বাসা থেকে একটু দূরেই সালাম সাহেবের অফিস। দশ টাকা রিক্সা ভাড়া। সামান্য হলেও তিনি হয়ত কখনোই রিক্সায় চড়ে অফিসে আসা-যাওয়া করেন নি। রোদ-বৃষ্টিতেও পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করছেন দীর্ঘ বছর ধরে। আশেপাশের মানুষজন তাকে কৃপণ মনে করলেও তার মতে তিনি মোটেও কৃপণ নন। একটু হিসেবি এই যা !
বিকাল ৫ টা। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মনে হচ্ছে এখনই ঝরঝর করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। কিছুদূর যেতেই শুরু হল বৃষ্টি। সালাম সাহেবের মনে হল সঙ্গে ছাতা রাখাটা বু্দ্ধিমানের মত কাজ হয়েছে। তিনি ছাতা মাথায় এগিয়ে চলছেন। ছিদ্র হয়ে যাওয়া পুরোনো ছাতা থেকে পানি গড়িয়ে তার শরীর ভিজে যাচ্ছে।
বাসার কাছে আসতেই শরিফ ডাক দিল। শরিফ তার বাসার পাশের খিচুরি বিক্রেতা। খুব ভালো খিচুরি বানায়।
'স্যার, দুই প্লেট খিচুরি নিয়া যান। বৃষ্টির দিনে খাইতে ভালো লাগবো।'
'আজ না শরিফ। নীলু,শেলু আসুক তারপর বেশি করে নেব।'
নীলু,শেলু ছিল তার কাছে অজুহাত মাত্র। সত্যি বলতে মাসের শেষের দিকে বাইরে থেকে খিচুরি আনিয়ে খাওয়া তার কাছে বিলাসিতা মনে হয়। নীলু তার মেয়ে। বিবাহিতা। সুখের সংসার করছে। বছরে দু-চারবার আসে বাবা-মার সাথে দেখা করতে। তার ছেলে শেলু বাড়ি ছেড়েছে বছর তিনেক হলো। ভার্সিটিতে পড়ছে।
সালাম সাহেবের সুন্দর সংসার। তিন রুমের এক বাসায় থাকছেন বেশ কবছর ধরে। বাড়িওয়ালা খুবই ভালো। আর অনেক দিনে ভাড়াটাও বাড়াচ্ছেন না। এসব ভেবে বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছা জাগে নি। তবে তিনি স্বপ্ন দেখেন নিজের বাড়ি করার। ঢাকা দেখে একটু দূরে জমিও কিনেছেন। কিছুদিনের মধ্যে হয়ত বাড়ি বানানোর কাজও শুরু করে দিবেন।
তিনি জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন। কিছু সত্যি হয়েছে, আবার কিছু ভেঙ্গে গেছে শুরুর আগেই। কৈশোরের প্রিয়জনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও আল্লাহ তার জীবনের অনেক স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল প্রথম সন্তান যেন মেয়ে হয়। তিনি একটা বইয়ে পড়েছেন, যাদের প্রথম সন্তান মেয়ে তারা ভাগ্যবান। আল্লাহ নীলুকে উপহার দিয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। নীলুকে প্রথম কোলে নেবার দৃশ্য তার চোখে এখনো জ্বলজ্বল করছে।
সালাম সাহেবকে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে আজকের এই অবস্থানে আসতে হয়েছে। সামান্য বেতন দিয়ে অনেক হিসেব করে সংসার চালিয়েছেন। এখন যদিও প্রমোশন পেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন। একটা সময় স্ত্রীকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারেন নি, অসুখ বিসুখে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারেন নি। এসব বিষয় নিয়ে ভাবলেও এখন আর তার চোখে জল আসে না। নিজেকে চারপাশে যেন একটা দেয়াল তৈরি করেছেন। কষ্টরা যেন ঢুকতেই পারে না। শেষবয়সে তার খুব বেশিকিছু চাওয়ার নেই। তার দুচোখে একটাই আশা। নিজের বাড়িতে রাজার হালে থাকবেন, বারান্দায় কফি হাতে হারিয়ে যাবেন অজানায়!
এক ধরনের মানুষ আছে যারা স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তিমত ঘুমাতে পারে না। সালাম সাহেব সেই ধরনের মানুষ। তাকে এখন একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলতে হবে। এসব ভেবে তিনি এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। যে উত্তেজনার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
সালাম সাহবের বন্ধু ফরহাদ সাহেব। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘদিন পর ফরহাদ সাহেবের বাসায় উপস্থিত হলেন তিনি। দু কাপ চা নিয়ে এসেছেন ফরহাদ সাহেব। চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প করছেন দুজন। মনে হলো যেন আঠারো-উনিশ বছরে চলে গেছেন।
ফরহাদ সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন বাড়ির ব্যপারে আলোচনা করতে। সারা জীবনের সব জমানো সঞ্চয় দিয়ে তিনি বানাবেন তার প্রিয় বাড়ি। তার নাতী-নাতনীরা বাড়িতে ছোটাছুটি করবে, ফুলগাছে পানি দেবে। ওদেরকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে মনে মনে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করে নিজেও ঘুমিয়ে পড়বেন। দিন-রাত এসব স্বপ্নই দেছেন তিনি। সালাম সাহেবের চোখে-মুখে এক অন্য ধরনের তৃপ্তির ছাপ। জীবন যেন তার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছে। ভালো একটা দিন তারিখ দেখে তিনি বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেবেন।
সালাম মঞ্জিল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সালাম সাহেবের রাজ্যের ব্যস্ততায় দিন কাটে। দিনে কাজের তদারকি তো রাতে হিসাব-নিকাশ। কোনোমতে অফিসটা করেই চলে যাচ্ছেন বাড়ির কাজ দেখতে। ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না কদিন ধরে।
বাড়ির অর্ধেকমত কাজ শেষ। এতদিন শরীরের উপর যত্ন না নিতে নিতে সালাম সাহেব শুকিয়ে গেছেন। রাতের ঘুমও চলে গেছে। বাড়ি তৈরির চিন্তা, অফিসের চাপ, খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অবহেলা যেন তাকে দিনি দিন পিষে ফেলছে। এটুকু তিনি ইতোমধ্যে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন।
সকাল থেকেই ভীষন জ্বর সালাম সাহেবের। তিনি চোখ বুজে শুয়ে আছেন বিছানায়। তার স্ত্রী মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছেন। রাতে কয়েকবার বমি দিয়ে অচতনের মত ঘুমিয়ে রইলেন। শেষরাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি শুনেছেন ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়। তার কাছে সমস্ত পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হিসেবে ধরা দিল। শিরদাড়া দিয়ে যেন বয়ে গেল এক অজানা স্রোত। তিনি লক্ষ করলেন তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন তিনি তার একান্ত নিজের বাড়িতে পৌছেছেন। দূর্ভাগ্যক্রমে সেটি সালাম মঞ্জিল ছিল না!