শৈশবে দেখা নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা চরিত্র মনে দাগ কাটে সেটা হলো ডাক্তার কদম আলী (ডিগ্রী নাই)। কদম আলী নানা রোগের চিকিৎসা করেন নিজ হাতে বানানো বড়ি দিয়ে। নিশ্চয়তা দেন উপকার না হলেও ক্ষতি হবেনা । পরে জানা গেলো এ দাবী রহস্য, তিনি নিজ হাতে বাজার থেকে খাটি ময়দা কিনে, স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে শুকিয়ে তারপর বড়ি তৈরী করেন। তাই প্রতারক হলেও তার দাবীতে তিনি অসৎ নন, ওষুধের গুণাগুণ বড়িতে না থাকলেও তা মানুষের ক্ষতির কারন হচ্ছেন না। এর ফলে কিছু রোগী ওষুধের প্লাসেবো (placebo) ব্যবহারে ভালো হচ্ছেন।
এইত গেল সেকালের কদম আলীদের নিয়ে নাটক চিত্রনের কথা। এখনও গ্রামে গন্জে কদম আলীদের দেখা পাওয়া যাবে, তবে আজকালকার দিনে আরো অনেক বড় কদম আলী আছেন যাদের নৈতিকতা বোধ সেই পুরনো কদম আলীদের মত অতটা ফেলনা নয়, এরা প্রতারণাটিকে একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আর তাই এইসব নতুন কদম আলীদের বড়িতে রোগ নিরাময় না হলেও ক্ষতি হবেনা এইরকম ব্যাপার নেই । তাহলে ব্যাপারটি কি? চলুন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আপনাদের কিছু নতুন কদম আলীদের কাহিনী শোনাই। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত দেশের একটি প্রধান ওষুধ কোম্পানীর রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে কাজ করার সময় কাজের অংশ হিসাবে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর তৈরী বিভিন্ন ওষুধের (এখানে বড়ি হিসাবে উল্লেখ করবো) ব্যাপারে অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো দুএকটি পর্বে।
১৯৯৭ এর মাঝামাঝি। বি ফার্ম অনার্স পরীক্ষা শেষ করে ডিগ্রীর জন্য দরকারি ১ মাসের ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ট্রেনিং নেবার জন্য আমরা চার বন্ধু গেলাম দেশের অন্যতম প্রধান ওষুধ কোম্পানী এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেড এ । প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস। বিভিন্ন সেকশন দেখা, খুটিনাটি লিখে রাখা কারন ট্রেনিং শেষে একটা রিপোর্ট দিতে হবে । যথা সময়ে ট্রেনিং শেষ হলো। বেশ চমৎকার একটি সময় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেলো। আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে দুজনের ভিতর একটা প্রতিযোগিতা ছিল। আরো নির্দিষ্ট করে বললে আমার এবং ত্রপা (ছদ্মনাম) এর মধ্যে। ত্রপা আমার ভাল বন্ধু, মেধাবী ছাত্রী, আমাদের সেকেন্ড গার্ল আর আমি বরাবরই ওর চাইতে সামান্য এগিয়ে থেকে ফার্স্ট । আমার মত অগোছালো ও অনিয়মিত কারো ফার্স্ট হওয়াটা অনেকের কাছেই অবাক লাগতো এবং মেনে নিতে কষ্ট হতো। যার ফলে এই ট্রেনিং এর মধ্যেও একটা ক্ষুদ্র প্রতিযোগিতা মত ব্যাপার ছিলো।
যাহোক যথারীতি ট্রেনিং শেষে রিপোর্ট জমা দিলাম। সবাই জমা দেবার আগে পুরনো বছরের বিভিন্ন বড় ভাইয়ের রিপোর্টের কয়েক কপি জোগাড় করেছি। রিপোর্ট জমা দেবার পর দেখা গেলো তিনজনের রিপোর্টে এসকেএফ এর একগাদা প্রশংসা। প্রশংসা করাটাই স্বাভাবিক। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি, এসকেএফের আধুনিক যন্ত্রপাতি আর সুশৃংখল উৎপাদন পদ্ধতি দেখে আমাদের চোখে মুগ্ধতা না থাকার কথা নয়। সব শেষে আমার রিপোর্ট পড়তে গিয়ে হোচট খেল কর্তৃপক্ষ । প্রশংসা আছে তবে প্রতিটি বিভাগ নিয়েই অনেক সমালোচনা এবং কিছু সাজেশন।
এসকেএফের তৎকালীন প্রডাকশন ম্যানেজার আহসান হাবিব রুমি (বর্তমানে অন্য একটি কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক) তার চালু করা বিভিন্ন নিয়ম কানুনের এত উন্মুক্ত সমালোচনায় অবাক হলেন, বসলেন আমার রিপোর্ট নিয়ে, আলাদাভাবে আমাকে ডিফেন্ড করতে হলো রিপোর্টকে। তিনি আসলে একজন ভিন্ন ধাতের মানুষ ছিলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র যার প্রথম দেখা কোম্পানীই এসকেএফ, তার রিপোর্টকে তিনি ধারণার বাইরে গুরুত্ব দিলেন। সরাসরি প্রস্তাব দিলেন চাকরীর। পার্ট-টাইম নয়, একেবারে ফুল টাইম। তার সাফ কথা, আসো তোমার দেখিয়ে দেয়া লিমিটেশনগুলো কিভাবে দুর করা যাবে দেখাও। এর সাথে সাথে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে কাজ করো।
আমার অবস্থা তখন ত্রাহি মধূসুদন। বলে কি? এখনো অনার্স এর রেজাল্ট বের হয়নি, সামনে মাস্টার্স পড়ে আছে, আমি ক্লাসে ফার্স্ট বয়, চাকুরী করে পড়াশোনা করবো কেমন করে? আর করলেই রেজাল্টের কি অবস্থা হবে? তখন যে অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখি!! অনার্সে প্রথম হবো... মাস্টার্স এ প্রথম হবো.... এই করবো... সেই করবো..। কিন্তু এই চ্যালেন্জ না নেয়াটাতো কাপুরুষের মত ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে!! নিলেও যে ক্যারিয়ারের সাথে বড় ধরনের আপোষ করতে হবে। এমনকি পুরো ক্যারিয়ারেরই বারোটা বেজে যেতে পারে।
মনের দোদুল্যমনতা মুখে আসলোনা। অবাক হয়ে দেখলাম সরাসরি চাকরীর অফার কবুল করে ফেললাম। তখনও অনার্সের রেজাল্ট দেয়নি, মাস্টার্স এর ক্লাস কবে শুরু হবে তার ঠিক নাই। নিজেকে প্রবোধ দিলাম শুধু এই সময়টুকুর জন্য চাকরী। মাস্টার্স এর ক্লাস শুরু হলোই ছেড়ে দেবো। সৃষ্টিকর্তা অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তখন কি জানতাম চার-চারটি বছরের জন্য আটকে যাচ্ছি এক জালে!!
শুরু হলো আমার প্রতিষ্ঠিত আর অপ্রতিষ্ঠিত কদম আলীদের চেনার পাঠ ।
(চলবে)....
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১০:৫৯