লোকটাকে ইউনিভার্সিটির অনেকেই জানে 'টম দি বারবার' নামে।ছোট একটা সেলুনেই তার জীবনের সিংহভাগ কেটে গেল। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি।একটু নাদুস-নুদুস ধরনের শেতাঙ্গ আমেরিকান টম। মিনেসোটার সেইন্ট ক্লাউড স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ছিল তার চুল কাটার সেলুন। নাম 'টম বারবার শপ'। পুরনো ধাঁচের ওই সেলুন'টিতে চার পাঁচটি বসার চেয়ার।এক পাশের দেয়ালে বিরাট দুইটি আয়না আর চারপাশের দেয়াল ভরা যিশু খ্রিস্টের ছবি ও মূর্তি। এক একটি মূর্তি'র এক এক অবস্থান। চেয়ারের যেদিকেই বসা হোক না কেন আয়নার উপর মূর্তির প্রতিফলনে মনে হবে যিশু খ্রিস্ট সব দিকেই তাকিয়ে আছেন। চুল কাটার সরঞ্জাম রাখা একটা লম্বামত উচূ টেবিলের সাথে ছোট একটা শেলফ। তাতে একটি বাইবেল ও আরও কিছু ধর্মীয় বই। সেলুনের পরিবেশ দেখলেই মনে হবে এই সেলুনে যে কাজ করে সে একজন ধর্মীয় সাধক টাইপের মানুষ। টমের হাতের নিকটে যে বইটি তা উল্টানো অবস্থায় টেবিলের কাঠের সাথে মিশে আছে। মনে হবে বইটিও মাথা নিচু করে স্রষ্টার উপাসনায় মক্ত। অন্য বইটি অর্ধেক খোলা অবস্থায় টেবিলের উপর বসে আছে তবে ফ্যানের বাতাসে কিছুক্ষণ পরপর একটি দুটি পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। টম ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্রদের নিকট বেশ পরিচিত একটি নাম। বিশেষ করে আমাদের মত বিদেশী ছাত্রদের কাছে। কারণ ওর ওখানে খুব সস্তায় চুল কাটা যায়। অন্যত্র যেখানে প্রায় দশ ডলার লাগে চুল কাটতে সেখানে মাত্র পাঁচ ডলার দিলেই টম খুশি। তাছাড়া বকশিশ দিতে হয় না। উপরন্ত টম আগ বাড়িয়েই অনেক গাল-গল্প করে বিদেশী ছাত্রদের সাথে। সে নিজে থেকেই তার পরিচয় দিত 'টম দি বারবার' বলে। তার বেশির ভাগ আলোচ্য বিষয় থাকতো ধর্ম নিয়ে। কবে সে যিশু খ্রিস্টের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তাকে কি কি উপদেশ দিয়েছেন, মানব জাতির কল্যান কিভাবে সম্ভব এইসব বিষয়াদি আর কি।
প্রথম প্রথম টমের সাথে গল্প করতে খুবই ভালো লাগতো। তারপর আস্তে আস্তে ভালো লাগা কমে গেল কারণ তার বেশির ভাগ গল্পই ঘুরে ফিরে ধর্ম সম্পর্কে। একদিন প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য ওর পরিবার ও জীবন সমন্ধে জানতে চাইলাম। ওর পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত, কতদিন যাবত সে ওই সেলুনে কাজ করে ইত্যাকার প্রশ্ন। ওর উত্তর শুনে কিছুটা খারাপই লাগলো। টমের জীবন সংসারে আপনজন বলতে কেউ নেই। মিনেসোটার উত্তরের দিকে কোনো এক ছোট শহরে ওর জন্ম। জ্ঞান হবার পর যতদূর জেনেছে ওর বাবা-মা ডিভোর্স। বাবা মারা যাবার আগ পর্যন্ত ছিল ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন। পথই ছিল তার শেষ ঠিকানা। নিজের জীবনের কঠিন বাস্তবতায় তার বাবা কোথায় থাকতো, কি করত খুব একটা জানার প্রয়োজন বোধ করেনি। সে মায়ের আশ্রয়ে কিছুদিন থাকলেও ওর বয়স যখন আট তখন মা অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে অন্যত্র পাড়ি জমান। সে বড় হয়েছে তার দাদীর কাছে। আপনজন বলতে এক ভাই আর এক বোন ছিল অনেক আগে। জীবিকার তাগিদে ওরাও যে যার মতো অন্যত্র চলে গিয়েছে। প্রায় ২৫ বছর হয় তার ভাই বোনদের সাথে দেখা হয় না। বিয়ে করেনি কেন জিজ্ঞেস করাতে বললো সারা জীবনে তার স্বপ্ন ছিল অপরূপ কোনো সবুজ বা নীলাভ নয়নের রমনী'কে বিয়ে করবে। তবে বাস্তব জীবনে তার আর বিয়েই করা হয়ে উঠেনি। টমের জীবনে সেই অপরূপ নীলাভ বা সবুজ চক্ষুবর্ণ বিশিষ্ট নারী কখনও দেখা দেয়নি। যৌবনের প্রথমে দু'এক জন নারী যে তার জীবনে প্রভাব ফেলেনি তা নয় তবে তাদের অবস্থান ছিল তার স্বপ্নের রমনীর চাইতে অনেকটাই দূরে। পরে জেনেছি টমের জন্মস্থান বৃহৎ মিসিসিপি নদীর উত্সস্থল লেক আইটাস্কার কাছাকাছি ছোট এক শহরে। সময়ের পরিক্রমায় মিসিসিপি নদীর জল মিনেসোটা থেকে প্রবাহিত হয়ে হয়ত হাজার মাইল দূরে গিয়ে সাগরে পড়েছে কিন্তু টমের নীলাভ বা সবুজ চক্ষুবর্ণ নারীর স্বপ্ন এক চুলও নড়েনি। স্বপ্ন তার সতেজই ছিল অনেক বছর কিন্তু বাধ সেধেছে তার বয়স। স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে অনেকগুলো বছর পার করে দিয়েছে কিন্তু মনের মানুষ আর খুঁজে পেল না। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে সে তার চোখের মানুষ আর এ জীবনে খুঁজেই পেল না। টমের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। প্রথম জীবন সে আর্মি তে ছিল। তারপর অবসর নেয়ার পর সে চূল কাটার পেশা গ্রহণ করে। সম্বল বলতে সেলুনের জমিটুকু যা পেয়েছিল দাদীর কাছ থেকে। তার জীবনের আনন্দ বলতে এখন শুধু স্রষ্টা'র বাণী প্রচার এবং তাকে খুশি করানোর মধ্যেই সীমিত। আপাদমস্তক একজন ধর্মীয় নিবেদিতপ্রাণ ব্যাক্তি।
আজকের লেখার উপপাদ্য বিষয় টম'কে নিয়ে নয়। সে রূপক অর্থে আমাদেরই একজন। আমার এক বন্ধু আমেরিকাতেই থাকে। গত এগারো বছর যাবৎ সে বিয়ে করার জন্য হন্য হয়ে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রায় আট বছর আগে তার জন্য দুই তিনটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখলাম কোনো সম্বন্ধই কার্যকরী হয়নি। সে প্রথমজন'কে যদি ফিরিয়ে দিত মেয়ের গায়ের রঙ 'একটু শ্যামলা' বলে তো দ্বিতীয় জনকে ফিরিয়ে দিত মেয়ের উচ্চতা একটু কম বলে। আবার তৃতীয় জনকে অনির্বাচিত করার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল মেয়েটি একটু বেশি বাঙালীয়ানা টাইপের। পরবর্তীতে বন্ধুটির জন্য আরো কয়েকটি সম্বন্ধের সন্ধান দিয়েছিলাম এক ঘটকের মাধ্যমে কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কাউকেই তার পছন্দের পাত্রী বলে গন্য হলো না। যেই মেয়েটিকে তার একটু একটু পছন্দ হলো সেই মেয়েটিও আবার বন্ধু'টিকে প্রত্যাখ্যান করলো কোনো এক অজানা কারণে। যে কোনো সম্বন্ধ নিয়ে আসলে বন্ধুটির অভিযোগ যে খুব বেশি প্রখর ছিল তা নয়। প্রায় সবগুলোর কারনই শুরু হতো 'একটু' দিয়ে। হয়ত মেয়েটির মধ্যে কোনো কিছু একটু কম বা 'একটু' বেশী এই টাইপের অভিযোগ। এইভাবে কয়েক বছর যাবার পর বন্ধু'টির সাথে আমার বন্ধুসুলভ আলোচনার একটা সীমানা নির্ধারণ করে দিলাম এই বলে যে আমরা যে কোনো বিষয়ে আলাপ করতে পারব শুধু মাত্র তার বিয়ে বা সম্বন্ধ নিয়ে আসা বিষয়ক কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া। তাছাড়া পৃথিবীর অন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা করতে আমাদের কোনো সমস্যা থাকবে না। অবশ্য এতকিছুর পরও আমি ওকে একবার প্রশ্ন রেখেছিলাম যে বাংলাদেশের সব ছেলেরা যদি সব ফর্সা মেয়েদের বিয়ে করে ফেলে তাহলে 'একটু শ্যামলা' মেয়েদের গতি কি হবে? অথবা সবাই যদি উচু উচু মেয়ে খুঁজে বিয়ের করে ফেলে তাহলে কম উচু পাত্রীদের কি হবে। যদিও ওর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি যা আমি আশাও করিনি। এরপর বন্ধুটির সাথে কালে ভাদ্রে কথা হতো কিন্তু খুবই স্বল্প সময়ের জন্য।
কয়েক সপ্তাহ আগে এক শনিবার রাত্রে বন্ধুটি আমাকে ফোন করলো। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞাস করলাম সে কেমন আছে এবং জীবন তার সাথে কি রকম ব্যাবহার করছে? সে বললো যে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। সে এখন বিষন্নতার রোগী। তার ভাষানুযায়ী সে গত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাত্রী খুঁজলেও এখনও পর্যন্ত কাউকে খুঁজে পায়নি। এই না খুঁজে পাওয়াটাই তার কাল হয়ে দাড়িয়েছে। তার মনের ভেতর পাত্রী না পাওয়ার ভয় বিষন্নতার জন্ম দিয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সে নিয়মিত ঔষধ সেবন করছে। ডাক্তার বলেছে এই মুহূর্তে তার উচিত হবে পরিবার বা আপনজনের আশেপাশে থাকা। কিন্তু ওর আশেপাশে কেউ নেই আর আপনজন বলতে একজন রুমমেট যার সাথে সপ্তাহে এক কি দুই'বার দেখা হয়। দেখা হলেও আলাপের বিষয় থাকে কাজ-কর্ম অথবা রুমমেট হিসাবে নিজেদের খরচের হিসাব-নিকাশ। ওর 'পাত্রী- শিকারী' টাইপের মনমানষিকতা দেখে অনেক বন্ধু আগে থেকেই ওর সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। বিষন্নতার জন্য ওর উচ্চ বেতনের চাকুরীও হুমকির মুখে। আমার সাথে পরামর্শ করতে চায় এই অবস্থায় তার দেশে চলে যাওয়া উচিত হবে কিনা। আমি তাকে বলার মত কোনো সদুত্তর খুঁজে পেলাম না।
বন্ধুটির ফোনালাপ সেরে ঘুমাতে গেলাম। চোখ বন্ধ করতেই আমার চোখে ভেসে এলো সেই 'টম দি বারবারে'র মুখচ্ছবি। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল টমের জীবনে কি সেই অপরূপ নীলাভ বা সবুজ চক্ষুবর্ণ বিশিষ্ট রমনী কখনও দেখা দিবে না? সে কি এখনও স্বপ্ন দেখে নাকি তার স্বপ্নের অপমৃত্য হয়েছে? মানুষ স্বপ্ন পোষণ করে পাহাড়-পর্বত, মহাসাগর পাড়ি দিতে পারে কিন্তু সুউচ্চ স্বপ্ন নিয়ে কি সে মানুষের মন জয় করতে পারে কখনও?
-জামাল সৈয়দ
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র