somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিউশনির দিনগুলি-১

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সে অনেক আগের কথা। বছর পঁচিশ তো হবেই। প্রথমেই বলে রাখি আমার নাম জামাল। যদিও নামের প্রথমে সৈয়দ আছে কিন্তু সৈয়দ তো আর ডাকনাম হতে পারে না। এইটা হল টাইটেল। ডাকনাম হচ্ছে যে নামে মানুষ কাউকে ডেকে শান্তি পায় এবং যা আমরাও শুনতে অভ্যস্ত। ভারিক্কির দিক দিয়ে জামাল নামটির ওজন একদমই কম। এই ধরনের নাম সাধারানত হয় রিকশাওয়ালা, কুলি-মজুর টাইপের মানুষদের। বড়জোর হয়ত এলাকার মুয়াজ্জিনের অথবা স্কুলের বদরাগী আরবি শিক্ষকের। তবে কালে ভদ্রে মন্ত্রী মিনিস্টারদেরও নাম হতে দেখেছি। তবে দেশ চালানোর দিক দিয়ে তারাও হয় অসৎ। আসল ঘটনায় ফিরে আসি। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। পড়ালেখা চালানোর পাশাপাশি একটা টিউশনি করি বাসাবোতে। ছাত্র উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্র। নাম পিনাক। ক্লাস ফোরে পড়ে। সপ্তাহে চার দিন বাসায় গিয়ে পড়াতে হয়। মোটামুটি সব সাবজেক্টেই।



আমি বিশ্ববিদ্যালায়ের শ্রাবণ বাসে চড়ে বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দিরের দিকে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে ছাত্রের বাসায় কলিং বেল বাজাই। বেল বাজানোর পর কিছুক্ষন দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনি। তারপর কিছুটা ফিসফিস করে কথাবার্তা। ছাত্রের মা ও ছেলের ব্যাক্য বিনিময়। প্রায় মিনিট সাতেক অপেক্ষা করার পর আমি ছাত্রের সাক্ষাৎ পাই। মাথা নিচু করে হেলে দুলে পিনাক টেবিলের অন্য প্রান্তে এসে বসে। তার সাথে বই কলম থাকার পরিবর্তে প্রায়ই দেখতাম আজব আজব সব জিনিস নিয়ে হাজির। যেমন কোনদিন প্লাস্টিকের বালতির ভেতর এক পা ঢুকিয়ে ছ্যাচরাতে ছ্যাচরাতে আসতো। আবার কোনদিন হয়ত হাতে দড়ি নিয়ে টেবিলে আসতো। পিনাক টেবিলে বসার এক মিনিট পরেই ছাত্রের মা আসতেন। উনার বিষয় ছিল গত দুই এক দিনে ছাত্র কি কি দুষ্টামি করেছে তার একটা সারমর্ম দেয়া। আর সাথে সাথে আমাকে মনে করিয়ে দেয়া যাতে আমি ছাত্রকে ইচ্ছামত শাস্তি দেই। মোটামুটি এই ছিল প্রতিদিনকার টিউশনি করার রেওয়াজ। আমিও মনোযোগ দিয়ে ছাত্রের মায়ের অভিযোগ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে কোনদিনও ছাত্রকে শাস্তি দেইনি। শাস্তি দেয়া আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না। আইডিয়াল স্কুলে থাকা অবস্থায় নিজেই এমন সব শাস্তি পেয়েছিলাম যে কারনে মনে হতো শাস্তি দেয়া শিক্ষক হচ্ছে আজরাইলের বন্ধু। স্কুলে থাকতে আমার এক বন্ধু মহান এক উক্তি করেছিল। তা হল যে সমস্তু শিক্ষকরা ক্লাসে এসে ছাত্রদের পেটায় তারা নাকি বাসায় স্ত্রীদের আদর-আমেশ বা সান্নিধ্য পায় না। অথবা তাদের দাম্পত্য জীবন সুখকর নয়। আজ এত বছর পরেও আমার মনে হয় বন্ধুর উক্তিতি ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। আমি অবশ্য জানতে ছেয়েছিলাম যে তাহলে তো যে সমস্ত শিক্ষিকারা ছাত্রী পেটায় তাদের ক্ষেত্রেও তো একই যুক্তি প্রযোজ্য। অর্থাৎ তারাও স্বামীর সান্নিধ্য পায় না।

গ্রীষ্মের এক ভর দুপুরে আমি শ্রাবণ বাসে চড়ে বাসাবোতে নামলাম। বিকেলে ক্লাস ছিল না বলে ভাবলাম দুপুরে টিউশনি সেরে একবারে বাসায় যাব। প্রচণ্ড গরম। তার উপর আবার যুদ্ধ করে বাসে চড়তে হয়েছে। এমনিতেই মাথা ও শরীর গরম। আমি কলিং বেল বাজালাম। কিছুক্ষন পর দরজা খুলে গেল। আমি বসলাম। পাশের রুমের যথারীতি দৌড়ঝাঁপের শব্দ শুনলাম। আমার ছাত্র মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাজির হল। বেশ সময় নিয়ে টেবিলের ওপাশে বসলো। সেইদিন তার হাতের পাশে ক্রিকেটের ব্যাট আর বল। আমি বললাম এখন থেকে পরবর্তী এক ঘণ্টা কোন ব্যাট আর বল এখানে থেকে নড়তে পারবে না।

- ঠিক আছে স্যার। আমি ওগুলো ধরবো না।

ইতিমধ্যেই ছাত্রের মা এসে গত দিনের কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনার সারমর্ম দিলেন। পাশাপাশি বলে গেলেন যে ওর স্কুলে লম্বা ছুটির আগে অনেক হোমওয়ার্ক দিয়েছে। সেইগুলোর মধ্যে কয়েকটি আবার পরের ক্লাসেই নিয়ে যেতে হবে। তার মধে ছিল ‘Tulip’ ফ্লাওয়ারের উপর একটা রচনা, Four Noble Truth about Buddhism – এর উপর একটা বড় চ্যাপ্টার পড়ে তার বেশ কিছু উত্তর বের করা। এইগুলো ছাড়াও নিয়মিত অঙ্ক ও আরও কিছু বিষয়ে ছাত্রকে সাহায্য করা। মাস শেষে এগারশত টাকা টিউশনি অনেক বড় অঙ্কের শোনালেও মাঝে মাঝে মনে হতো এর চাইতে ভাল ঢাকার রাস্তায় স্কুটার চালানো। ইংরেজিতে বড় আকারের টিউলিপ ফুলের রচনা লেখার চাইতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম একটি বটগাছের আত্নকাহীনি লিখতে। ঢাকার যে এলাকায় থাকতাম সেখানে কচুরিপানার ফুল ছাড়া জীবনে নামী দামি ফুলের খুব একটা সাক্ষাৎ মিলে নাই। যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা ফুল নিয়ে বেশি আল্লাদিপনা করতো তাদেরকে মনে হতো অস্বাভাবিক মানুষ। যাইহোক, ক্লাস ফোর পড়ুয়া ছাত্রের জন্য আজব আজব বিষয়ে রচনা লিখতে আমাকে রীতিমতো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে গিয়ে বইপত্র ঘাটাঘাটি করতে হতো। অবশ্য এতে করে কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞানলব্ধ হয়েছে।

সেইদিন আমার ছাত্র চেয়ারে বসেছে ঠিকই কিন্ত লক্ষ্য করলাম তার এক পা প্লাস্টিকের খালি বালতির ভেতর। সে পা নাড়াচ্ছে আর তা থেকে একটা বিরক্তিকর শব্দ তৈরি হচ্ছে। আমি বললাম বালতি থেকে পা বের করে সুন্দরভাবে পড়তে বসার জন্য। প্রথমবার বললাম কিন্তু মনে হল আমার কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আমি দ্বিতীয়বার ওকে প্রশ্ন করলাম যে সে আমার কথা শুনবে নাকি শাস্তি খাবে। সে তৎক্ষণাৎ খুব হালকা স্বরে উত্তর দিল ‘শাস্তি খাব’। মনে হল তার এই উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল যে আমি তাকে কখনই শাস্তি দেই না এবং ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সহসাই সে বলে ফেলল যে শাস্তি চায়। যদিও তার গলার স্বর ছিল হালকা। কালবিলম্ব না করে ওর গালে একটা চড় দিলাম। ও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গাল ধরে বসে রইল। আমি ভয় দেখানোর জন্য বললাম আজকেই ওকে পড়ানোর শেষদিন। এই হুমকিটা কাজে লাগতো। আমি ওর প্রতি মনোযোগ না দিয়ে হোমওয়ার্ক গুলোর দিকে চোখ দিলাম। আড়চোখে লক্ষ্য করলাম সে একইভাবে অনড় হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। চড় হজম করার জন্য হয়ত সময় নিচ্ছে। এভাবে নিস্তব্দতায় প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল।

- আমাদের পাশের ফ্লাটে গ্রাম থেকে একটা কাজের ছেলে এসেছে। সে ঐ বাসায় কাজ করে।

মাথা নিচু করে ও প্রথমে কথা বলা শুরু করলো। আমি ওর কথার সুত্র ধরতে পারলাম না। অপেক্ষা করলাম আরও কিছু শুনবার জন্য। ও বলে চলল,

- আমাদের বাসায় পানি না থাকলে ও পানি নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে আমাদের বাজার করে দেয়। ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে দিয়ে আসে। রিক্সা ডেকে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে ভারী মালামাল উঠানামা করে। গ্রামে থাকাকালীন সময়ে নাকি ওই ছেলেটা রিক্সাও চালাত।

পিনাকের কথা শুনে বিরক্তি হবার চাইতে আমি উৎসাহী হলাম বেশি। তখনও ওর কথার সুত্র ধরতে পারলাম না। কেনই বা সে এসব কথা আমাকে বলছে। ঐ কাজের ছেলের বৃত্তান্ত শুনে আমি কি করবো। একটু বিরতি নিয়ে পিনাক তার কথার শেষ ব্যাকটি উচ্চারন করলো।

- ঐ কাজের ছেলেটির নাম জামাল।

পুনশ্চঃ পিনাক এখন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। থাকে ঢাকায়। বিয়ে করেছে এবং একটা ছোট্ট বাচ্চার বাবা। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন পিনাক’কে দেখতে যাব প্রায় পঁচিশ বছর পর। (চলবে)

-জামাল সৈয়দ
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র

৮টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×