নাহিদ আমেরিকা প্রবাসী আইটি বিশেষজ্ঞ। উচ্চ বেতনের চাকুরীজীবী। আয় বা বেতন অনুপাতে তার অবস্থান হচ্ছে আমেরিকান উচ্চবিত্ত সমাজের পাঁচ শতাংশ মানুষের মধ্যে। অবশ্য এই অবস্থায় আসতে তাকে কঠোর পরিশ্রম আর ধৈ্যের পরিচয় দিতে হয়েছে। দীর্ঘ আট বছর পর স্ত্রী অপিকে নিয়ে ঢাকায় এসেছে বেড়াতে। থাকবে মোট পাঁচ সপ্তাহ। বিয়ের পর তাদের এই প্রথম ঢাকায় আসা। তার স্ত্রীও আমেরিকায় উচ্চ বেতনের চাকুরীজীবী।
নাহিদ আর অপি দু জনেই রিকশায় চড়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়। এদিক ওদিক যায়। বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করেই দিনগুলো পার করছিল। একদিন ওরা মালিবাগে রিকশা দিয়ে যাবার সময় এক মিষ্টির দোকানের সামনে থামল। উদ্দেশ্য নাহিদের ফুপুর বাসায় নিয়ে যাবার জন্য কিছু মিষ্টি কেনা। রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে নাহিদ অপি দুজেনে দোকানে ঢুকে মিস্টি দেখতে লাগলো। হরেক রকম মিষ্টি দেখে দোকানদারকে বলল প্রত্যেক প্রকার হতে এক কেজি করে দুটো বাক্সে মোট পাঁচ কেজি মিষ্টি দিতে। আড়াই কেজি করে প্রতিটি বাক্সে।
দোকানি যখন মিষ্টি তুলছিল অপি তখন আয়নার প্রতিফলনে লক্ষ্য করলো যে একটা ছোট ছেলে রাস্তার দিকে কাঁচের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের মিষ্টি মাপা দেখছে। জরাজীর্ণ দেহের সাত কি আট বছরের একটা ছেলে। হাতে একটা বড় ঝুড়ি। দেখলেই বোঝা যায় কুলি মজুরীর কাজ করে। ওখানে দাঁড়িয়ে সে মিষ্টি দোকানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু একটা বলছে। দোকানদারের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ব্যস্ত পাঁচ কেজি ওজনের মিস্তি মাপা নিয়ে। অপি স্পষ্টই শুনতে পেল ছেলেটা দোকানীর কাছে জানতে চাচ্ছে, “এক পিস মিষ্টির দাম কত”?
- পাঁচ টাকা, দোকানীর উত্তরে ধমকের স্বর।
মিষ্টি মাপা শেষ হলে অপি দোকানী’কে আর একটা আধা কেজির মত বাক্সে দেখিয়ে বলল ওটা মিষ্টি দিয়ে ভরে দিতে। তারপর বিল পরিশোধ করে সে ছুটে বাইরে এলো ছেলেটার হাতে মিষ্টির বাক্সটা ধরিয়ে দিতে। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছেলেটি লাপাত্তা। অপি ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে বার বার করে ছেলেটাকে হন্য হয়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোন লাভ হল না। অতটুকু সময়ের মধ্যেই ছেলেটি যেন হাওয়া হয়ে উড়ে চলে গেছে।
সেই রাতে অপি বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘুমাতে গেল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল সে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। একা একা। সাথে নাহিদ নেই। তার সামনে বিশাল একটা নদী। সে খুবই চিন্তিত নদী পার হবে কিভাবে।
এমন সময় দেখল মিষ্টির দোকানে দেখা সেই ছেলেটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে মা বলে ডাকছে। তার পরনের কাপড় বলতে ছোট একটা ঢিলেঢালা প্যান্ট, সামনের দিকে চেইন নেই। প্যাণ্টের কোমরের অংশ রশি দিয়ে বাঁধা। হাতে মালামাল বহন করার বিশালাকার একটা ঝুড়ি।
- আম্মা, আমারে আপনে খুঁজতাছিলেন? কি আশ্চর্য্য! ছেলেটি অবলীলায় অপিকে আম্মা বলে সন্মোধন করছে। কিন্তু অপি তার কোন প্রতিকার করছে না। বরং তার ভালই লাগছে। ছেলেটি বলে চলল,
- “আমি এক সাহেবের বাজার নিয়া যাওয়ার ক্ষেপ পাইছিলাম। তাই মিষ্টির দোকানে আর দাঁড়াইতে পারি নাই। আমি বুজছিলাম আপনি আমার লাইগা মিষ্টি কিনছিলেন। এহন আইছি, আমারে মিষ্টি দেন”।
অপি নিজেকে আপাদমস্তক পরিক্ষা করে দেখে নিল যে তার সাথে মিষ্টির বাক্সটা আছে কিনা। নাহ তার সাথে কিছুই নেই। এক কাপড়ে সে এখানে এসেছে। তার সামনে একটা বিশাল নদী আর ছেলেটা ছাড়া কিছুই নেই।
(চলবে)