বিশাল এক দল মানুষ বনের ভিতর
দিয়ে অতিক্রম করার সময় কোন
জ্বালানী কাঠ পেল না ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জেন পিলজার (Paul Zane Pilzer ) তার বিখ্যাত –“ Unlimited Wealth ” বইয়ে পাঠকদের ১৯৬০ সালের সেরা চলচিত্র থেকে একটি স্মরনীয় দৃশ্যের স্মৃতিচারন করতে বলেছিলেন । বেন চরিত্রটি অভিনয় করেছিলেন ডাস্টিন হফম্যান । বেন ছিল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত এক শিক্ষিত যুবক । একটি সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে একজন বিজ্ঞ,বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেন-কে আগামী দিনের সম্ভাবনাময় ব্যবসা সংক্রান্ত গোপন রহস্য জানানোর উদ্দেশ্যে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন । তিনি বেন’র কানে ফিসফিস করে একটি কথা বললেনঃ
“প্লাস্টিক ।”
Unlimited Wealth বইয়ে পিলজার একটি ভিন্ন তবে গভীড় জ্ঞানপূর্ন এবং যাদুকরী শব্দ আমাদের কানে পৌছে দিলেনঃ
“বিতরন ।”
কেন ? এখনই বলছি ।
বিতরন প্রযুক্তি
আমরা যেসকল পন্য ও সেবা ক্রয় করি তাদের উপর সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তি হলো উৎপাদন খরচ কমানো । আপনি যখন দাম কমাবেন তখন বিক্রয় বেড়ে যাবে, অনেক বেশী বেড়ে যাবে – এটা একটা প্রমানিত বিপনন নীতি ।
যেমন, খুব কম আমেরিকানের ক্যালকুলেটর ছিল যখন এটা ১২৫ ডলারে বিক্রয় হতো । যখন খুচরা মূল্য ২০ ডলারের নিচে হ্রাস পেল তখন প্রায় সবাই একটা ক্রয় করলেন –এরপর দুইটা এবং তিনটা । একই ব্যাপার সত্যি হলো কম্পিউটার এবং মুঠোফোনের ক্ষেত্রে এবং সকল পন্যের ক্ষেত্রেই ।
শুধু একবার খতিয়ে দেখুন – LCD এবং প্লাজমা TV-র ক্ষেত্রে কি ঘটেছে ?
যখন Flat Screen TV-র দাম ৫০০০ ডলার ছিল, শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিরা এর মজা উপভোগ করতেন । কিন্তু; এর দাম ১০০০ ডলার অথবা আরও সাশ্রয়ী হতেই শো-রুমগুলো ফাঁকা হতে শুরু করল । আজকাল একটা Flat-Screen অথবা HD Plasma TV কিনতে পারবেন ১৯৬০ সালের একটা সাদা-কালো TV –র দামে ।
উদাহরন স্বরূপ একটা পন্য বেছে নিন – যেকোন পন্য – এবং একই ঘটনা লক্ষ্য করবেন । মূল্যস্ফীতির জন্য ডলার সমন্বয় করে নিন এবং আজকাল গুনগত মান, বৈশিষ্ট্য, নিরাপত্তা এবং স্থায়ীত্ব ইত্যাদী বিচারে এখন থেকে বিশ বছর…. এমন কি দশ বছর আগের চেয়ে ছয় থেকে সাত গুন উন্নত মান সম্পন্ন পন্য কিনতে পারবেন । আজ আপনি অনেক বেশী উন্নত টিভি…. অথবা ফ্রীজার… অথবা মাইক্রোওয়েভ ওভেন…. অথবা মিউজিক সিস্টেম…. অথবা ল্যাপটপ পাবেন ৬০% কম দামে অথচ দশ গুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ।
পন্য উৎপাদনের নতুন এবং উন্নত প্রযুক্তি পন্যের খুচরা মূল্য ছেঁটে শেষ সীমায় এনে বিক্রয় বাড়িয়ে দিয়েছে । যখন দাম হ্রাস পেয়ে নিম্নগামী হয় তখন এক সময়ের বিলাসী পন্য মূহূর্তেই নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যে রূপ নেয় । তখন সবাই মনে করে একটা অবশ্যই দরকার… এরপর দুইটা…. এরপর তিনটা ।
আজকাল ৯৫% বাড়ীওয়ালাই কমপক্ষে দুটো টিভি সেট ব্যাবহার করে । একসময় আপনার প্রতিটি রুমেই একটা করে টিভি থাকবে !অথবা দুটা করে, এরপর কি ঘটবে ?
উন্নত গুনগত মান ।
বসার ঘরের পাঁচ বছরের পুরোনো ৪২ ইঞ্চি টিভি-র জায়গায় স্থান পাবে সারাউন্ড সাউন্ড বিশিষ্ট নতুন ৬০ ইঞ্চি টিভি । এবং এরপর আরও উন্নত মানসম্পন্ন….. এবং এবাবে চলতে থাকবে । ভিডিও i-Pod যেখানে সহজলভ্য কেউ কি সনি ওয়াক ম্যান চাইবে ? প্রথমে আসে সংখ্যাধিক্য তারপর উন্নত গুনগত মান । এবং যেহেতু বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত উৎপাদনের নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার করছে, একইরকম নতুন ও উন্নত বৈশিষ্ট আবিষ্কার করছে যা পূর্বে কেও চিন্তাও করেনি – সেহেতু সবসময় নতুন এবং বড় বাজার দখলকারী নতুন এবং উন্নত পন্য সহজলভ্য হচ্ছে ।
সকল পন্য এবং সেবার জন্যই আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজার । তারা (চীনা, জাপানীয়, জার্মান এবং সকল “তারা”) বিদ্রুপের হাসি দেবে এবং “বস্তুবাদী আমেরিকান বলে গালিও দেবে । কিন্তু সহসাই এই হাসি মিঁইয়ে যাবে যখন বিপনন প্রক্রিয়া শুরু হবে । কেননা “তারা” ভালই জানেন তাদের রুটির কোন পাশে মাখন দিতে হবে – এবং তারা এও জানেন কাদের কাছে রুটি আছে ।
কিন্তু; কিছু পন্যের দাম কেন সবসময় উর্ধ্বমুখী ?
যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাম মীতের পাতার মতই ঝরে যাচ্ছে, কেন কিছু দাম কখনোই হ্রাস পায়না ? যেমন- খাদ্যপন্য ।
চমৎকার প্রশ্ন – এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম একটা যুতসই উদাহরন যা সর্বদা উর্ধ্বমুখী । কেন; বলছি । নতুন এবং উন্নত ফসল (যেমন – গম) উৎপাদন এবং আটা তৈরির প্রযুক্তির কল্যানে ফসল জন্মানোর খরচ এবং একে খাবারে পরিনত করার খরচ কাটা-ছাঁটার চুড়ান্ত স্তরে চলে এসেছে বহু বছর পূর্বেই ।
এক প্যাকেট –এ হয়তবা দশ সেন্ট মূল্যের থাকে । যদি আপনি আবাদ প্রক্রিয়া এবং উৎপাদন প্রযুক্তিতে ২০ ভাগ উন্নয়ন ঘটান, আপনি এর দাম মাত্র দুই সেন্ট কমালেন । তবে কেন এক প্যাকেট –এর খুচরা দাম ৩.৫ ডলার হয় ? কারন পন্যটির সবচেয়ে বড় খরচ এর উৎপাদন প্রনালীতে নয় । এবং তা পন্যের মোড়ক-ও নয়, যদিও এটা মূল্য বৃদ্ধি করে । বিপনন প্রক্রিয়া ছাড়াও একটা বড় মূল্য সংযোজনকারী ক্ষেত্র রয়েছে যা আপনি দেখতে পান না অথবা অনুমান করতে পারেন না ।
সবচেয়ে বড় মূল্য সংযোজনকারী ক্ষেত্র হলো বিতরন প্রক্রিয়া এবং বিক্রয় !
আগেকার দিনে পন্যের খুচরা মূল্যের প্রায় ৫০ ভাগ হতো উৎপাদন খরচ । এটা আসলে অতি প্রাচীন হিসাব । এখন উৎপাদন প্রক্রিয়ার সকল স্তরে – চাষাবাদ প্রক্রিয়া অথবা খনিজ উত্তোলন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত (ব্যাবহার যোগ্য ) পন্য প্রস্তুতিতে ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে উৎপাদন খরচ পন্যের খুচরা মূল্যের দশ থেকে বিশ ভাগে নেমে এসেছে । চীন, ভারত, মেক্সিকো ও ভিয়েতনাম এবং অন্যরা ফসল উৎপাদনে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করছে । তাই খাদ্যপন্য এখন ডলারের পরিবর্তে এখন পেনিতে উৎপাদিত হচ্ছে । এখন উৎপাদন খরচ ততটাই নিচে নেমে গেছে যতটা বাস্তবে সম্ভব ।
কিস্তু; একদিকে উৎপাদন খরচ ছাঁটাই হচ্ছে, অন্যদিকে বিতরন এবং বিক্রয় খরচ বেড়েই চলেছে । আজকাল এই খরচ পন্যের ক্রয়মূল্যের ৮০% থেকে ৯০% যা ক্রেতার পকেট থেকে হারিয়ে যায় ।
এখন, প্রতিযোগী বিক্রয়কারী হিসেবে আপনি সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য নির্ধারন করার জন্য কোনটি করবেন ?
১) কয়েকটি পেনি পুনরুদ্ধারের জন্য পন্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার খরচ কমাতে সকল শক্তি ও দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন যা কিনা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত স্তরে পৌছে গেছে ?
অথবা…..,
২) পন্য বিতরন ও বিক্রয় প্রনালীতে যে ৮০% থেকে ৯০% খরচ হয় সেখানে মনোনিবেশ করবেন ?
আপনি “২)” পছন্দ করবেন, অবশ্যই ।
তহিলে চলুন এক ডলার মূল্যের একটি পন্য নিয়ে হিসাব করে দেখি । উৎপাদন খরচ দশ সেন্ট –এর ১০% থেকে ২০% বাঁচিয়ে সর্বোচ্চ দুই সেন্ট পকেটে জমানো যাবে । যেখানে বিতরন ও বিক্রয় করচ আশি থেকে নব্বই সেন্ট –এর ২০% বাঁচিয়ে আপনার মোট লাভের সাথে অতিরিক্ত ষোল থেকে আঠার সেন্ট যোগ করা যাবে । এবার এই আঠার সেন্ট-কে মিলিয়ন মিলিয়ন বিক্রিত পন্যের সাথে গুন করুন । এভাবে একটা স্বাস্থ্যবান উচ্চ-লাভজনক ব্যাবসার সাথে একটা মূমূর্ষু ব্যাবসার পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারবেন ।
বিতরন – এর মধ্যেই এখনকার অর্থ (লাভ) লুকিয়ে রয়েছে । প্রমান চান, তাহলে একবার আমেরিকার সবচেয়ে ধনী পরিবারকে জানুনঃ ওয়ালটন পরিবার ।
আমেরিকার সত্যিকার চাচা স্যাম
ওয়াল-মার্ট (Wall-Mart ) –এর মালিক মৃত স্যাম ওয়ালটন –এর পরিবার । এটা পৃথিবীর তাবৎ ব্যাবসায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সফল বিতরনকারী ।
ওয়াল-মার্ট আসলে কতটা সফল ?
শনিবার যখন ওয়ালটন পরিবারের চার উত্তরসূরী নৈশভোজে বসেন, তাদের খাবার টেবিলে মোট সম্পদের পরিমান ১০০ বিলিয়ন ডলার । আপনি সেখানে কয়েকশ’ মিলিয়ন দান করেন অথবা তুলে নেন সেটা অনেকটা একজনের পকেট থেকে পরে যাওয়ার মতোই হবে । এখন যদি জনাব স্যাম বেঁচে থাকতেন, বিল গেটস্ এর ৫৩ বিলিয়ন ডলার সম্পদের প্রায় দ্বিগুন সম্পদ নিয়ে তিনিই হতেন দুনিয়ার সবচে’ ধনী ব্যাক্তিত্ব ।
প্রশ্ন হলো, স্যাম ওয়ালটন ও ওয়াল-মার্ট কিভাবে এই বিপুল পরিমান সম্পদ সৃষ্টি করলেন ?
বিতরন ।
ওয়াল-মার্ট অন্য সকলের পন্য বিতরন ও বিক্রয় করে । ঘটনা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তারা বিক্রয় করে না । তারা শুধুমাত্র বহুল বিক্রিত মডেল ও ব্রান্ডের একটা বিশাল সংগ্রহ শহরের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে হাতের নাগালে সহজলভ্য করে । বিতরনের যুদ্ধে তারা কতটা পারদর্শী ? একটা কৌতুক মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়াত – “এখানকার ওয়াল-মার্ট স্টোর কিভাবে খুঁজে পাবেন ? এটা বন্ধ হয়ে যাওয়া কে-মার্ট (K-Mart)-থেকে রাস্তার ঠিক উল্টো পাশেই ।”
যেখানে ওয়াল-মার্ট অবস্থান নেয় অন্য সবাইকে গুটাতে হয় !
ঠিক তাই, তারা এতটাই হাতের নাগালে, এতটাই সাশ্রয়ী । এবং তারা মুদিখানার দ্রব্যাদি…. এবং ঔষধ-পথ্য…. এবং টায়ার…. এবং গ্যাসোলিন…. বিতরন শুরু করে আরও উন্নত হচ্ছে । এখন চায়নার বাজার দখল করার দিকে দৃষ্টি দিয়েছে ।
বিতরন – এটাই মূল মন্ত্র !!
আপনি যদি আজ বর্তমান ব্যাবসায়ীদের তুলনায় পন্য ও সেবা বিতরনের একটা নতুন ও উন্নত পদ্ধতি – একটা নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেন – তবে আগামীকাল আপনি হবেন অন্যদের চেয়ে ধনী – অনেক ধনী ।
আনন্দের খবর হচ্ছে বিতরন ও বিক্রয়ের এই নতুন ও উন্নত পদ্ধতি আপনাকে একাকী পরিকল্পনা করতে হবে না । কারন এটা ইতিমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে, এই মূহূর্তে বিদ্যমান এবং অত্যন্ত লাভজনক । আরও জেনে রাখুন, এই পদ্ধতি সত্তর বছরের অধিক সময় ধরে বিভিন্ন বাজারে সফলভাবে পরিক্ষীত, পরিশুদ্ধ ও প্রমানিত হয়েছে ।
বর্তমানে পৃথিবীর একশত দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অত্যাধুনিক এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পন্য বিতরন করছে । ফলশ্রুতিতে মানুষের পন্য ও সেবা ক্রয় এবং প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছে ।
এই নবযুগের নেতৃত্বদানকারী বিতরনকারীরা (স্বাধীন ব্যাবসার অধিকর্তা ) ওয়ালটন পরিবারকে আরও ধনী করার পরিবর্তে নিজ নিজ ও আত্নীয়-বন্ধুদের পরিবারকে ধনী করছে । আর এটাই হচ্ছে নতুন এবং উন্নত সমাধান যেটা যে কেওই বুঝতে ও করতে পারবে ।
মূলঃ বার্ক হেজেস্
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৬:৫১