারতো। মালিক হিসেবে আমি কেমন ছিলাম, আমার চোখে সে পৃথিবীকে কোন রঙে দেখেছে ইত্যাদি।
বাসায় এসে শেষ চেষ্টা হিসাবে বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটির অফিসে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে জানতে চাইল সমস্যা কি। ঘটনা খুলে বললাম যে পার্কিংলটে গাড়ীর দরজা খোলার সময় আমার প্রিয় সানগ্লাস গাড়ী থেকে পালিয়েছে। যদি খুঁজে পাও প্লিজ, প্লিজ আমাকে জানিও। নারী সিকিউরিটি আমার ফোন নাম্বার টুকে রাখল। আর বলল লটে খুঁজে না পেলে পরের দিন ওরা ওই বিল্ডিংয়ের সমস্ত অফিসে ইমেইলের মাধ্যমে ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে দিবে। ভাইসব, গতকাল বিকাল প্রায় পাঁচ ঘটিকার সময় বাদামী রঙের ‘টেগ হিউয়ার ব্র্যান্ডের’ একটি বাদামী রঙের সানগ্লাস হারানো গিয়াছে। যদি কেহ পেয়ে থাকেন দয়া করে সিকিউরিটির অফিসে দিয়ে যাবেন”।
রাতে এক কি দুইবার গ্লাসটার কথা মনে হল। ঘুমের মধ্যে একটা দুঃস্বপ্নও দেখলাম। গ্লাসটা স্লো মোশনে বক্স থেকে বের হচ্ছে। মাটি থেকে প্রায় একফুট উঁচু থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে একটা ড্রপ খেল। তারপর মুহূর্তেই উল্টো দিকের গাড়ীর নিচে চলে গেল। জায়গাটা ছিল কিছুটা অন্ধকারময়। গ্লাসটা দেখল তার মালিক হাঁটু গেড়ে কিছু একটা খুঁজছে। সে একটু মজা পেল। যেন চোর পুলিশের লুকোচুরি খেলা। অতঃপর দরজা বন্ধ আর গাড়ীর ইঞ্জিনের শব্দ শুনে ওর আত্না শুকিয়ে গেল। সে একটু বের হতে চেয়েছিল ঠিকই কিন্তু চিরতরে হারাতে চায়নি। এমনটি হবে সে ভাবতেও পারেনি। “মালিক, মালিক আমি এইদিকে, আমি এইদিকে” বলে অনেক্ষন ধরে চিৎকার করলো। কিন্তু কোন কাজ হোল না। মালিক তাকে চিরতরে ছুটি দিয়ে গাড়ী নিয়ে চলে গেল। ঠিক পাঁচ মিনিট পর সুন্দরী এক আমেরিকান মহিলার বিলাসবহুল গাড়ীর চাকা তার দিকে ধেয়ে আসলো। গ্লাসটি চিৎকার দিয়ে উঠলো, বাঁচাও, বাঁচাও, এদিকে এসো না”। আমার দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আবার একবার গ্লাসটার কথা মনে পড়ল। মানুষ মরার পর নাকি প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠতে বাহাত্তর ঘণ্টা বা তিন দিন সময় লাগে। আমার তো সামান্য বস্তু বা জিনিস হারানোর শোক। এক্ষেত্রে বড়জোর আধা বেলার মাতমই যথেষ্ট হবার কথা। গ্লাসকে মন থেকে দূরে ফেলে একটু সকাল সকাল তৈরি হয়েই বের হলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। তিন তলায় আগের দিনে যেখানে পার্ক করেছিলাম সেখানেই পার্কিং পেয়ে গেলাম। অনুসন্ধিচ্ছু দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশের পার্কিং করা গাড়িগুলোর নিচেও দেখে নিলাম। নাহ। কোথাও কিছু নেই। হাল ছেড়ে পার্কিংলটের নিকটবর্তী লিফটের দিকে হাঁটছি। উদ্দেশ্য অফিসের লিফট ধরা। হঠাৎ আমার ডান পাশের ছোট একটা দেয়ালের উপর চোখ পড়লো। পরিচিত সেই সানগ্লাসটি দুহাত ছড়িয়ে দিব্যি হা করে আমার দিয়ে তাকিয়ে আছে। ছো মেরে হাতে তুলে নিয়ে পরিক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলাম। নাহ। তার কিছুই হয়নি। সম্পূর্ণ সুস্থ দেহেই আমার কাছে আবার ধরা দিল। গতকাল নিশ্চয়ই কেউ একজন মাটিতে পড়া অবস্থায় দেখে ওকে তুলে দেয়ালের উপর রেখে দিয়েছে। হতে পারে সেই কেউ একজন হচ্ছে স্বপ্নে দেখা সেই সুন্দরী মহিলা অথবা অন্য কেউ। সে দেখতে সুন্দর বা অসুন্দর যাই হোক না কেন সে একজন ভাল মানুষ।
এই পৃথিবীতে এখনও ভাল মানুষের ছড়াছড়ি। ভাল মানুষের সংখ্যা মন্দ মানুষের চাইতে অনেক বেশি। ওইসব ভাল মানুষদের কারনেই আমার মত খামখেয়ালীপনা মানুষদের জীবন টিকে আছে। খামখেয়ালীপনা মানুষেরা বার বার ভুল করেন আর ভাল মানুষেরা সব সময় সেই ভুলগুলো শুধরিয়ে দেন। কিন্তু তারা কখনও ধরা দেন না। তাদেরকে চলাফেরা থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে। কখনও কখনও আমরা সেই সব ভাল মানুষদের স্বপের ভেতর খুঁজে বেড়াই।
- জামাল সৈয়দ,
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র