এপ্রিল ১৯৭৮ সাল স্বামীর হাতে নিহত হন সালেহা। যৌতুকলোভী ডা. ইকবাল তার নিজের বাড়ির গৃহপরিচারিকার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। এক সময় স্ত্রী জেনে যায় প্রিয়তম স্বামীর এসব বাজে কীর্তিকলাপ। এরপর স্ত্রী এসবের প্রতিবাদ করলে ফুঁসে ওঠেন ডা. ইকবাল। শুরু হয় স্ত্রীর ওপর নির্যাতন। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মেয়ের শিক্ষার্জনের বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। ভেবেছিলেন বিত্তের জোরেই মেয়েকে ভালো একটা পাত্রের হাতে তুলে দেবেন। পেয়েও গেলেন। মেয়ের সুখের গ্যারান্টির জন্য সালেহার বাবা নিজের টাকায় ইকবালকে ডাক্তারি পাস করান। সালেহা হত্যার ঘটনায় দেশের মানুষ নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশে সোচ্চার হয়েছিল। যার সুফল হিসেবে ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণীত হয়। ১৯৮৭ সালে গৃহপরিচারিকার সঙ্গে পরকীয়ার জের ধরে স্ত্রী সালেহাকে হত্যার দায়ে ডা. ইকবালের ফাঁসি হয়েছিল।
এপ্রিল ১৯৮৯ খ্যাতনামা ডাক্তার বাবা-মা'র ব্যবসায়ী ছেলে মুনির হোসেন তার স্ত্রী শারমিন রীমাকে বিয়ের তিন মাসের মাথায় হত্যা করে। বিক্রমপুরের মেয়ে ছিল শারমিন রীমা। পিতা শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ। মনির হোসনে আরা খুকুর সাথে পরকীয়া প্রেমের কারণেই রীমাকে হত্যা করে। ৭ই এপ্রিল ঢাকা থেকে রওনা হয়ে যাওয়ার দুদিন পরে ফেরার পথে স্বামী মুনির হোসেন তাকে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি গ্রামের কাছে ফেলে রেখে আসে। মনিরের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। মনিরের পরিবারের কিছুটা প্রভাব ছিল। তারাও চেষ্টা করেছিল কিন্তু আন্দোলনটা ছিল ওই চেষ্টার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। মনিরের মা ডা. মেহেরুন্নেছার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তার হাতপাতাল থেকেই নাকি কারো পুত্র সন্তান সরবরাহ করা হয়েছিল…। তখন এরশাদ বিরোধী মনোভাবও মানুষের মধ্যে বিরাজ করছিল। সব মিলিয়েই মানুষ ফুসে উঠেছিল। সারাদেশেই মিছিল প্রতিবাদ হয়েছে। সরকার বাধ্য হয়েছে বিচার করতে।
এপ্রিল ২০১৯ সকালে উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত। মাদ্রাসার এক ছাত্রী সহপাঠী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করেছে, এমন সংবাদ দিলে সে ছাদে যায়। মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে ৮০% শতাংশই ঝলসে যায়। ১০ এপ্রিল ২০১৯ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাত এর মৃত্যু ঘটে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করা হয়। মাওলানা সিরাজ গ্রেফতার হলে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ওসি-এসপি ও নেতা সবাই মিলেই ধাপাচাপা দিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু এখনতো অনলাইন যুগ। অনলাইনেই মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলে। সেই ঝড়েই সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। ফাঁসির রায় হয় মাওলানা সিরাজসহ অপরাধীদের।
এসব দেখে মনে হবে যতদিন প্রতিবাদ থাকবে ততদিনই মানুষের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকবে। সাংবাদিক সাগর-রুণি নিজ কক্ষে খুন হন। নাট্যকর্মী-কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ দুটি ঘটনার নেপথ্যে খুবই শক্তিশালী-প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠে। দুটি ঘটনাতেই প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সারাদেশে মিছিল-প্রতিবাদ হয়েছে, অনলাইনে ঝড় উঠেছে, অভিযোগের তীর উঠেছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কিন্তু কিছুই হয়নি। কারো নামও চিহ্নিত করতে পারেনি প্রশাসন। মনে হতে পারে সাগর-রুণি-তনু নামের কাউকে যেনো কেউ হত্যাই করেনি।এমন ঘটনা দেখে উল্টোটাও মনে হবে- প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সহজে কিছু করা যায় না। আন্দোলনের মাত্রাটা যদি সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে তবেই সম্ভাবনা তৈরি হতো। সালেহা, রিমা ও নুসরাতের খুনিরা অত বেশি প্রভাবশালী ছিলেন না। তারাও খুনকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২০ বিকাল ৪:০৫