প্রকৃতির অনেক রুপ। আর প্রকৃতির বিভিন্ন রুপগুলো আমাদের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে ধরা দেয়।প্রকৃতির হাতছানিতে আমরা ইচ্ছেডানা মেলে বেরিয়ে পরি ভ্রমণে। কাছে , দুরে বা অনেক দুরে। ইট-পাথরের এই নগরী ছেড়ে, সমাজের সব পংকিলতাকে পেছনে ফেলে, প্রকৃতির খুব কাছে, দূর দিগন্তে ডানা মেলে উড়তে চাই। হয়তো আমাদের মত মানুষদের জন্যই কবিগুরু লিখেছিলেন, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।”
মন চায় প্রজাপতি হয়ে ঘুরে বেরাতে, কিংবা পাখির মত ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে উড়ে বেড়াতে, কিন্তু আমাদের তো তা আর সম্ভব নয়। আবার সব জায়গায় মন চাইলেই ছুটে যাওয়া সম্ভব হয় না, থাকতে হয় সময়, লাগে কিছু পূর্ব প্রস্তুতি। তেমনই একটি জায়গা বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ তিন্দু। চারদিকে গাঢ় সবুজের সমারোহ, সুউচ্চ পাহাড় ও নদী। হরেক রকমের জীব-জন্তু, পাখ-পাখালি, আর কীট-পতঙ্গ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার, ভয় ও শিহরণ, সব মিলিয়ে তিন্দু, রেমাক্রি।
তিন্দু বান্দারবানের থানচি উপজেলার ছোট্ট একটা ইউনিয়ন। জায়গাটা এখন ও লোক চক্ষুর প্রায় আড়ালেই রয়ে গেছে। তিন্দুতে গেলে মনে হবে পৃথিবীতে তিন্দুর মত এমন ঘুম-ঘুম সুন্দর জায়গা আর একটিও নেই। বান্দরবান শহর থেকে উপজেলা সদর থানচি বাজার ৮১ কি.মি. দূরে। পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা।প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী পর্যটকদের কাছে অঞ্চলটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবেই বেশ পরিচিত।
উঁচুনিচু পথ, পাহাড়ের শরীরজুড়ে ঘন সবুজের সমারোহ যেন এঁকেবেঁকে চলে গেছে গভীর থেকে আরো গভীরে। এই সুন্দর বড় ভয়ঙ্কর- হাতছানি দিয়ে ডাকে, মায়াজালে বাঁধতে চায়। থানচি বাজার ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে তিন্দু। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি এবং বাংলাদেশের জলসীমায় সমাপ্ত যে দুটি নদী রয়েছে সাঙ্গু তার মধ্যে একটি। খরস্রোতা এ নদী বান্দরবান জেলার আরাকান পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে পটিয়া, সাতকানিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।এখানে প্রকৃতি অভাবনীয় সুন্দর আর নির্মল।
৩০/০৯/২০১৫ তারিখে আমরা বান্দরবন হতে থানচির উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং দুপুর দুইটার দিকে পৌছাই। পথে শৈল প্রপাত, চিম্বুক ও নীলগিরি দর্শন। পৌছানোর পর পরই শুনতে পাই স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তা জনিত কারনে দর্শনার্থীদের থানচি ভ্রমন সাময়িককালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। সে সময় যে সকল দর্শনার্থী থানচিতে অবস্থান করছিল তারা সকলই শঙ্কিত ও উৎকন্ঠিত হয়ে পরে। থানচি এমন একটি জায়গা যেখান হতে বিকেল তিনটার পর কোন যানবাহন চলাচল করে না। দুর দুর বক্ষে মনে ভয় ও শংসয় নিয়ে প্রচন্ড গরম ও বিদ্যুৎহীন উপজেলা থানচিতে রাত্রি যাপন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ গেস্ট হাউজে বাকি কয়জন তাঁবুতে অবস্থান করি। সাংগু নদীর তীরে একটি নিরিবিলি স্থানে তাঁবু স্থাপন করি। চাদানী রাত, জোস্না আলোয় আলোকিত সাংগু নদীর পানি চিক চিক করছে। সাথে বইছে দমকা বাতাস। তাতে গাছের পাতার শব্দ মিলিয়ে যেই আবহটা তৈরী হলো সেটা লিখে এমনকি তোলা ছবিতেও প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলেই সৌন্দর্যের কোন সীমা পরিসীমা নাই। মনের আনন্দে গাইতে ইচ্ছে করছে "ও কারীগর দয়ার সাগর ওগো দয়াময় চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়..."। আসলে চাঁদ ঝলমলে আলোর রাতে মৃত্যু এলে সেই মৃত্যুর পার্থিব কোন মাহাত্ম্য আছে কী নেই তা আমার জানা নাই।
তাঁবুতে শুয়ে স্নিগ্ধ আলো ঝলমলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। নদীতে বয়ে চলা স্রোত, গাছের পাতার শব্দ ও পাখীদের কলরবে কেমন যেন একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তার ঠিক কিছুক্ষন পর হটাৎ করে পুরো আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে এলো এবং সেই সাথে বজ্র বিদ্যুৎ চমকাতে থাকলো। একে নিরাপত্তার ভয় তার উপর প্রকৃতির বিরুপ আচরনে সকলেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। তারাতারি সব কিছু ঘুটিয়ে আবার গেষ্ট হাউজে ফেরা।
পরের দিন সকালে থানছি ঘাট থেকেই আমাদের মূল অভিযান শুরু হয়। নিজেদের সব তথ্য বিজিবি ও পুলিশকে দিয়ে রওনা হলাম নৌপথে তিন্দুর দিকে। একটি নৌকায় ছয়জন উঠে হৈচৈ করে রওনা হলাম, তবে তখনও জানা ছিল না সামনে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। নদীর দুপাশে পাথুরে পাহাড়। কোন কোন পাহাড় এতই উচু যে তার চূড়া মেঘে ঢেকে আছে। সবুজে ঘেরা এই পার্বত্য অঞ্চলে মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায় দু একটি উপজাতি বাড়িঘর। প্রথম বাঁকটা পার হতেই স্রোতের তোড়ে পড়তে হলো সবাইকে। যে কোনো সময় নৌকা ডুবে যেতে পারে এ আশঙ্কায় কেউ আগলে রেখেছিল নিজেকে, কেউবা নিজের মোবাইল। আমরা চলছিলাম স্রোতের বিপরীতে তাই মাঝির নৌকা চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এই স্রোতস্বিনীর রূপ আর নাম না জানা অসংখ্য ছোট বড় ঝরনা। আমরা সবাই মুগ্ধ এবং নির্বাক। বড় পাথর এলাকায় বিশাল সাইজের একেকটি বিচ্ছিন্ন পাথর পানিতে ডুব দিয়ে ধ্যান করছে। প্রথম দর্শনে তা-ই মনে হয়। অদ্ভুতভাবে সাজানো বড় পাথরগুলোর কোনোটা দেখতে হাতির মতো, কোনোটা বেদির মতো, এরই ফাঁক দিয়ে নৌকা যাতায়াত করে। একটু নিয়ন্ত্রণ হারালেই আর রক্ষা নেই, পাথরে আছড়ে পড়ে নৌকা চুরমার হবে নিশ্চিত। মাঝখানে রাজাপাথর পার হতে গিয়ে নিজেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এর ডকুমেন্টারিগুলোর অংশ মনে হচ্ছিল।
ফেরার পথে একঝাঁক বুনোহাঁস আমাদের যেভাবে 'গার্ড অব অনার' দিল তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তিন্দু ও বড় পাথাড় এলাকা ঘুড়ে এসে এসব দৃশ্য দেখে বুকটা গর্বে ভরে উঠলো আর মনে হলো এই আমার মাতৃভূমি, আমার বাংলাদেশ। আসলে কষ্টকর এই নদী ভ্রমনটা না থাকলে তিন্দু ও বড় পাথর দর্শনটা একেবারেই সাধামাটা হয়ে যেত। বড় পাথর এলাকায় পৌছানোটাই মূল উদ্দেশ্য না, বরং নৌপথের রোমাঞ্চকর এই ভ্রমনটাই জীবনের অসাধারন স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। থানচি, তিন্দু ও বড় পাথর ভ্রমনের পর বান্দরবনের দিকে যাত্রা শুরু। মন ভালো ছিল না কারো, ফিরতে চাইনি কেউই, তবু তো ফিরতে হয়। থানচি, তিন্দু ও বড় পাথর ভ্রমনের নানা কথা ভেবে প্রায় নিঃশব্দে ফিরছিলাম ঢাকার পথে। চট্টগাম এসে টিম লিডারের হটাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন সাজেক যাবে। কি আর করা আবার সাজেকের পথে যাত্রা। সে গল্পো না হয় অন্য দিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১০