ভোর হবার খানিকটা আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় হাশেমের। বিছানা না ছেড়ে আধশোয়া হয়ে কি যেন ভাবতে থাকে সে। একটু পরেই সূর্য ওঠে৷ ভাঙ্গা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ে ঘরে। আবছা আলোতে সে জগ আর গ্লাস খোঁজে। গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷
হাশেম মিয়ার ছোট্ট সংসার। পরিবারের সদস্য বলতে কেবল রোগাটে বউ আর বছর সাত-আটেকের ছেলে। তবে তাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আরও একটা প্রাণী। লালী নামের পোষা গোরু। নাম লালী হলেও গায়ের রংটা পুরোপুরি লাল নয়। হাশেম তার বউকে প্রথম যে টকটকে লাল রংয়ের শাড়ি কিনে দিয়েছিল সেটা কয়েকবার ধোয়ার পর যে রংয়ের হয়ে গিয়েছিল ঠিক তেমন রং।
বাবা মারা যাবার সময় হাশেমের জন্য রেখে যান কয়েক বিঘে জমি আর একটা গোরু। সময়ের বয়ে যাওয়ার নিয়মে সেই গেরুটা আজ বড় হয়েছে কিন্তু জমির মাপ বাড়ে নি। বরং যেন আরো ক্ষয়ে গেছে। এই জমিতে ফসল ফলিয়ে কোনোরকমে দিন চলে হাশেমের৷ এবছর যেন ভাগ্য আর সহায় হল না। গত মাসে হওয়া বন্যায় জমি গিয়েছিল তলিয়ে। নষ্ট হয়েছে অর্ধেকের বেশি ফসল। ফসল বিক্রি করে দু-চার পয়সা লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা নিজদের তিনবেলা ডাল-ভাত এবছর কিভাবে জোটাবে এই চিন্তায় সারাক্ষণ চিন্তিত থাকে সে। হাশেমের বউ তার এই মনমরা অবস্থা দেখে বলে 'আপনে এতো চিন্তা হইরেন না। আল্লাহ না খাওয়াইয়া মারবে না৷' বউয়ের আশার বাণীতে মন ভরে না তার। মেয়ে মানুষ বিপদ আসার আগে খুব একটা ভাবে না। বিপদে পড়লে হাত-পা ছেড়ে দেয়।
সামনের দিনগুলো কেমন করে চালাবে হাশেম? অনেক ভেবেচিন্তে সে ঠিক করল লালীকে বেচে দেবে। সেই বিক্রির টাকা দিয়ে এবারের মত যদি টিকে থাকা যায়।
পাশের গ্রামের চেয়ারম্যান মতি খাঁ। দিন দুয়েক পর মেয়ের বিয়ে। বিয়ের ভোজের জন্য খুঁজছেন গোরু। দেশি গোরু। গ্রামে পেলে ভালো হয়। তা না হলে যে যেতে হবে দূরের শহরে। হাশেমের গোরু পছন্দ হয় তার৷ একটু দর কষাকষি হতেও দেখা যায়। শেষমেশ হাশেমের লালীকে কিনে নিলেন মতি খাঁ। দড়ি ধরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। গোরু অবলা প্রাণী। মানুষ হলে নেহাত বলেই উঠত, 'আমি আমার মালিক কে ছেড়ে কোথাও যাব না৷ আপনি আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন?'
সন্ধ্যে বেলা টাকা সমেত হাসিমুখে বাড়ি ফেরে হাশেম৷ সেই হাসিমুখটা পানসে হয়ে যায় উঠোনে বসেই কান্নার আওয়াজ পেয়ে। জোরে পা চালিয়ে ঘরে পৌছে দেখে তার ছেলে কাঁদছে৷ তার বউ রাগী সুরে বলে ওঠে, 'আপনের পোলায় জেদ ধরছে। লালীরে না আনোন পর্যন্ত হে নাকি ভাত খাইবো না'। লালী ছিল ছোট্ট বালকের একমাত্র পরম বন্ধু। সকাল সকাল তাকে খড়-ভুসি দেওয়া, কাঁচা ঘাস নিয়ে আসা, এটা-ওটা পাতা খাওয়ানো। এসব করেই দিন কেটে যেত বালকের৷ কত-শত স্মৃতি জমে আছে৷ কিভাবে সে তার বন্ধুকে দূরে রেখে থাকবে?
সত্যি বলতে লালীর জন্য হাশেমেরও যে খারাপ লাগছে না তা কিন্তু নয়৷ তবে হাশেম বুঝে গেছে যে কিছু মায়া ত্যাগ না করতে পারলে জগৎ সংসারে টেকা যায় না। ফসল না ফললে তো নিজেদের চুলোই আগুন জ্বলবে না। লালীর দেখ-ভাল করবে কি করে! এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে৷ তার ছেলে না খেয়েই ঘুমিয়ে যায়। আকাশে চাঁদ ওঠে৷ চারপাশ আলোকিত হয়৷ চাঁদের আলোয় একটা পাখি যেন গান ধরে। হাশেম মুগ্ধ হয়ে শোনে সেই গান।
সকাল সকাল আবারও কান্না জুড়ে দেয় হাশেমের ছেলে৷ তার লালীকে ফিরিয়ে আনতেই হবে । না হলে যেন এ কান্না থামবেই না৷ হাশেম ছেলেকে বোঝায়, 'বাবারে, আমরা হইলাম গরীব মানুষ। আমাগো অতো শখ-আহ্লাদ থাকতে অয় না৷ একদিন যহন আমাগো অভাবের দিন কাইটা যাইবো, তহন তোমারে লালীর চাইতেও বড় দেইক্কা গোরু পালনের লাইগা কিনা দিমু।' অনিশ্চিত আশার কথায় মন ভরে না বালকের৷ ধনী-গরীবের এই বৈষম্য বোধগম্য হয় না তার৷
ছেলের এই কষ্ট কেন জানি মেনে নিতে পারে না হাশেম৷ বউকে এক প্রকার না জানিয়েই টাকা নিয়ে হাঁটা দেয় মতলুব খাঁর বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনে গেট করা হয়েছে। বিয়ের গেট৷ হাশেমের মনে পড়ল মতলুব খাঁ তো সেদিন বলেছিলেন সামনে তার মেয়ের বিয়ে৷ চারপাশে অনেক মানুষ। মতলুব খাঁ পান মুখে পায়চারি করছেন৷ হাশেম তার কাছে গিয়ে বলল, 'একখান কথা আছিলো চেয়ারম্যান সাব। যদি কিছু মনে না নেন। আমি আসলে একখান ঝামেলায় পড়ছি। এহন গোরুডা ফেরত নিতে আইছেলাম। এই দেহেন পুরা টাকাই নিয়া আইছি'। অন্য সময় হলে হয়ত মতলুব খাঁ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বলতেন, 'ঢং করো ব্যাটা। তুই যখন গোরু ফেরত চাইতেই আসবি তবে বেচলি কেন?' কিন্ত এত এত অতিথির সামনে রাগ দেখানোটা মোটেও ভালো দেখাবে না। তাই তিনি নরম সুরে বললেন, 'হাশেম মিয়া, তোমারে তো বলছিলামই আমার মাইয়ার বিয়ার কথা। আমিতো আজকে ভোরেই গোরু জবাই করছি। তুমি আরো আগে জানাইলে হয়ত কিছু করন যাইতো৷ যাহোক আইছো যহন তহন মাংস নিয়া যাও। পোলাপান লইয়া খাইয়ো'।
হাশেম রওনা হয় বাড়ির দিকে। হাতে দড়ি নিয়ে গোরুসহ বাড়ি ফেরার কথা ভেবে বের হয়েছিল বাসা থেকে। ফিরছে এক পোটলা মাংস হাতে৷
বাবার হাতে মাংস দেখে নিজের করা পণের কথা বেমালুম ভুলে যায় ছোট্ট বালক। শেষ কবে সে গোরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে তা মনে করতে পারছে না৷ প্রতি কোরবানীতে মানুষের দেয়া দু-চার টুকরা হাড় খেয়ে মাংসের স্বাদ একপ্রকারে ভুলতেই বসেছে।
হাশেমের ছেলে মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে আর সে চেয়ে চেয়ে সেই সুন্দর দৃশ্যটি দেখছে৷ হঠাৎ তার চোখ বেয়ে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এই জল লালীর অনুপস্থিতির কারণে নাকি সন্তানকে মাংস দিয়ে ভাত খেতে দেবার কারণে তা জানা যায় না। হাশেমের কেন যেন মনে হয় লালীর তো কিছুই হয় নি। মাত্রই যেন তার ছেলের দেহের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে গেছে লালী। থেকে যাবে চিরকাল। কোথাও হারায় নি ও। কোথাও না। কিসব আবোল তাবোল ভাবছে সে! তার তো এখন মাঠে যেতে হবে। হাশেম বাইরের দিকে হাঁটা দেয়৷ সেদিনের সেই পাখিটি আবার গান ধরে৷ এবার আর হাশেম মুগ্ধ হয়ে শোনে না।