ফোনের গ্যালারীতে নানীর ছবি আছে। নানী মারা গেছেন বছর দেড় আগে। একটা পুরোনো ছবিতে তাকে মায়ের থেকেও অল্প বয়সী লাগে। একটা ছবি কত কত বছরের ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের সাক্ষী। মাকে এসব ছবি দেখাই, মায়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়, কেঁদে দেওয়ার আগ মূহুর্ত যেমন। মাকে তখন বিষণ্ণ লাগে, বিষণ্ণ কিন্তু সুন্দর। প্রিয় কোনো জিনিস যা হারিয়ে গেছে, আর ফিরে আসবে না - এই বোধ মানুষের মস্তিষ্কে কোনো হরমোন ক্ষরণ করায় এর জন্য মায়ের মুখ এমন হয়ে যায়।
আমি যখন তোমাকে না পাওয়ার কথা ভাবি আমার মুখও হয়ত তেমন হয়ে যায়। কখনো আয়না ধরে দেখিনি যদিও। তবে সেদিন দু চামচ চিনি নেয়ার পরও পানসে লাগে চা। শীতের সকালের রোদের তাপকেও বড্ড বিরক্ত মনে হয়। আকাশের দিকে তাকাই, পাখির উড়ে যাওয়া দেখি। আমার তখন একটা পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছা হয়। মা ফোন করেন। দু কথা বলতেই ওপাশ থেকে বলেন, 'তোর শরীর খারাপ নাকি?' কোনো সদুত্তর দিতে পারি না, দীর্ঘ সুরে না বলি শুধু।
রাত হলে যেন আরও বিষণ্ণ লাগে। ছোটবেলায় হাত পা ছিলে গেলে সেই ব্যথা দিন থেকে রাতে যেন দ্বিগুন হয়ে যেতো। মা বলতেন, 'ব্যথাফুলার যন্ত্রণা রাইতে বাড়ে'। ছোটবেলার হাঁটু ছেলা ব্যথার মতন তোমাকে না পাওয়ার ব্যথাও রাতে খুব বাড়ে। ছারখার লাগে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে পালাতে ইচ্ছা হয়। বাস্তবে পালাতে পারি না আমি, কল্পনায় পালাই। চোখ বুজে থাকি।
একদিন স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করলেন, 'সবচেয়ে দ্রুতগামী জিনিস কোনটা?' আমরা কেউ জেট বিমান, কেউ বিদেশী রেল বললাম। মৃদু হেসে স্যার বলেছিলেন, 'সবচেয়ে দ্রুতগামী জিনিস হলো মানুষের মন। এটা চাইলেই যেকোনো জায়গায় যেতে পারে।' আমি সেই মনের সহযোগে একটা মাঠে চলে যাই। মাঠ জুড়ে সরিষা। মাঝখানে ভ্যান গঁগের মত এক লোক একটা পিস্তল তাঁর বুক বরাবর ঠেকিয়ে আছেন। পিস্তল দেখিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'তুইও যাবি আমার সাথে?' আমি গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে যাই তাঁর দিকে৷পরপর দুটো আওয়াজ শোনা যায়। কোথা থেকে যেন একটা পাখির পালক উড়ে এসে আমার কপালের ক্ষত ঢেকে দেয়৷ বেশ বড় পালক। মনে হয় যেন মা তার কোমল হাত কপালে ঠেকিয়ে দেখছেন আমার গায়ে জ্বর এসেছে কিনা। চোখ বুজে আসে আমার, শেষমেশ ঘুমিয়ে পড়ি। একটা করুণ দিন অথবা করুণ জীবনের শেষ হয়৷