রহস্যময় যাত্রী
-জামাল সৈয়দ
পড়ালেখা করে যে গাড়ী-ঘোড়া চড়ে সে। ঘোড়াতে চড়ার দিন প্রায় শেষ। আর গাড়ীতে চড়া ছাড়া মানুষের যাতায়াতের খুব বেশী একটা বিকল্প নেই। ছোট বেলায় বাবার একমাত্র হুমকি ছিল পড়ালেখা কর। পড়ালেখা না করলে সারাজীবন রিকশা চালাতে হবে। এই হুমকি বা ভয় এতবার শুনতে হয়েছে যে কল্পনা জগতে এক সময় নিজেকে রিকশা চালকের আসনে দেখতে শুরু করি। নানান রঙ দিয়ে সাজানো আমার রিকশা। রিকশার দুই পাশে সাদা অক্ষরে লিখা ‘মায়ের আশীর্বাদ’। বাবার কথামতো পড়ালেখা না করে আমি হই রিকশাচালক। আর মায়ের আশীর্বাদে রিকশার মালিক। বড়ই অদ্ভুত এই দুনিয়ার কেরামতি। আমার রিকশার উল্টো দিকের নিচে বাংলা সিনেমার একটা রঙ্গিন পোস্টার আঁকা। শুক্কুর মিস্ত্রীর নিজের হাতে আর্ট করা। নায়িকা ববিতা পানি ভর্তি একটা কলসী কাঁধে নদী থেকে মেঠো পথে বাড়ী ফিরছে। অদূরেই একটা বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে নায়ক রাজ্জাক দাঁড়িয়ে। বাঁশি বাজাচ্ছে। ববিতার মুখে শাড়ীর আঁচল। লাজুক লাজুক চেহারা। তবে ববিতার গাল আর চোখ দুটো একটু বেশী ফোলা ফোলা।
রিকশা নিয়ে আমি ঢাকা শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াই। আমার যাত্রী হয় এক রূপবতী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী। রিকশার হুড খোলা থাকায় পাগলা হাওয়ায় তার মাথার চুল আকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই চুলের মিষ্টি গন্ধে চারিদিকে একটা মাতাল মাতাল ভাব সৃষ্টি হয়। রাস্তার মানুষ জনের দৃষ্টি থাকে আমার রিকশার দিকে। আমি বীরদর্পে রিকশা চালাতে থাকি। তারপর হঠাৎ শুরু হয় বৃষ্টি। আমি তড়িঘড়ি করে রিকশা থামিয়ে রিকশার হুড উঠিয়ে দিতে যাই। কিন্তু রূপবতী যাত্রী আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে হুড উঠাবার প্রয়োজন নেই। সে আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় যাবে। আমি নতুন উদ্যোমে রিকশায় পা চালাই। ঝড়ো হাওয়ায় এদিক ওদিক গাছ গাছালির ডাল-পালা রাস্তার পাশে পড়ে থাকে। বৃষ্টির পানিতে ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাট ঢাকা পড়ে। চারিদিকে নেমে আসে আঁধার। আমি তার মধ্যেও রিকশা চালিয়ে যাই। বৈরী আবহাওয়ার প্রতি আমার যাত্রীর লেশ মাত্র ভয় নেই। মনে হয় সে ভয়কে জয় করতে শিখেছে। যাত্রীর সাহস দেখে আমি মনে মনে খুশি হই। তাকে উৎসর্গ করে একটা কবিতার দুটি লাইন মনে মনে স্বরণ করিঃ
“চারিদিকে বইছে যখন বৈরী হাওয়া
ঠিক তখুনি তোমার কাছে আমার চাওয়া”।
এই কবিতার কবি কে আমি তা জানি না। তাতে কি আসে যায়। রিকশাওয়ালারা অনেক কিছুই যানে না। জানবার প্রয়োজনও নেই।
হঠাৎ করে খুব জানতে ইচ্ছে করো যাত্রীর পরিচয়। কিন্তু রিকশাওয়ালা বলে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারি না। তার নামটাও জিজ্ঞেস করবার দুঃসাহস নেই। আমি হলাম রাস্তার রাজা। বৃষ্টিবাদল, ঠাণ্ডা গরম বাইরে যাই থাকুক না কেন আমার কাজ মানুষকে নিয়ে ছুটে চলা। বিধাতা আমাকে সেই শক্তি ও সাহস দিয়াছেন বটে। যখন পা চালাই তখন আমার পেশীগুলো বাইরে থেকে বেশ দৃশ্যমান হয়। অনেকটা আঁকা-বাঁকা নদীর মতো। যখন ঘর্মাক্ত হই তখন আমার দু’পায়ের পেশীতে ভেসে উঠে বাংলাদেশের নদি-নালার প্রতিচ্ছবি।
মনে মনে আমি যাত্রীর একটা নাম খুঁজে বেড়াই। কি নাম দেয়া যায় এই রহস্যময় নারীর। আচ্ছা, আগুণী নামটা কেমন? আগুনের মতো সুন্দর দেখতে সে। কিন্তু এখন তো ঝড় হচ্ছে। তার নাম দেয়া যায় তুফানী। তুফানের মতো গতিশীল সে।
মালিবাগের একটা দেয়াল ঘেরা সাদা বাড়ীর সামনে এসে আমার রিকশা থামে। যাত্রী আমাকে একটা পাঁচশত টাকার নোট দিয়ে বলে এখান থেকে তোমার ভাড়া রাখ। আমি বলি এত বড় নোটের ভাংতি নাই। যাত্রী বলে, দুশো টাকা ফেরৎ দিলেও হবে। আমি বলি, ‘আপনিই আমার প্রথম। আমার কাছে কোন ফেরৎ টাকা নাই’। বেশ, ‘তুমি কি আমাকে আবার আজিমপুর নিয়ে যেতে পারবে’। আমি খুশি হয়ে বলি, জ্বি। তাহলে তুমি এই নোটটা রাখ। আর কিছুক্ষন অপেক্ষা কর। আমি একজনের সাথে দেখা করে শীঘ্রই ফিরে আসব।
ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে আমিও কিছুটা ক্লান্ত। গামছা দিয়ে মাথা ও শরীর মুছে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য রিকশার সিটে গিয়ে বসি। অপেক্ষা করি আমার যাত্রীর জন্য। যাত্রীর দেয়া পাঁচশত টাকার বড় নোটটা সযত্নে সিটের নিচে লুকিয়ে রাখি। তারপর রিকশার হুড তুলে একটু মাথা এলিয়ে দিই।
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাতাসে তখনও শুনশান শব্দ। ঝড়ের কারনে শহরের রাস্তাঘাট ও বাড়ী ঘরে কারেন্ট নেই। একটা মা কুকুর এসে আমার রিকশার সামনের চাকার দিকে শুয়ে আছে। মা কুকুরটি বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে। তার কোলের উপর একটা বাচ্চা কুকুর মাথা গুঁজে আছে। কিছুটা উষ্ণতা খুঁজছে। আমি ইতস্তত করে সাদা বাড়ীর সামনের গেটে কিছক্ষন পায়চারি করি। কিছুটা ভয় হয়। কেউ যদি আবার চোর ভেবে পুলিশে দেয়। যাত্রী আমাকে ঘুমন্ত দেখে কি চলে গেছে নাকি এখনও বেড় হননি। কতক্ষন পার হয়েছে তাও বুঝতে পারি না। বড় বাড়ীর দোতলার একটা কক্ষ থেকে মোমবাতির টিপ টিপ আলো কিছুক্ষন পর পর ঝিলিক মারে। ওখানেই কি যাত্রী আছে না কি সে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আমার কাছে তার বড় টাকার নোটটা এখনও আছে। সে তো আমার সাথেই ফিরে যেতে ছেয়েছিল। চারিদিকে নিস্তব্দতা আমাকে বিচলিত করে তলে। আমি উপায়ন্তর না দেখে রিকশায় সিটে গিয়ে বসি। মা কুকুরটি তখনও পরম স্নেহে তার বাচ্চা’কে উষ্ণতার দেয়ালে ঢেকে রেখেছে। রহস্যময়ী নারী ও সাদা বাড়িটিকে পেছনে ফেলে আমি রিকশায় পা চালাই। একসময় অন্ধকারে হারিয়ে যায় সেই বাড়িটি। আমি মলিন মুখে রিকশা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠি। আমার মস্তিস্ক জুড়ে খেলা করে রহস্যময় যাত্রী। - (চলবে)
-জামাল সৈয়দ
মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৮:৪৯