চল বৃষ্টিতে ভিজি। এই মধ্যরাতে তোমার মাথা ঠিক আছে তো? তোমার কি মনে হয়? অরোরার তাৎক্ষনিক প্রশ্ন। তীতু বলল, এটা ডাক্তারী বিষয়, তবে বলতে পারি মাথা ঠিক থাকলেও, ওটা ঠিক জায়গাতে নেই। আমার হাতে আর রক্ত চলাচল করছেনা। অরোরা রেগে গেল। মাথা সরিয়ে বালিশে রাখল। ভাবে জীবনে সে কি চেয়েছিল আর কি পেয়েছে। অনেক মেয়েইতো মাথার উপর একটা ছাদ আর পায়ের নিচে একটা স্বামী চায়। আর আমিতো চেয়েছি শুধু সে আমার পাশে থাকুক। এখন পাশে আছে ঠিকিই তবে সুযোগ পেলেই গভীর ঘুম। অরোরার ঘুম আসে দেরীতে। রাত্রের অন্ধকারে অরোরা ভয় পায়। ওর প্রায় মনে হয় ছাদে করা যেন হাটাহটি করছে। ফিসফিস করে কথা বলছে। স্বামী প্রবর সবই জানে। জানে বলেই সুযোগ পেলেই ভয় দেখায়। ফলাফল সে নিশ্চিত জানে। জড়িয়ে থাকা বধূর নিশ্চিত নিরাপত্তার স্পর্শ তার বুকে যখন লাগে, অদ্ভূত অনুভূতিগুলো রক্তের ভিতর দিয়ে মাথার মধ্যে ভালোলাগার আবেশ ছড়ায়। আচ্ছা এত রাতে তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করল কেন? জান তুমি পাশের রুমে আব্বা-আম্মা ঘুমাচ্ছে। আর তাছাড়া ঠান্ডা লাগতে পারে। কথা শুনে অরোরার মেজাজ খারাপ হয়।আমি বুঝতে পারিনা তোমার মত একটা কাপুরুষের নাম কেন যে আব্বা তীতুমীর রেখেছিল। ভীতুমীর রাখলে ভালো হত। কথাটা বলতে পেরে অরোরা মনে মনে স্বস্তি পায়। হাসি পায় তার। ভাবে তীতুর মুখটা দেখতে পারলে খুব মজা পেতো সে। তীতুমীর রেগে যায়। আচ্ছা তোমার নামতো অরোরা, মানে মেরু- জ্যোতি, এত সুন্দর নামটা এমন অজায়গায় রাখল কে? অরোরা কথাটা শুনে কষ্ট পায়। বলে, এতই যদি অসুন্দর হয়ে থাকি, তোমার আমাকে বিয়ে করতে বলেছিল কে শুনি? তাছাড়া কলেজে যখন যেতাম তখন ওরকম ভ্যাবলার মত চেয়ে থাকতে কেন? তাও আবার মোড়ের উপর ঐ মুচির দোকানটায় বসে।আমার বান্ধবীরা ঠিকই বলত। কি বলত তোমার বান্ধবীরা? বলত তোমাকেও নাকি ওদের ঠিক মুচির মতই লাগত। উহু, অরোরা জোরে চিৎকার করে ওঠে। তুমি,তুমি আমার গায়ে এত জোরে চিমটি কাটলে কেন? সে রাগে তোতলাতে থাকে। তীতুমীর বলল কেন খুব লেগেছে নাকি? দুঃখিত পুরানো ব্যবসার কথা ভুলতে পারিনে। তাইতো দেখলাম তোমারটার অবস্থা কেমন।আর তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার বান্ধবীদের আমাকে সেদিন গোয়ালার মত লাগেনি। তুমি একটা অসভ্য,একটা জ্যান্ত খাটাশ। আচ্ছা অরো তুমি কি কখনও খাটাশ দেখেছ? অরোরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। বলে দেখিনিতো তাতে কি হয়েছে? তবে বললে কেন আমি একটা খাটাশ? শোনো তীতু তুমি একদম আলাদা। পৃথিবীর সব জন্তুর বৈশিষ্ট্য এক জায়গায় করলেও একটা তুমি হবে না। সে দেখি আর না দেখি।তাতে কোন যায় আসে না।আচ্ছা এই প্রানীগুলোর মধ্যে কি মশা পড়ে? জিজ্ঞাসা করে তীতুমীর। কেন বলত? অরোরা জিজ্ঞাসা করে। না ভাবলাম তুমি হয়ত মশা নামক প্রানীগুলোকে বেশ পছন্দ কর। বুঝলাম না তোমার কথা? অরোরা জিজ্ঞাসা করে। না মশারী টঙানো হয়নিতো তাই বললাম।আর ঠিকই তো আছে । আমারই ভুল,বলে তীতুমীর। আমিতো মশার মত আর সারারাত তোমাকে চুমু খেতে পারবনা। আচ্ছা তীতু তুমি কি কোন কথা সহজ ভাবে বলতে পারনা? অভিমানে অরোরার চোখে পানি আসে।ও উল্টো দিক মুখ করে শোয়। সারাদিন কান্তিহীন খাটুনি। তারপরও সে মশারী টাঙাতো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঠান্ডা আবহাওয়া। ভেবেছিল বোধ হয় মশা কম আসবে। তাছাড়া বৃষ্টির সময় মশারী দেয়া থাকলে,অরোরার খুব খারাপ লাগে। বাইরে বিচিত্র জীবনের খেলা চলছে, সে তখন খাঁচায় আবদ্ধ। ভাবতেই খারাপ লাগে অরোরার। তীতুমীর বোঝে বধূ তার খুব রাগ করেছে। এই অবোধ অভিমানিকে সে যে কতটুকু ভালোবাসে, তার মুখের উপর প্রকাশিত সবটুকু চিহ্নই গিলে খায় অঝর বৃষ্টির এই অন্ধকার। তীতুমীরের মনে হল অরোর চুল বাতাসে উড়ছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। তীতুমীর ভাবল মোমবাতি জ্বালিয়ে অভিমানী অরোর দিকে তাকিয়ে থাকি। অরোরার প্রতি ওর খুব মায়া হয়। মনে মনে ভাবল মশারীটা টাঙায়ে দিয়। তারপর ভাবল,না থাক। এই অরো ঘুমাল নাকি? পিঠে মৃদু আঘাত করে তীতুমীর জিজ্ঞাসা করল। উত্তরে অরোরা বলল না ঘুমায়নি আমি। অরো ঘুম আসছে তোমার? অরোরা চুপ করে থাকে। তুমি যদি না ঘুমাও তাহলে তোমাকে একটা সত্য গল্প বলতাম। তুমি কি শুনছ অরো? বল শুনছি,বলে অরোরা। সে অনেক দিন আগেকার ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ঢুকেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তখন চারদিক ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল। এমন জায়গাও ছিল যে, দিনের বেলাতেও ছাত্ররা ঢুকতে ভয় পেত। সন্ধ্যা হলে হুট করে মনে হতো অনেক রাত হয়েগেছে। আমরা সকাল সকাল ডাইনিংএ খেয়ে,রাত নয় দশটার সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। এক রাতের ঘটনা। তখন রাত দুইটা কি তিনটা হবে। হঠাৎ পাশের রুম থেকে এক ছাত্র জোরে জোরে আমাদের রুমের কড়া নাড়তে লাগল। দরজা খুলতেই সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে সে জ্ঞান হারাল। জ্ঞান ফিরলে ওর মুখ থেকে শুনি আশ্চর্য এক কাহিনী। রুমের জানালা খোলা। পূর্ণীমার অপার্থীব আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে। তখন সবে হায়দার ঘুমাতে গেছে। হঠাৎ হায়দার শুনতে পায়, রুমমেট তোমার পাখাটা দেওতো। হায়দার পাখাটা পাশের বেডের রুমমেট-বিশ্বনাথকে দেবে, এমন সময় ঘটল এক আজব ঘটনা। পাশের বেড থেকে লোমশ একটা হাত ক্রমশ বড় হতে হতে হায়দারের দিকে আসতে থাকল। এই পর্যন্ত বলে থামল তীতুমীর । অনেক আগেই অরোরা স্বামীর দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে। তার দু'চোখে ভয়ে ভরা গভীর কৌতুহল। সে বলল তারপর তারপর........। তারপর আবার কি মশারী ছিল বলে এ যাত্রায় বেচারা রা পেয়েছিল। নতুবা নিশ্চিত ঐ বেটা ভূত ওর ঘাড় মটকে দিত। কেন মশারী আবার কি করল। বিষ্ময় চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞাসা করে অরোরা। দূর বোকা মশারীর অতটুকু ফুটো দিয়ে কি আর অত বড় হাত ঢোকে। তাই বেচারা এই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল।পরে অনেক অনুসন্ধান চালানো হয়। বিশ্বনাথের গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়
ঐ নামে একজন ছিল বটে। ঠিকানা সহ বাবার নামও হুবহু মিলে যায়। তবে বহু আগেই সে পানিতে ডুবে মারা গেছে। অরোরার তবু বিশ্বাস হয়না। বলে ধূর তাই আবার হয় নাকি? আচ্ছা মশারী না টাঙিয়েই আজ ঘুমাও। পরে টের পাবে। অরোরা ভয় হয়। কিছুন দু'জনেই চুপ থাকে। বাইরের অন্ধকার যেন ঘরের ভিতর এসে আরো ঘন হয়। বিচিত্র সব শব্দ অরোরার মনে ভয় ধরায়। খুব ধীরে ধীরে সে শয্যা ছাড়ে। মশারী টাঙায়। কিছুতেই সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। জমাট অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সে দ্রূত বিছানায় আসে। বালিশে মাথা রাখতেই মনে পড়ে, এইতো সেদিনের কথা, পাশের বাড়ির বীনার বড় বোন ওদের বাড়ির কাঁঠাল গাছটার ডালে গলায় দোড়ি দিল। অরোরা দেখতে গিয়েছিল। কি ভয়ঙ্কর! এখনও স্মরণ করলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর। ছোট বেলায় অরোরা কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা সবসময়ই গায়ে কাঁথা দিত। রাত্রের সমস্ত ভয় কাঁথার ভিতর কোথায় উধাও হয়ে যেত! এখন তা আর হয়না অরোরার। নিশ্বাস নিতে কষ্ঠ হয় ওর। ভেজা বাতাসে তীতুর শরীরের গন্ধ পায় অরোরা। ভালোলাগার আবেশে শিহরিত হয় ওর সমস্ত শরীর। আস্তে আস্তে তীতুমীরের গা ঘেসে শোয় ও। অরোরার মাথার চুল এসে পড়ে তীতুমীরের মুখে। তীতুমীর ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দেয়। বধূ বালিশ ছেড়ে তীতুর বাহুতে মাথা রাখে। তখনও বাইরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। ব্যাঙ ডাকার শব্দে পৃথিবী যেন আরো উন্মুক্ত হয়। এবং আরো দু'টা মানুষ সোনালী দিনের স্বপ্নে বেঁচে থাকার স্বাদ পায়।
্