somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সোনালী ফসল

১৯ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হিউস্টন হতে আমিরাতের ফ্লাইট দুবাই পৌঁছালো দুপুর এগারটার দিকে। তারপর ঢাকা যাবার ফ্লাইট ঘণ্টা দুই বিরতি। কিছুক্ষন এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে চেয়ারে বসে একটু ঝিমানোর উদ্যোগ নিচ্ছিলাম। এমন সময় কেউ একজন পিছন থেক এসে বলল, ‘ডু আই নো ইউ? মাথা ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম আটাশ কি উনিত্রিশ বছরের এক সুদর্শন যুবক। হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। অফ কোর্স, ইউ আর আবিদ খান। বলেই তার দিকে হাত বারিয়ে দিলাম আলিঙ্গন করতে। খুব জোরে হাত চাপ দিয়ে ইংরেজিতে অনর্গল অনেকগুলি কথা বলে গেল। যার সারমর্ম হল যে সে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে আমিরাতের একই ফ্লাইটে। তার সাথে বউ আর আট মাস বয়সী একটা বাচ্চা আছে। সে নিউ জার্সি থেকে হিউস্টন হয়ে দুবাই এসেছে। বিরাট বড়সড় ফ্লাইট হওয়ায় হিউস্টনে আমাদের মধ্যে দেখা হয়নি।

আবিদ খানের সাথে আমার পরিচয় পর্ব শুরু করতে হলে আমাকে আরও পাঁচ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। আমি তখন ছাত্র। থাকি আমেরিকার হিমশীতল ঠাণ্ডা রাজ্য মিনেসোটাতে। জানুয়ারি মাসের এক বরফাচ্ছাদিত কনকনে শীতের রাত্রে টেক্সাস থেকে ফারুক নামের এক বড় ভাই কল দিলেন। উনি বয়সে আমার চাইতে অনেক বড় কিন্তু মিনেসোটায় থাকাকালে আমাদের মধ্যে অনেক সখ্যতা ছিল। ওনার স্ত্রী সাদা আমেরিকান। একটা কলেজে শিক্ষকতা করেন। মিসিসিপি নদী ঘেষে ফারুক ভাইয়ের ছিল একটা কেবিন হাউস। সেই কেবিন হাউসে ছিল একটা ইঞ্জিন বোট। গরমকালে উইকেন্ড হলে প্রায়ই ছুটে যেতাম তার কেবিন হাউসে। সকাল বেলা আমি আর ফারুক ভাই বোট নিয়ে মিসিসিপি নদীতে নেমে পড়তাম। নদীর কোথাও আইল্যান্ড পেলে সেখানে বিরতি নিয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতাম। সারাদিন পিকনিক পিকনিক টাইপের মজা করে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসতাম। ফেলে আসা সেই দিনগুলো ছিল অসাধারন আনন্দময়। যাইহোক, ফারুক ভাই সেই রাতে ফোন দিয়ে বললেন যে তাকে একটা বিরাট উপকার করতে হবে। তার এক বন্ধু যিনি দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের বাইরে ছিলেন তার একমাত্র মেয়ের জন্য একটা পাত্রের ব্যাপারে অনুসন্ধান রিপোর্ট বের করে দিতে হবে। সেই ছেলে থাকে মিনেসোটায়। একই শহরে যেখানে আমি থাকি। ছেলের নাম আবিদ খান। সে জন্মসুত্রে কাশ্মীরি-ভারতীয় তবে আমেরিকার নাগরিক। ফারুক ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে আর আবিদ খানের পরিচয় ঘটে অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে মেয়ের পরিবার আবিদ খানের সাথে স্কাইপির সূত্রে বেশ কয়েকবার কথাবার্তাও বলেছে। এখন সিরিয়াসলি কথা বার্তা পাকাপাকি হবে বিয়ের ব্যাপারে। আমাকে ফোন করার কারন হচ্ছে আমি যাতে সারেজমিনে গিয়ে ছেলের সাথে সাক্ষাত করি। যা বুঝলাম তা হল মুলত আমাকে স্বচক্ষে ছেলেকে দেখতে হবে এবং তার কাজ কর্ম ইত্যাদি সমন্ধে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। তারপর আমার পর্যবেক্ষণের উপর তারা সিদ্ধান্ত নিবেন ভিনদেশী ওই ছেলের সাথে সত্যিই বিয়ে দেয়া যাবে কিনা।

আমাদের জীবনে কিছু মানুষ আছে আছে যাদের জন্য সব সময়ই মন চায় কিছু একটা করার জন্য। কিন্তু হয় সুযোগের অভাবে তাদের জন্য কিছু করা হয়ে উঠে আর না আর না হয় তাদের জন্য করনীয় জিনিসটা থাকে আমাদের মত চুনাপুঠির সাধ্যের বাইরে। যেমন এই ধরনের মানুষের যখন টাকা পয়সার দরকার হয় তখন দেখা যায় তাদের দরকার এক লক্ষ টাকার ধার। আর তখন আমার কাছে থাকে বড়জোর দুই হাজার টাকা দেবার মত ক্ষমতা। এই হিসাবও আবার বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধার দেনা করার পর। মানুষ যত বড় হয় সমস্যাও হয় তত বড়। যাইহোক, ফারুক ভাইকে উপকার করার এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। আমি ততক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেলাম। উনি আমাকে আবিদ খানের ফোন নাম্বার দিলেন। সাথে তার ঢাকার বন্ধুকেও ই মেইলের মাধ্যমে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কয়েকদিন পর আবিদ খান কে ফোন করে তার সাথে সাক্ষাৎ করার দিনক্ষণ ঠিক করলাম। স্থান হিসাবে বেছে নিলাম একটা কফি শপ। এক শনিবার সকালে আমি আর আবিদ খান দেখা করলাম। প্রথম দর্শনেই ছেলেটাকে ভাল লাগলো। খুবই বিনয়ী স্বভাবের মানুষ। ওর সাথে ঘণ্টা খানেক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। কিছু ধরাবাঁধা প্রশ্ন করলাম। যেমন ভারতে এত সংখ্যক সুন্দরী রমণী থাকতে সে কেন বাংলাদেশী মেয়েটার প্রতি আসক্তি হল। তাছাড়া ভাষাগতও তো একটা পার্থক্য রয়েছে ইত্যাদি। উত্তরে বলল যে প্রথম প্রথম কথা বলেই মেয়েটিকে তার পছন্দ করেছে। তাছাড়া মেয়েটির পরিবারও নাকি বেশ কনজারভেটিভ। ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে। থাকে ঢাকার উত্তরায়। আলোচনার মাঝখানে আমি আবিদ খানের কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। পরদিন আমার অভিজ্ঞতার আলোকে ফারুক ভাইয়ের বন্ধুকে ই মেইলের মাধ্যমে একটা রিপোর্ট দিলাম। রিপোর্টের সারমর্ম ছিল অনেকটা ‘আবিদ খান’কে যে রকম দেখেছি ও ‘মনে হয়েছে’। আমার রিপোর্টে সাজেশন ছিল এই ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে দেয়া যেতে পারে। নিচে বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম এই বলে ‘পুনশ্চঃ মানুষের জীবনের ভুল ধরা পরে যদি কোন কিছু বিফল হয়। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে কোন ভুল বাহির হইলে দয়া করিয়া আমাকে দায়ী করিবেন না’।

সাক্ষাতের পর আবিদ খানের সাথে আমার মোট তিনবার ফোনে কথা হয়েছে। প্রথমবার সে ফোন করে বলল যে সে বাংলাদেশে যাচ্ছে । ইতিমধ্যে ভিসার জন্য তার পাসপোর্টও পাঠিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশী এম্ব্যাসিতে। দ্বিতীয় বারে সে ফোন করে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে। বলল যে সে বিয়ে করে এসেছে। তৃতীয় বার ফোন করেছিল এই বলে যে তার কাজ মিনেসোটা থেকে নিউ জার্সি মুভ করেছে। আমি ব্যস্ত থাকায় আর আবিদ খানের সাথে দেখা করতে পারিনি। তারপর যায় হবার তাই হয়। সময় ও স্রোতের সাথে সাথে আমিও আবিদ খানের কথা আস্তে আস্তে ভুলতে বসলাম।

আবিদ খানের ব্যাপারে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে দেখলাম আমিরাতের বোর্ডিং লাইন লম্বা হয়ে গিয়েছে। আমি লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার একটু সামনে আবিদ খানও লাইনে দাঁড়িয়েছে। কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে। ডাগর ডাগর চোখে চারিদিকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আবিদ খান তার লাইন ছেড়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে তার স্ত্রী। পরিচয় করিয়ে দিল। স্ত্রী সুরাইয়া আর বাচ্চাটির নাম সোনালী। বয়স আট মাস। ওরা নিউ জার্সিতেই থাকে।

প্লেন আকাশে উড়ার পর লম্বা ঘুম দিলাম। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন প্লেন বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে গেছে। আর অল্প সময়ের মধেই হয়ত ঢাকায় পৌঁছে যাব। জানালা দিয়ে নিচে দেখালাম চির পরিচিত বাংলার মাঠ-ঘাট। চারিদিকে সোনালী শস্য ক্ষেত। বিকেলের নরম রৌদ্রে চিকচিক করছে। তখন বাংলার কি মাস মনে নেই। তবে নিশ্চয়ই ফসল কাটার সময়। অনেকদিন হয় দেশে থাকি না। গ্রাম বাংলায় এখনও আগের মতো নবান্নের উৎসব হয় কিনা জানিনা। তবে চিন্তা করতেই ভাল লাগে। আর কিছুক্ষনের মধেই প্লেন মাটি স্পর্শ করবে। আমার তন্দ্রাছন্ন ভাব কেটে গেল একটা শিশুর কান্নার শব্দে। মাথা উঁচিয়ে দেখলাম আবিদ খান আর সুরাইয়ার মেয়ে সোনালী কাঁদছে। বাবা-মা দুজনেই ওর কান্না থামানোর জন্য চেষ্টা করছে। প্লেনে শিশু কান্না করলে আমি মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্ত শিশু সোনালীর কান্নার শব্দ আজ বেশ মধুর লাগছে। হঠাৎ করেই অজানা কারনে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ভূপৃষ্ঠে সোনালী ফসলে ভরপুর বাংলার মাঠ। এদিকে শিশু সোনালী কেঁদে চলেছে একটা ছন্দের তালে। এই ছন্দে জীবন তার প্রান খুঁজে পায়। এই ছন্দ জীবনের বেঁচে থাকার প্রেরনা।

-জামাল সৈয়দ
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×