পাগলা গারদে যে লোক সুস্থ ব্যাক্তির আচরন করে সেই আসলে পাগল ।
- সৈয়দ মুজতবা আলী
“ফিরে দেখা ২০১২” অথবা সমার্থক শিরোনাম নিয়ে বিগত বছরের ব্যাপক আলোচিত ঘটনাবলী নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, ফিচার, সংবাদ তৈরী করেছে সবকটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যম । শিক্ষা, সংষ্কৃতি, বানিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি… .. ইত্যাদী সকল ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে প্রভাব বিস্তারী সেরা ঘটনাবলীর চুম্বক অংশ উঠে এসেছে সাংবাদিক বন্ধুদের অসাধারন উপস্থাপনায় ।
দূর্নীতির আলোচনায় চ্যাম্পিয়ন পদ্মা সেতুর পরেই যার নাম বলা ফরজ সে ডেসটিনি । পদ্মা সেতুর বিষয়টি আন্তর্জাতিক বলেই তাকে চ্যাম্পিয়ন সম্মাননা দেয়া । সর্বাধিক আলেচিত এবং চাঞ্চল্যতার প্রাবল্যের ক্রমানুসারে শীর্ষ অবস্থানটি সারা বছরজুড়ে একতরফা দখল করে ছিল ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড । অবশ্য শীর্ষস্থান দখলের এই দৌড়ে পুরষ্কার জেতায় ডেসটিনির অবদান শুধু তার নামটাই । একচ্ছত্র সহযোগীতা করেছে সংবাদ মাধ্যম ।
বিষয়টা ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মূল্যায়ন করব । পুরোটা পড়ে আপনার ভাবনার সাথে মিলিয়ে দেখার আমন্ত্রন রইল । সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের আনাচ-কানাচ থেকে বিভিন্ন খবর আমাদের সামনে তুলে ধরছেন । তাদের এই পেশাগত কর্তব্যের খাতিরে এবং কৌশলী পারদর্শীতার গুনবলে তিলবৎ খবর বিরাটকায় তাল বনে যায় । আবার অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ন ঘটনা খবর হওয়ার সম্মানটুকুও পায়না । সুবিবেচক পাঠকমাত্রেই বিষয়টি জ্ঞাত এবং পরিলক্ষনযোগ্য ।
ফিরে দেখাঃ ডেসটিনি প্রোজেক্ট ।
২০০০ সালে রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে ২০০১ থেকে কর্মকান্ড পরিচালনা করছে ডেসটিনি । অতিক্রম করল ১১টি বছর । তাদের ব্যাবসায়িক স্ট্রাটেজী হলো প্রচার-প্রসারের প্রয়োজনে সকল সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল… ইত্যাদী এড়িয়ে চলা । সেটা তারা যথার্থ করেছে । যদিও বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানাদিতে তাদের আর্থিক অংশগ্রহন ছিল উল্লেখযোগ্য । এরই মধ্যে তারা ব্যাবসা-বানিজ্যের বিভিন্ন স্তরে শেকড় গ্রোথিত করে প্রতিষ্ঠিত করেছে ডেসটিনি গ্রুপ ।
সাধারন জনগনের কাছে পরিচিত হলেও ডেসটিনির প্রসারের তুলনায় প্রচার ছিল নামমাত্র । বর্তমান ব্যাবসায়িক পরিমন্ডলে কোন একটা কোম্পানীর জন্য ব্রান্ডিং অতিব গুরুত্বপূর্ন বিষয় । এই খাতে সকলের বাজেটও তাই সর্বাধিক । ডেসটিনি এই দৌড়ে শেষ দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে ছিল ।
২০১২, ফেব্রুয়ারী শেষ হতে কয়েকদিন মাত্র, এক রহস্যময় প্রোপাগান্ডার সূচনা ।
প্রথম আলো এবং দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম লাল করে ফুটল ডেসটিনির ব্রান্ডিং কলি ।ভিত্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি খসড়া প্রতিবেদন । প্রতিদিন… সপ্তাহের পর সপ্তাহ… মাসের পর মাস…। সাথে আরও দু-তিনটি পত্রিকা ঠেস মূলের ভূমিকা নিল । প্রতিদিন শিরোনাম হওয়া ডেসটিনিকে আর অবহেলা করতে পারল না টিভি চ্যানেলগুলো । তারাও কোমর বেঁধে নেমে পরলেন । তবে ATN –ভ্রাতৃদ্বয়ের কোমর বেশী শক্ত করে বাঁধা ছিল ।
সকালের নাস্তায় গুরুত্বপূর্ন আইটেম যাদের সংবাদ শিরোনাম, সপ্তাবাদে তাদেরও বদহজম হওয়া শুরু করল । রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে রসালো অড্ডায় কয়েকদিনেই ডেসটিনির কষ অবধি শেষ হয়ে গেল । আর কত ? পাবলিকের আরও কাজ আছে আবারও প্রমানিত হলো । কিন্তু; ওনাদের কাছে ডেসটিনির রস যেন রামের তীর, শেষ হতে চায়না ।
এই সম্মিলিত উপযুÑপরি প্রচারনায় বাধ্য হয়ে ডেসটিনির নামে মামলা ঠুকে দিল দুদক । দুদক যে মামলা করেছে তা আবার ডেসটিনির দেয়া তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে । সকল পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও শুধুমাত্র মোঃ রফিকুল আমিন এবং আলহাজ্ব মোঃ হোসেন –কে কারান্তরীন রাখা হয়েছে এবং প্রধান আসামী লে.জে.মোঃ হারুন-অর-রশীদ (সাবেক সেনা প্রধান) শর্ত-সাপেক্ষ জামিনে আছেন ।
বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিপাকে নিমজ্জিত সরকার বাহাদুরের গোদের উপর জন্ম নিল ডেসটিনি ফোঁড়া । শুধুমাত্র ডেসটিনিকে ঠেকানোর জন্য সমবায় আইনে পরিবর্তন প্রস্তাব হলো যাতে প্রতিবাদের ঝড় উঠল বাংলাদেশের সকল সমবায়ী সমিতির পক্ষ থেকে । তড়িঘড়ি করে কোম্পানী আইনে “প্রশাসক নিয়োগ” সংক্রান্ত প্রস্তাব ব্যাবসায়ী মহলকে প্রতিবাদ-মিটিং-বিকল্প প্রস্তাবনায় ব্যাস্ত করে ফেলল ।
তাদের ব্যাবসায়িক প্রক্রিয়া ব্যাতিক্রমী এবং সহজবোধ্য না হওয়াতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত । এই প্রক্রিয়ার ব্যাবসায়ে জনগনের প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তটস্থ সকল বোদ্ধারা । তদুপরি বিগত ১২ বছরে কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোন গ্রাহক বা কর্মচারী একটি মামলা তো দূরে থাক একটা অভিযোগও করেনি ।
তারা বরং উল্টোটা করলেন । মামলা প্রত্যাহার, বন্ধ ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেয়া, ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার আবেদন জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সকল সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকদের নিকট স্মারক লিপি দিয়েছে । মানব বন্ধন, গন অনশন, সংবাদ সম্মেলন করে বারংবার বলে যাচ্ছেন তারা মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত নয়, কোন পরিচালকদের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই ।
উল্লেখ্য, সচরারচর মানব বন্ধন ইত্যাদী কর্মকান্ডে প্রায় সকলকেই সাড়ে সতেরজন ভাড়াটে অংশগ্রহনকারীকে নিয়ে সফল (!) করতে দেখা যায় । আসলে সবাই ব্যাস্ত । এক প্যাকেট বিরিয়ানী বা পঞ্চাশ টাকার জন্য এখন লোক খুঁজে পাওয়া দায় । তবে ডেসটিনির সকল প্রতিবাদী কর্মকান্ডে হাজার হাজার ডিস্ট্রিবিউটরের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন সত্ত্বেও কোনটি সংবাদ হওয়ার যোগ্যতা রাখেনি ।
সাংবাদিক বন্ধুগন যা দেখাতে চাইছেন তার অন্তরালে কিছু আছে বৈকি । খোলাসা করতে চলুন কিছু উত্তর আবিষ্কার করিঃ
১. শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটা সংবাদ পত্র ও টিভি চ্যানেলের ডেসটিনির ব্যাপারে অতি আগ্রহের কারন কি ? তাদের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচার, পদ্মা সেতু… ইত্যাদী বিষয় একটানা পাঁচ দিন শিরোনাম হওয়ার সুযোগ পায়না । কোন রহস্যময় যোগ্যতায় ডেসটিনি একটানা নয় মাস তাদের শিরোনাম লাল করে ?
২. বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে আর একটা বিষয় পাওয়া যাবে কি যেটা এভাবে প্রায় বছরব্যাপী একটানা শিরোনাম হয়েছে ?
৩. ডেসটিনিকে নিয়ে আগ্রহী সংবাদ মাধ্যমগুলোর স্বত্বাধিকারগনের মধ্যকার আত্বীয়তা কি ?
৪. এই বছরব্যাপী প্রচার-প্রোপাগান্ডাতে “ডেসটিনি” যেভাবে সর্বমহলের নজরে এসেছে এটা কি অন্তরালে ডেসটিনির ব্রান্ডিং পাথ ? সংবাদপত্রগুলোর বিরুদ্ধে ডেসটিনির দায়েরকৃত মানহানী মামলার কোন অগ্রগতি না থাকার অন্য কি কারন থাকতে পারে ? এতগুলো স্বতঃস্ফূর্ত বিশাল মানব বন্ধনে সাংবাদিক ভাইদের উপস্থিতি থাকলেও কার ইশারায় খবরগুলো প্রচারিত হয় না ?
৫. কোন আইনী ক্ষমতাবলে, কে ডেসটিনির একাউন্ট এতদিন বন্ধ রেখেছে ?
৬. ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে, মামলা হতে পারে এরকম উপকরন দুদককে ডেসটিনির কর্তাব্যাক্তিরা কেন সরবরাহ করেছেন ?
৭. বাকী পরিচালকগন দুদককে এমন কি সুবিধা দিয়ে গ্রেফতার এড়িয়ে গেলেন যেটা উর্ধ্বতন তিনজন দেয়ার ক্ষমতা রাখলেন না ?
৮. কোন মামলায় প্রধান আসামীর জামিন হলেও পরবর্তীদের জামিন না পাওয়ার আইনী রহস্য কি ?
৯. “প্রশাসক নিয়োগ” সংক্রান্ত প্রস্তাবটি বাতিল করা প্রমান করে; সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল, তবে কোন গোপন শক্তির প্রভাবে ডেসটিনি নিয়ে সরকারযন্ত্রে এই অতি ব্যাস্ততা ?
১০. সংবাদ মাধ্যমগুলোর একযোগে ধারাবাহিক প্রচারের পরেও কোন গ্রাহক বা স্টেক-হোল্ডারদের রফিকুল আমিনীয় সম্মোহন না ভাঙ্গার কারন কি ?
১১. প্রায় ৪৫ লক্ষ ডিস্ট্রিবিউটরের একজনেরও ডেসটিনির বিরূদ্ধে অভিযোগ নাই, তাহলে কার স্বার্থে এই মামলা-হামলা ?
চিন্তাশীলদের ধন্যবাদ । কেননা আপনারা ৪৫ লক্ষ জীবনের গুরুত্ব দিয়েছেন ।