এক
আজও ইলা কথাটা বলতে পারল না। নাস্তার টেবিলে জহিরুল নিজে থেকেই অনেক কথা বলল। ইলা শুধু মন দিয়ে ওর কথাগুলো শুনেছে। আজ বিয়ের পঞ্চম দিন। মাত্র একশত বিশ ঘণ্টা হয়েছে। ইলা ভাবছে এত অল্প সময়ে জহিরুলের কাছে কিভাবে কথাটা উত্থাপন যায়। একটা মানুষকে চিনতে কতটুকু সময় নেয়া দরকার। কতটুকু চেনা দরকার। ইলা মনে মনে কল্পনা করে কথাটা শোনার পর জহিরুলের মনোভাবটা কি হবে। ও কি নাস্তার টেবিল থকে উঠে যাবে। প্লেট ছুড়ে মারবে। চিৎকার, চেঁচামিচি করবে। সেই মুহূর্তে ইলারই বা কি করার থাকতে পারে। সুইসাইড একটা অপশন। অন্যটি বাবা-মার বাড়ি ফিরে যাওয়া। কিন্তু মেয়েদের বিয়ের পর বাবা-মা বলে কিছুই নেই। তারা তখন হয় নিকটাত্বীয়ের মত। মাঝে মাঝে বেড়াতে যাওয়া আর ফোনে খোঁজ খবর নেয়া ছাড়া আর কিইবা করতে পারবে। কিইবা করার থাকে। ছোট বেলার ইলা একটা টিয়া পাখি পুষত। সবসময় খাঁচায় বন্দি থাকত। একবার সে পাখিটার খাঁচার দুয়ার খুলে দিল। কিন্তু পাখিটা উড়ে গেল না। পরে সে এক বান্ধবীর কাছ থেকে শুনেছে। খাঁচার টিয়া নাকি আকাশে উড়তে পারলেও ওরা নাকি কখনও ওদের দলে মিশতে পারে না। বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হওয়া সাথীকে কেউ দলে ভিড়তে দেয় না। কি নিষ্ঠুর প্রকৃতির নিয়ম।
জহিরুল নাস্তা খেয়ে দুএকটি কথা বলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। বলে গেল সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই ফিরে আসবে। সে দেশের নামকরা একটা মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিতে চাকুরীরত। ইলাকে বলে গেল কোন জরুরী প্রয়োজন হলে তার মোবাইলে কল দিতে। ইলা ঘুরে ঘুরে তার তার নতুন এপার্টমেন্টই দেখতে লাগলো। নিজের মনে করতেই কিছুতা লজ্জা পেল। মাত্র পাঁচ দিন হয় নতুন বউ হয়ে এসেছে। তাতেই তার নিজের বাড়ি মনে করাতে লজ্জা পেল। মালিবাগ বাজারের পাশ ঘিরেই ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠ তলায় তার এপার্টমেন্ট। ইলা দেখল জহিরুল গেট দিয়ে বের হয়ে বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। গত পাঁচ দিনে যতটুকু দেখেছে জহিরুল লোকটা খারাপ না। তবে ভালও যে হবে তাও সে জানে না। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইলার কথাটা শোনার পর সে কিরূপ আচরণ করবে।
দুই
ইলা সিদান্ত নিল আজ সারাদিন সে একা একা রিহারসেল দিবে কিভাবে জহিরুল কে কথাটা বলবে। প্রথমে ওরা যে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকবে। আপেক্ষা করবে জুহিরুলের মুড কখন সবচাইতে প্রানচাঞ্চল্য হয়। প্রয়োজনবোধে জহিরুল যদি অন্য কিছুও ইঙ্গিত করে তাতেও সে সায় দিবে। কথাবার্তার মাঝখানে সে শুরু করবে একটু সাদামাটা ভুমিকা দিয়েঃ
- আচ্ছা, তোমাকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল। বিবিয়ের রাত থেকে বলব বলে সুযোগ খুঁজছি।
- জহিরুল বলবে, এখুনি বলতে হবে?
- হ্যাঁ, একটু জরুরী কিনা।
- ঠিক আছে বলে ফেল?
- মানে, কথাটা শোনার পর হয়ত আমাদের বিবাহোত্তর জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে।
- হুম, মনে হচ্ছে তো ইম্পরট্যান্ট লাইফ ডিসিশন। তাহলে তো একটু প্রিপারেশনের প্রয়োজন। তার আগে তো একটু চা-কফি হয়ে যাক।
ইলা মনে মনে কল্পনা করল ভুমিকা পর্বে জহিরুল যদি চা খাবার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে এই প্রস্তাব সে সাথে সাথে লুফে নিবে। কড়া করে সে দুই কাপ চা বানাবে। সাথে দুটি পুরি ভেজে দিবে। গতকাল রাতে জহিরুল তাকে সংসারের প্রথম বাজার করতে নিয়ে গিয়েছিল। সে এক প্যাকেট তৈরি করা পুরি কিনে নিয়ে এসেছে।
ইলা সাদা আঁচলের নীল রঙের শাড়িটা পড়বে। সে জানে জহিরুলের প্রিয় রঙ হচ্ছে নীল। বিয়ের আগে ফোনালাপে কথা প্রসঙ্গে একবার বলেছিল।
সেদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। ইলা জানালার গ্রীল ধরে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। উপর থেকে মালিবাগ বাজারের পুরোটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দোকানীরা ঝাঁপ উঠিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। কয়েকটা বস্তির ছেলে আর একটা কুকুর রেল লাইনের উপর দিয়ে দৌড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হয় কোন একটা খেলায় ওরা মেতে উঠেছে। এমন সময় অন্য পাশ দিয়ে একটা রেলগাড়ি হু হু করে চলে এল। ইলার একটু ভয় হল। ওই কুকুর আর বস্তির ছেলেগুলোর জন্য নাকি নিজের জন্য বুঝতে পারল না। একটা বগির ছাদে কয়েক্ জন যাত্রী বৃষ্টির মধ্যে মালপত্র নিয়ে বসে আছে। ওদের অবশ্য বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। জীবনে যে সমস্ত মানুষ যত সস্তায় জীবন যাপন করে করে তাদের জীবনের মুল্য হয় তত কম। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় এই নিয়মকেই সবাই কম বেশি মেনে নিয়েছে।
তিনঃ
জহিরুল বাসায় ফিরল বিকেল পাঁচটায়। বৃষ্টিতে শরীর ভেজা। জুতা সহ প্যান্টের নিচের অংশটুকু ভেজা। ইলা তোয়ালে নিয়ে এসে জহিরুল্ কে দিল। মাথা ও শরীর মুছে জহিরুল ডাইনিং টেবিলে বসলো।
- আহা, প্যান্ট ভিজল কি করে?
- রিক্সা থেকে নামার সময় ভুল জায়গায় পা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রাস্তা। আসলে ওটা ছিল গর্ত। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে মাঝে মাঝে রিস্ক নিতে হয় বুঝলে। হয় জিতবে। না হয় হারবে। চয়েস মাত্র দুটি। যেখানে দুটি মাত্র চয়েস সেখানে ডিসিশন নিতে দেরী কড়া উচিৎ না, বুঝলে।
সরি, একটু বেশি ফিলসফিকাল কথা বলে ফেললাম। জহিরুল নিজেকে আত্নরক্ষা করল।
-ভাগিস্য পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওনি। ইলার স্বরে স্বান্তনার সুর। সে
এই কয়েকদিনের সংসারে ইলা জহিরুলের একটা মুদ্রাদোষ বের করেছে। ব্যাক্য শেষ করার পর জহিরুল ‘বুঝলে’ শব্দটা ব্যাবাহার করে। অবশ্য শুনতে খুব একটা খারাপ লাগে না। তার ইচ্ছা হচ্ছিল জহিরুল কে একটা প্রশ্ন করতে যে মানুষের জীবনে বিয়ের ডিসিশনে কয়টা চয়েস থাকে। বিশেষ করে তার নিজের বিয়ের ক্ষেত্রে। পরক্ষনেই সে নিজেকে বোঝাল যে সব সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে প্রশ্ন করতে হয়। মাত্র একশত বিশ ঘণ্টার দাম্পত্য জীবনে এই ধরনের প্রশ্ন করাটা উচিৎ হবে না। জীবনের অনেক সময় বাকি আছে প্রশ্ন করার।
- “আচ্ছা, আমার কি চা খেতে পারি”। জহিরুলের প্রস্তাবে নিরবতা ভাঙল।
- “অবশ্যই, পানি গরম করা আছে। আর কিছু খেতে চাও”?
- “পুরি, বিস্কিট বা যে কোন কিছু একটা হলেই হবে”।আম
ইলা কিছুটা উত্তফুল্ল হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল। ওর উত্তফুল্ল হবার কারন হচ্ছে যে তার রিহারসেলের প্রথম অংশ মিলে গেছে। জহিরুল চা খেতে চেয়েছে। গুড নিউজ। সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
চারঃ
জহিরুল অফিসের ব্যাগ থেকে একটা ডিভিডি বের করল। বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন আর অভিনেতা গ্রেগরী পেগের সাদা-কালো ‘রোমান হলিডে’। ওর অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল বউকে নিয়ে এই মুভিটা দেখবে একসাথে। কিভাবে সংবাদপত্রের রিপোর্টার আর বিলেতি রাজকন্যার মধ্যে প্রাচীন রোম শহরে তাদের ভালোবাসা গড়ে উঠে এই নিয়ে কাহিনী। মুভিটা ওর অফিসের এক কলিগের কাছ থেকে ধার নিয়েছে।
জহিরুল মুভিটা অন করে দিয়ে এসে ড্রয়িং রুমের সোফাসেটে ইলার পাশেই গা ঘেঁষিয়ে বসলো।
- এই মুভিটা আমি আগেও দেখেছি, বুঝলে। কিন্ত আমার সব সময় স্বপ্নছিল একদিন আমার ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে ছবিটা আবারো দেখবো। অসাধারন একটা ছবি।
ইলা আর জহিরুল পাশাপাশি গা ঘেসে বসে বসে মুভি দেখা শুরু করলো। জহিরুল বেশ আগ্রহ নিয়ে মুভি দেখছে। ইলা বেশ কয়েকবার ভাবল কথাটা তুলবে। কিন্তু পরক্ষনেই জহিরুলের জন্য একটু দুঃখ পেল। বেচার এত আগ্রহ নিয়ে রোমান্টিক ছবিটা দেখছে। এত সুন্দর একটা মুহূর্ত সে নষ্ট করতে চাইল না। হঠাৎ করে তার মনে হল, আচ্ছা জহিরুল’কে কথাটা না বলে কি জীবন শুরু করা যায় না। তার জীবন তো বেশ ভাল ভাবেই শুরু হয়েছে। পাঁচ দিন তো পার হতে চলেছে। একদিন পাঁচ মাস, পাঁচ বছর হবে। এমনি করেই হয়ত কেটে যাবে আরও অনেক যুগ। তার এখন রবিন্দ্রনাথের সেই গানটা শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করলঃ
“এমনি করেই যায় যদি দিন যায় যাক না
মন পুড়েছে পুড়ুক না রে
মেলে দিয়ে গানের পাখনা”
সেদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত্রি পর্যন্ত ইলা আর জহিরুল এক সাথে গায়ে গা মিলিয়ে বসে বসে মুভি দেখল। তবে তাদের মনস্ত্বাতিক জগত ছিল ভিন্ন। জহিরুলের চোখ ও মন দুই ছিল প্রাচীন রোমান শহরের পথে ঘাটে। অড্রে হেপবার্ন আর গ্রেগরী পেগের সাথে সাথে সেও যেন ভালবাসার জগতে হারিয়েছিল। ইলার জগতের একদিক জুড়ে ছিল একজন ভালবাসার মানুষ আর অন্যদিকে অপরাধবোধ, ভয় আর আশঙ্কার মেঘ। সে অনেকবার প্রস্তুতি নিয়েছিল কথাটা তুলবে বলে। বার বার হোঁচট খেয়েছে। জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো অযথা নষ্ট করতে নেই। অবশেষে তার ভয় আর আশঙ্কারই পরাজয় হল। সে কথাটা আর বলতে পারল না।
পাঁচঃ
পরের দিন জহিরুলের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজা গেল। সারাদিন ইলার জন্য তার মনটা পড়ে ছিল। তবে দুইবার ফোনে কথা হয়েছে। ইলা সারাদিন মনে মনে তার ড্রয়িং রুম আর বেড রুমের দেয়ালে কি কি ছবি দিবে তার একটা প্ল্যান করে ফেলল। ওদের বিয়ের একটা বড় আর দুটো ছোট সাইজের পার্সোনাল ছবি থাকবে বেড রুমে। ড্রয়িং রুমে কোন পার্সোনাল ছবি থাকবে না। শধু দেয়ালটার মাঝখানে বুনো ঝোপঝাড়ের বড় একটা ছবি থাকবে। ঝোপঝাড়ের মাঝখানে একটা মেঠো পথ। নিউ মার্কেটে গিয়ে খুঁজতে হবে। না পাওয়া গেলে সে কাউকে বলবে এমন একটা ছবি কিনে এনে দিতে।
আজ বাইরে বৃষ্টি নেই। আকাশ পরিস্কার। মাঝে মাঝে আকাশে সাদা মেঘের খণ্ড খণ্ড পাহাড়। জহিরুল ইলাকে বলল,
- চল, তোমাকে ছাদ দেখিয়ে নিয়ে আসি। আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর। ছয় তলায় বাসা কিনেছি শুধু মাত্র ঘন ঘন ছাদে যেতে পারবো বলে। তাছাড়া উপরে থাকলে মনে হয় আকাশের কাছাকাছি আছি। আকাশ মানে স্বর্গের কাছাকাছি। আমার ইচ্ছে আমাদের এই বাসার নাম দেব “স্বর্গবাস”। পিতলের একটা নেম প্লেট দরজার ঝুলে থাকবে। তাতে লেখা থাকবে ‘স্বর্গবাস’ বুঝলে।
ইলা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। জহিরুলের অনুরোধে ইলা চট করে চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে নিল। সাথে একটা চাদর নিয়ে নিল যদি ওখানে বসার জায়গা না থাকে। দরজা লক করে দিয়ে দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দুজনে ছাঁদে উঠলো। ছাদটা আসলেই খুব সুন্দর। খুব পরিষ্কার। চারিদিকে কোমর সমান সাদা ওয়াল দিয়ে ঘেরা। মাঝখানের মাঝখানে কয়েকটা সারি করে ফুলের টবে নানা রঙের গাছ-গাছালি। ইলা সুযোগে রইল কিভাবে কথাটা শুরু করবে। আর কোন ক্রমেই দেরী করা যাবে না। সে বিয়ের রাত থেকে অপেক্ষা করছে শুধু একটা কথা বলার জন্য। বুকের ভেতর বিশালাকার একটা পাথর চেপে বসে আছে। যেভাবেই হোক আজ সেই পাথর সরাতেই হবে।
- জহি, আমি একটা কথা বলব বলে গত কয়েকদিন ধরে সুযোগ খুঁজছি। তোমার কি একটু সময় হবে। আমি কথাটা বলতে চাই আজকে, এক্ষুনি।
ইলার মুখে জহিরুল এই প্রথম ‘জহি’ শব্দটা শুনল। বড় আপাই শুধু তাকে আদর করে ‘জহি’ বলে ডাকতো। আপা স্বামী, সংসার নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমিয়েছে অনেক বছর হয়।
- অবশ্যই, মাই ডিয়ার ওয়াইফ। তোমার কথা, আমার কথা শেয়ার করার জন্যই তো এখানে আসা। আমাদের কথা তো সবে মাত্র শুরু। কথা চলবে সারা জীবন। এখন থেকেই শুরু, বুঝলে।
- না মানে, কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তোমার জন্য। এই কথাটা শোনার পর আমাদের দাম্পত্য জীবনের গন্তব্য হয়ত পরিবর্তনও হতে পারে।
- ও আচ্ছা। মনে তো হচ্ছে আসলেই সিরিয়াস। জহিরুলের মাঝে খুব একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেলনা। সে ছাদের কোমরসম ওয়ালের উপর দু হাত রেখে সামনের দিয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো। তখনই নিচে বাজারের কোন রেস্টুরেন্ট বা দোকান থেকে উচ্ছ স্বরে হিন্দি গান বাজতে লাগলো।
- ঠিক আছে চা দিতে দিতে তোমার কথাটা বলে ফেল। খুব একটা ভূমিকা কিন্ত দেবে না।
জহিরুল ইলাকে দ্বিতিয়বার আশ্বস্ত করল। ইলা জহিরুলের দিকে তাকিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিল।
- তোমার সাথে বিয়ে হবার আগে আমার আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ও তখন ডিগ্রীতে পড়ে। আসলে তথাকথিত ভাবে বিয়ে নয়। কোর্ট ম্যারেজ। আমাদের একসাথে থাকার সুযোগ হয়নি। তার আগেই ও ছেড়ে চলে গিয়েছে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিঃশ্বাস নিয়ে ইলা তার কথাগুলো শেষ করলো।
জহিরুল একটু থতমত খেয়ে ইলার দিকে একবার তাকাল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ দিল। চায়ে একবার চুমুক দিল। ইলা আরও কিছু বলবার আগে জহিরুলের কাছে থেকে কিছু শুনবার অপেক্ষায় রইল। জহিরুল ছোট ছোট পায়ে ছাদের অন্য মাথায় হেঁটে গেল। আবার ইলার দিকে ফিরে আসলো। ইলার বুক ভরা ভয়, শঙ্কা, উত্তেজনা সবকিছুর বিস্ফোরণ ঘটলো একসাথে। সে জহিরের ঐ কথাটা মনে করলো। জীবনে যদি মাত্র দুটি চয়েস থাকে তাহলে যে কোন বিষয়ে সিদ্বান্ত নেয়া সহজ। এখন তো ওর সময় হয়েছে সিদ্বান্ত নেবার। চয়েসও মাত্র দুটি। বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়া। কোনরকমে ওয়ালে উঠে শরীরটা এলিয়ে দিলেই সব কিছু শেষ। জীবনের সব শঙ্কা আর ভয় থেকে মুক্তি পাবার উত্তম পথ এখনও খোলা আছে।
- তোমাদের ডিভোর্স হয়েছে কবে? জহিরুল নিরবতা ভঙ্গ করে প্রথম প্রশ্ন করল।
- কখনও হয়নি
- তাহলে ডিভোর্স ছাড়াই আমাদের বিয়ে হয়েছে?
- ও মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। কোর্ট ম্যরেজের তিন মাস পর। ঢাকা ফেরার পথে ঢাকা-ময়মনসিংঘ মহাসড়কে রাতের বেলায় ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে ও মারা যায়।
ইলার প্রতিটি ব্যাক্য শোনার পর জহিরুল একটু একটু সময় নিল ওগুলো ডাইজেস্ট করবার জন্য। সে বুঝে উঠতে পারছিলনা এই সমস্ত ক্রিটিকাল মোমেন্টে কি করা উচিৎ। সে অনেক আগে তার কাজের মাধমে একটা ক্লাসে অ্যাটেন্ড করেছিল। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু সেটা ছিল নেহায়ত পরিবেশ ও কর্পোরেট ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট। জীবনে পার্সোনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের উপর কোন ক্লাস নেয়া থাকলে ভাল হত।
জহিরুলের মনে হাজার ধরনের প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিল। কিন্তু ইলাকে কি প্রশ্ন করবে বা কোথা থেকে শুরু করবে নিজেকে প্রশ্ন করে তার সুদুত্তর পেল না। সে বরাবরই শৃঙ্খলার মাঝে বড় হয়েছে। সেই ছোটবেলায় ক্লাস সেভেনে থাকতে বাবা-মা পরিবার ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছে। জীবনের অনেকটা সময় ওখানেই কেটে গেছে। আজ অবধি নিজের চেষ্টায় এই পর্যন্ত এসেছে। এর পেছনে সবচাইতে বড় অবদান হচ্ছে তার ডিসিপ্লিন ও সুস্থ চিন্তাধারার প্রতিফলন। একবার ভাবল সে ইলাকে আরও কিছু প্রশ্ন করবে যেমন এখন কেন সে তার আগের বিয়ের কথা স্বেচ্ছায় বলছে? বিয়ের আগে এসব তথ্য কেন লুকিয়েছিল? ইলা কি এখনও তার মৃত স্বামীকে ভালবাসে? তার এক্স-স্বামী কি আদৌ রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে নাকি অন্য কিছু? জহিরুলের মনের মধ্যে আচমকা সন্দেহ আর প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই খুঁজে বের করতে লাগলো। যেমন ইলা যদি সত্যি কথাই বলে থাকে এবং এখনও যদি তার মৃত স্বামীকে ভালবেসে থাকে তাহকে জহিরুল কিভাবে তার ভালবাসাকে ঠেকাবে। এই প্রশ্নটা তো অবান্তর। কারও প্রতি ভালবাসা ঠেকানোর ক্ষমতা তো মানুষের নেই। জহিরুল নিজেও ভাল করে জানে মাত্র এই কয়দিনেই ইলার প্রতি তার ভালবাসার দানাও বড় হতে শুরু করেছে। সে বুঝতে পারলো না এই ভালবাসার অঙ্কুর’কে এখনও উপচে ফেলা উচিত কিনা।
সেদিন সন্ধ্যায় জহিরুল আর ইলার মধ্যে আর খুব বেশি একটা ব্যাক্য বিনিময় হল না। ছাদ থেকে নামার সময় জহিরুল ইলাকে শুধু বলল যে সে কয়েকটা দিন সময় চায় তার দেয়া তথ্য গুলো ডাইজেস্ট করবার জন্য। সাথে সাথে সে ইলাকে সতর্ক করে দিল যে জহিরুলের পরিবার বা অন্য কাউকে যেন সে এইসব তথ্য শেয়ার না করে। জহিরুলের প্রতি ইলার ফাইনাল কথা ছিল যেহেতু সে নিজেই এই তথ্য লুকাবার জন্য দায়ী। তাই জহিরুলের দেয়া যে কোন ধরনের শাস্তি বা তিরস্কারের মধ্যেও সে তার স্ত্রী হিসেবে জীবন যাপনের জন্য প্রস্তুত। এক্ষেত্রে জহিরুলের প্রতি স্ত্রী হিসেবে তার যে কোন ধরনের উচ্চাশা বা ক্ষোভ কোনটাই থাকবে না। জীবনভর সে প্রয়োজনবোধে দাসত্বকেও মেনে নিতে রাজি।
ছয়ঃ
জহিরুল-ইলার সংসারের আজ একযুগ পূর্তি। এই দীর্ঘ সংসার জীবনে জহিরুল একবারের জন্যও ইলাকে তার আগের বিয়ে বা স্বামী সমন্ধে কোন প্রশ্ন করেনি। বিবাহ বার্ষিকীতে ওরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছে।
তাদের সংসারে দুটি নতুন অতিথি এসেছে। দুটিই মেয়ে। বড়টি হচ্ছে টায়রা। বয়শ আট। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সায়রা। বয়স পাঁচ। জহিরুল বড়টিকে নিয়ে প্রায়ই একটা ছড়া কাটেঃ
“বাক-বাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা”
বড়টিকে নিয়ে বাবা ছড়া কাটে বলে ছোট মেয়েটি প্রায়ই এ নিয়ে কান্নাকাটি করে। কান্নার বিষয় তাকে নিয়ে কেন বাবা ছড়া কাটে না। জহিরুল তাই ছোট মেয়েটাকে নিয়েও একটা ছড়া বানিয়েছেঃ
“ছোট কন্যা সায়রা
মাথায় নেই টায়রা”
সায়রা বাবাকে প্রশ্ন করে, টায়রা কি, বাবা? সে উত্তর দেয় টায়রা হচ্ছে মাথায় পরার গয়না। সায়রা আবার প্রশ্ন করে, গয়না কি বাবা?
– গয়না হচ্ছে সাজুগুজুর জিনিষ। সাজুগুজু কি?
জহিরুল বিরক্তি হয়ে বলে, “তোমার আম্মুকে জিজ্ঞাসা কর”। সে টায়রাকে নিয়ে সমুদ্রের বালিতে স্যান্ড ক্যাসেল বানাতে ব্যস্ত। ছোট মেয়ে সায়রা ইলাকে দেখে সৈকতের নরম বালির উপর ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে যায়।
সাতঃ
ইলা সমুদ্রের দিকে মুখ করে কি যেন ভাবছে। তার প্রথম স্বামী শওকতের আজ তের তম মৃত্যুবার্ষিকী। অনেক অনেক ভালাবাসার মানুষটিকে সে কাছে পাবার আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। জহিরুল তাকে অনেক অনেক ভালবাসে সত্যি। কিন্তু তার ভালোবাসা দিয়ে শওকতকে হারানোর ব্যথা প্রশমিত করা গেছে কিনা সে জানে না। সমুদ্র পানে চেয়ে তার চোখে যে অশ্রু তা সুখের নাকি দুঃখের তা সে স্থির করতে পারে না। একবার মনে হয় তার জীবন বরাবরই সুখের তরীতে ভাসমান। আবার পরক্ষনেই মনে হয় সে চরম দুঃখীদের একজন। যার সব থেকেও কিছুই নেই। সুখ-দুঃখের এই বিপরীত মুখী স্রোতে সে কিছুটা দিশেহারা। জীবন তাকে সুখ-দুঃখের সব ধরনের স্বাদই দিয়েছে। কিন্তু সব স্বাদ গ্রহন করার মত ক্ষমতা তাকে দেয়া হয় নাই। বাতাস যেমন বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের দিক নির্দেশ করে দেয় তেমনি সেও নিয়তি দ্বারা চালিত। জীবনে বেঁচে থাকার চালিকা শক্তি তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে কি না সে জানে না।
ইলার চোখ ভেজা। সায়রা তার মাকে দেখে বলে, “তুমি কি করছ”? ইলা সায়রার ডাকে সংবিৎ ফিরে পায়। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে মেয়েকে বুকে তুলে নেয়। সায়রা তার মাকে আসল প্রশ্ন করতে ভুলে যায়।
সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাকে বলে “সমুদ্দের দুষ্ট ঢেউ আমার ফুট প্রিন্ট মুছে দিচ্ছে কেন মা”? ইলা তাকিয়ে দেখে ঢেউ এসে ওর ছোট পায়ের চিহ্নগুলোকে গ্রাস করে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে স্বান্তনা দিয়ে সে বলে, “দুষ্ট ঢেউ ফুট প্রিন্ট মুছে দিচ্ছে যাতে তুমি আবার তোমার ফুট প্রিন্ট দিতে পার”।
ইলা আবার দিগন্তের দিকে মাথা রাখে। সায়রা তার মাকে হাত উঁচিয়ে দিগন্ত রেখা দেখিয়ে বলে, “ওইখানে কি আছে মা”?
ইলা ছোট মেয়ের কথার উত্তর দেয়ঃ
- ওটা সীমান্ত রেখা। ওইখানে আকাশ আর সমুদ্র মিশে গেছে।
- তার পরে কি আছে, মা?
- তারপরে শুধুই আকাশ।
- আকাশে কি আছ, মা?
- ওখানে আছে আমাদের ভালবাসার মানুষ যারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে।
- ওরা কি করে?
- ওরা আমাদেরকে দেখে
- কেন আমাদেরকে দেখে?
- ওরা আমাদেরকে অনেক অনেক মিস করে তো সেই জন্য দেখে।
- আমরাও কি ওদেরকে মিস করি
- হ্যাঁ। আমরাও ওদেরকে অনেক অনেক মিস করি।
ছোট্ট সায়রা ইলাকে অনবরত প্রশ্ন করে যায়।
(চলবে)
জামাল সৈয়দ
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র