নারী নেতৃত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নের উপর দুটি গবেষণা কর্মে যুক্ত ছিলাম। নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণায় একজন নারী অধ্যাপকের সাথে কাজ করেছি যাতে সহযোগিতা করেছিলেন কানাডিয়ান মিজ অ্যান। দ্বিতীয় কাজটি করেছিলাম ‘স্টাডি এন্ড রিসার্চ গ্রুপ’ এর পক্ষ থেকে। তাতে ফল এসেছিল, যে সকল এলাকায় এনজিওদের প্রভাব বেশি তাতে নারীরা অধিক হারে ভোট দেয়, অধিক হারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তারা নেতৃত্ব দেয়। উত্তর বঙ্গে সাইকেল চালানো এক ছাত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলে’? সে এনজিওতে কর্মরত তার বোনের কথাই বলেছিল যে বোন- এনজিওতে চাকরি করে সাইকেল চালায়। তৃণমূলের দরিদ্র নারীদের কর্মমূখি করতে এনজিও বড় ভূমিকা রাখে। দুএকটি ব্যর্থতা থাকলেও অসংখ্য নারী সংগ্রাম করে পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে এনজিওর সহযোগিতাতেই। ওই সব পরিবার থেকে উঠে আসা বহু নারীই আজ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে আরো সাবলম্বী হয়েছে। এমন একটি মেয়ের সাথে চাকরি করেছি যার মা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছাগল পেলে তাকে পড়িয়েছে এবং আজ সে ভাল একটি চাকরি করছে। মেয়েটি যথারীতিই দাবী করে তার আদর্শ তসলিমা। তসলিমা নাসরিনের বই পড়েই সে অনুপ্রাণিত হয়েছে স্বাধীন হতে। গত কয়েক যুগে বহু নারীই আমাকে বলেছেন, তাদের আদর্শ বা প্রিয় লেখক তসলিমা নাসরিন।
গত শতাব্দীর সত্তর/আশির দশকেও নারীরা লেখাপড়া করতো ভাল একটি বিয়ে হওয়ার জন্য। মেয়েরা নাইন-টেনে উঠলেই সাধারণত বিয়ে হয়ে যেতো। আমার সহপাঠীদেরও হয়েছে। কিছু মেয়ে কলেজে পড়তো। এর বাইরে যারা আরো পড়াশোনা করতো তাদের মধ্যেও সাবলম্বী হওয়ার উচ্চাশা ছিল না। বিয়ের পরে যদি স্বামী অনুমতি দিতো বা অনুরোধ করতো তখনই তারা চাকরির কথা ভাবতেন। শাখাওয়াৎ সাহেব যদি রোকেয়াকে এগিয়ে না দিতেন তবে তিনি বেগম রোকেয়া হয়ে উঠতেন না। তসলিমা নাসরিনই নারীদের মধ্যে একটি বার্তা দিতে সক্ষম হন, ‘হে নারী তোমার শরীর তোমার অধিকার। তুমি সাবলম্বী হও এবং নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করো’। তসলিমা নিজের এমন একটি ভাবমূর্তি দাঁড় করান যে, তিনিই নিজেই নারী-মুক্তির প্রতীক। এখনো তসলিমা নাসরিন নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই মনে আসে নারী স্বাধীনতার কথাই। উত্তর বঙ্গে আমার একজন বান্ধবী ছিলেন। মেয়েটি খুবই মেধাবী ও সুন্দরী- চারটিই প্রথম বিভাগ/শ্রেণি। তসলিমার লেখা দ্বারা ভীষণভাবে উদ্বেলিত ছিলেন। নিজে চাকরি করতেন, সমাজ ভাঙ্গার চেষ্টা করতেন। তসলিমার লেখাগুলোকে কাছে রাখতেন ধর্মগ্রন্থের মতো করে। এ সময় ঢাকায় একটি মেয়ের সাথেও ঘণিষ্ঠতা হয় তারও একই রকম রেজাল্ট- একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি করতেন। তারা তসলিমার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছিলেন। তারা নিজেরা বয়ফ্রেন্ড/স্বামী পছন্দ করে নেয়ার কথা ভাবতে শেখেন, যৌনতা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। পাবনাতে একজন তসলিমা ভক্তকে দেখেছি যিনি আমাদের তাঁর স্বামীকে পাশে নিয়ে, পেশোয়ারের সেই নাতনির গল্প শোনান। তীব্র শীতে শিশু মেয়েটি, তার ভাইয়ের মতো জানালা দিয়ে হিসি করার আবদার করে। দাদু বলে, তুমি পারবে না কারণ তোমার ওটা নেই। বালিকাটি বলে, কেন আমার নেই, আমার কবে হবে? সে কান্না শুরু করে...
ড. ইউনুসের সাথে তসলিমার তুলনা করাতে অনেকে কষ্ট পেয়েছেন। হয়তো সালমান রুশদীর সাথে তুলনা করলে খুশি হতেন। মৌলবাদীরা দুজনেরই মাথার দাম ধরেছিলেন। দুজনেরই ধর্ম বিশ্বাস দেখা যায় নি। এছাড়া দুজনের মধ্যে মিল কমই ছিল। আরেকটি মিল অবশ্য আছে- বাংলাদেশে দুজনের বিরুদ্ধেই সমভাবে আন্দোলন হয়েছে। সম্ভবত এ সময় বিশ্বজুড়েই মানুষ তাদের নাম একসাথে উচ্চারণ করতো। রুশদী যত বড় লেখক নারী স্বাধীনতার জন্য তার তেমন কোন ভূমিকা দেখিনি। বরং তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী তার বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগই এনেছিলেন। বাংলাদেশে তসলিমার সাথে মিল ছিল হুমায়ুন আজাদের। কিন্তু একই পত্রিকায় একই সময়ে কলাম লিখতে গিয়ে তাদের মধ্যে উল্টো বৈরিতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে বৈরিতা নতুন কিছু নয়। আমরা হুমায়ুন আজাদের সাথেই আহমদ ছফা ও সৈয়দ শামসুল হকের বৈরিতা দেখেছি। সাম্প্রতিক সময়েও কয়েক সাহিত্যিকের মধ্যে তীব্র বৈরিতা দেখছি। তসলিমার বিপক্ষের লোকেরা তাঁর উপরে আক্রমণ চালাতেন বহুমাত্রিকভাবে। সাহিত্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাথে সাথে তার নাস্তিকতা নিয়ে মূল আঘাতটি হানতেন। তাঁর তথাকথিত বন্ধুরাও এ কর্মটি করেছেন। ফলে উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ শ্রেণির রোষের মুখে পড়েন তিনি।
এক বন্ধু বললেন, তসলিমার ভুল নিয়ে লিখতে। সহজই বিষয়টি। তিনি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার সাথে সাথে, ইসলামের প্রবর্তক ও ধর্মীয় গ্রন্থকে তীব্র কটাক্ষ করে কথা বলেছেন। এর প্রতিক্রিয়া সামলানোর অবস্থা তখনও সৃষ্টি হয়নি। তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। একটা দিক ভাল ছিল যে, তখন তিনি ছিলেন সিঙ্গেল অর্থাৎ একে একে তিনি তার সর্বশেষ তিন নম্বর স্বামীকেও ছেড়েছেন। নারীরা এ বিষয়টিও গ্রহণ করেছেন। আজকাল অনেক পুরুষই হাহাকার করেন যখন দেখেন ঢাকায় ডিভোর্স দেয় নারীরাই বেশি। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাবলম্বী মেয়েরাই বেশি ভূমিকা রাখেন। তাদের চেতনা পুরুষরা ধারণ করতে পারে না। পুরুষরা এখনো মনে করে বসে থাকে- সব নারীই তাদের পদানত থাকবে, চোখের ইশারায় উঠবে বসবে, মুখের উপর কথা বলবে না ইত্যাদি। কিন্তু একজন সাবলম্বী ও অগ্রসর চিন্তার নারী- দাসী হয়ে থাকতে চায় না। আমার চোখে এটাকেও সাফল্য মনে হয়। একজন তসলিমা ভক্ত নারীর সাথে চাকরি করেছি। তাঁর স্বামী তাকে চাকরি ছাড়ার জন্য চাপ দেয়। সে সরাসরি স্বামীকে বলে দেয়, ‘তোমাকে ছাড়তে পারি তবুও চাকরি ছাড়বো না’। স্বামী তাকে মারপিট করার হুমকি দিলে, ‘সেও পাল্টা বলে দেয়, একটা থাপ্পর দিলে আমিও একটা দিবো’। এরপর থেকে তাঁর স্বামী চুপসে যায়। মেয়েটি এমন সাহস কোথায় পেয়েছে? এর নেপথ্যে রয়েছে সেই তসলিমা নাসরিনই।
লেখাটির শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম, ‘আপোষহীন তসলিমা!’ তখনই মনে হলো এই অভিধাটি খালেদা জিয়ার অনুসারীরা ব্যবহার করেন। খালেদা জিয়া এরশাদের দেয়া দুটি নির্বাচনই বয়কট করে আপোষহীন তকমা পেলেও তাকে অসংখ্যবারই আপোষ করতে হয়েছে। তাঁর বিরোধীরা বলেন, এবারও তিনি আপোষ করেই জেলের বাইরে এসেছেন’। এক্ষেত্রে বাস্তবিক তসলিমা নাসরিনই কোনরূপ আপোষ করেন নি। আর এই আপোষ না করাটাই তাকে নারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। আর নারীরা নিজেরাও আপোষহীন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও স্বাধীন হয়ে উঠতে লড়াই করছেন। নারী স্বাধীনতা ও নারী প্রগতির জন্য তিনি এক আমরণ লড়াই করে যাচ্ছেন। আজ বাংলায় তিনি মৌলবাদীদের দাপটে থাকতে পারছেন না। তবুও তিনি কোন না কোনভাবে তার বক্তব্য একইভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এখনো তিনি কলাম লিখছেন বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সামাজিক মাধ্যমেও সক্রিয় রয়েছেন। এখনো সিঙ্গেলই রয়েছেন, চলছেন স্বাধীন ভাবে। তাঁর জীবনও নারীর জন্য এক শিক্ষা।
তসলিমার বেপরোয়া ব্যক্তিত্ব ছিল - Click This Link
তসলিমার শত্রু কি তাঁর সাহস না সত্য বলা? - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৪০