সেই মেয়েটা আমার মেয়ে, আজ অনেক উপরে পৌছেছে, অনেক উঁচুতে,এতটা উঁচুতে, মা হিসেবে কখনো কল্পনাও করিনি
আমার গর্ভে ওর যখন মাত্র ছয়মাস,তখন আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে আমি প্রথমদেখি ওর হাত, পা, মুখ, আর ওরা দেখেছিলো যোনি।
চারিদিকে ভয় আর ভয়
যদি পুত্র না হয়!
একটাইতো লিঙ্গ আছে মোটে!
না হওয়া তুলতুলে হাত পা বুক পেট ওরা ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল যমুনার জলে।
আমি তো মা! বহু সংগ্রাম করে, ভিষন যুদ্ধকরে জন্ম দিয়েছি সেই মেয়েটাকে।
বড় আদরে আল্লাদে একটু একটু করে আমার চোখের সামনে বড় হচ্ছিলো।
ছোট বেলাতেও কোন পুরুষের কোলে কখনো দেইনি,জগৎকেতো একটু হলেও চিনি!
মেয়েটার যখন মাত্র ৬ বছর, ভয়ার্ত চোখে একদিন আমায় জাপটে ধরে, সে কি কান্না!! বললো আমি আর খেলতে যাবো না রিনুদের বাসায়, আমি বুঝে নিলাম, বুঝিয়ে দিলাম পুরুষের দৃষ্টি সেই অবুঝ ছোট্ট শিশুকে।ও বুঝতে চায়না।
আমার চঞ্চলা মেয়ে, সে কেবলি খেলতে গিয়েছিলো আর প্রতিবেশি তাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে,
আমি নিজে আমার মেয়েকে বললাম," শশশ,কাউকে বলিস না, কেউ যেন না জানে)"
কাল থেকে তোর বাইরে যাওয়া বারণ।
মেয়েটি জানালায় বসে মাঠের শিশুদের খেলা দেখতো..
আমায় বলতো,আমার কি দোষ মা?
ও কি জানে!
ও তো শিশু নয়.. ওযে মেয়ে
তার পর এলো পড়াশোনার বয়স,
আমার মেয়ের রুপে বড় ধার ছিলো,মেয়েটির মাংস ছিলো বুঝতো না,বুঝলে কি আর মায়ের কথা না মানতো!
পথে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে যখন অচেনা হাত স্পর্শ করত তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো, মা,মেয়েদের দেহ কি কেবলি পুরুষের বিচরণ ক্ষেত্র!
আমি বলতাম, "হুশশশশ,কাউকে বলিসনা যেন"কেউ যেন না জানে
ও বলতো জানো মা! বিবাদ করলে প্রতিবাদ করলে ওরা উল্টো উপদেশ ঝাড়ে
আমি বলতাম চুপ করে থাকবি।ওভাবে সকলের সামনে বিবাদ করতে লজ্জা করে না তোর!
ও বলতো,ওদের লজ্জা করেনা মা!
আমি বলতাম,ওরা মানুষ,তুই মেয়ে
আমার মেয়েটার মানুষ হওয়ার পন ছিলো....
সেই বিকেলে রাস্তা নির্জন ছিলো
মেয়েটির শরীরটি তার ভুল ছিলো
হায়না গুলো সেদিন ওকে জোর করে উঠিয়ে নিলো আর
ফিরিয়ে দিলো কালরাত্রি ভোর করে
মেয়েটির আর কেউ ছিলোনা তার পরে..আমিও না
মানুষ মরে একবার..আমার মেয়েটা রোজ মরে..
আমি ওর চিৎকার চেপে ধরে রাখি,
ওর ব্যাথা,
হুশশশ, কাউকে বলিসনা যেন, কেউ যেন না জানে
আমিতো জানি! পাছে জানাজানি হলে এই পিচাশ সমাজ জোর করে ওই রেপিস্টের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিবে! এ সমাজ নারীর অনুভুতির, নারীর প্রতি ন্যায় বিচারের মুল্য কবে দিয়েছে!
ও তো মানুষ নয়..ও যে মেয়ে! পুরুষের পায়ে যায়গা পাওয়া ওর গর্ব,অনুভুতির কি দাম!
ওই কুকুর গুলো রোজ রাস্তায় ওকে দেখলে হাসে
কখনো রাগে আমিও বলি,তুই ধর্ষিতা তোর দোষে
নিজেকে বদ্ধকরে ফেলা আধপাগল মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মা আর চুপ থাকতে পারিনি।আমি প্রতিবাদ করলাম, বিচার চাইতে গেলাম আদালতে...
তারপর!!!যার ভয়পেতাম তাই হলো।লোকে জানা জানি হলো।
ওরা আমার ধর্ষিত মেয়ের মুখে ধর্ষনের গল্প শুনতে চায়!!! কোথায় কিভাবে স্পর্শকরেছে সেই হায়নারা ওরা শুনতে চায়!
ওরা আমার মেয়ের আর আমার ছবি আর গল্প ছেপে দিলো পত্রিকা আর টিভির পর্দায়। সে কি জনপ্রিয়তা! দেশ জুড়ে আলোচনা, সমালোচনা, সহানুভূতি!
মুদি দোকানদারও আমায় পেলে বলতো,মেয়েকে একরাত পাঠিয়ে দিও!! তোমারো কিছু কামাই হবে!! এখন আর কি যায় আসে!!
যখন পথে ঘাটে ভরসার হাত বাড়ানো পুরুষগুলোর কাছে সাহায্য চাইতে গেছি তখন তারাও ঝাপিয়ে পড়েছে আমার কচিমেয়েটার উপর!!! আমার দিকেও কুদৃষ্টি দিতে ছাড়েনি!!!
বাঁধা দিলে বলে নষ্টা তুই,
মেনে নিলে বলে ভ্রষ্টা তুই,
আমরা মেয়ে,মানুষ তো নই
আমার নাম হলো ধর্ষিতার মা!কেউ দিতো পোশাকের উপদেশ,কেউ ধর্মের বুলি, কেউ বলতো, আহারে! মেয়েটার আর বিয়ে হবে না!কেউ বললো বিচার চাই!কেউ বললো,
কেন সে বিকালে বেরুলো ঘর থেকে! আমার চরিত্র বিশ্লষনেও কোন কোমতি রাখেনি ওরা
যে তার হারামী কামনা চরিতার্থ করার জন্য অবৈধ প্রয়োজনে আমার মেয়েটাকে ব্যবহার করেছে শুধু একবার। তার পর ছুড়ে ফেলেছে আস্তাকুড়ে। ভুলেগেছে তার পর।
তার বিচারে হলো জরিমানা।ক্ষতিপুরণ দেয়া হলো আমার মেয়েকে
সেদিন সেই পুরুষ নৈয়ায়িকের মাথায় বজ্রপাত হয়নি।
বিধাতার ন্যায়নিক্তি দোল খায়নি এতটুকুও!!
শুধু আমার মেয়ের নাম হয়েছে ধর্ষিতা...!
গর্বিত পুরুষ নন্দিত সংসারে
অন্তরে তার পাপ
নিন্দিত হলো আমার মেয়ে
কেবলি নারী বলে
আমার মেয়েটার বড় অভিমান।চলে গেল সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারকের আদালতে!
আমি মৃত্যু দেখেছি,আমি পাপ দেখেছি,আমার মেয়ের উঁচুতে ঝোলানো লাশ দেখেছি।
ও এখন অনেক উঁচুতে,নিজ প্রচেষ্টায় এত উঁচুতে যাবে, কখনো মা হিসেবে কল্পনাও করিনি..
মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্চিত রমনীর নাম হয়েছিলো বিরাঙ্গনা..
আমার মেয়ের নাম হলো কলঙ্কিনী, ধর্ষিতা, বেশ্যা.....!
ওদের পিতা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, অথচ জন্মের আগে থেকেই আমার মেয়ের পিতা হতে চায়নি কোন মানুষ...!