দবির উদ্দীনের ঘুম ভাঙ্গে বুকে প্রচণ্ড ব্থা নিয়ে। চাপ চাপ ব্যথার সাথে দমও বন্ধ হয়ে আসছিল। ক’টা বাজে দেখার জন্য দেয়ালের দিকে তাকায় সে। কিন্তু ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেয়াল ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় লোডশেডিং হচ্ছে। অস্ফুট স্বরে স্ত্রীকে ডাকে সে, শান্তা! শান্তা! দুইবার ডাকার পর মনে পড়ে স্ত্রী পাশে নেই। এমনকি বাসাতেও নেই। স্ত্রী-মেয়েসহ শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল। তার কাজ থাকাতে চলে আসে। মেয়ের স্কুল বন্ধ তাই তারা আর ক’দিন থেকে আসবে।
দবির উদ্দীনের মনে হচ্ছে বুকের বাম পাশটায় কেউ খামচি দিয়ে চেপে ধরেছে। বুকের ভেতরের সবকিছু যেন ছিঁড়ে ফেলতে চাচ্ছে। শরীরের ঘামে বিছানা বালিশ সব ভিজে গেছে। তার ছা পোষা মধ্য তিরিশের কেরাণী জীবনের মতো মাথার উপরের ফ্যানটাও স্তব্ধ হয়ে আছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু কী করবে বা কী করা উচিৎ তার কিছুই মাথায় আসছে না। নাক-মুখ দিয়ে এক সাথে বড় বড় করে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে দবির উদ্দীন। তাতেও কোনো আরাম বোধ হচ্ছে না। শ্বাসকষ্টটা যাচ্ছে না। শ্বাসকষ্টের সাথে সাথে তীব্র পিপাসা বোধ করে দবির উদ্দীন। বিছানায় বসে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সে। মোবাইল ফোনের স্ক্রীনের আলোতে ফ্রিজের কাছে যায়। ফ্রিজ খুলে ঠা-া পানির বোতল থেকে গলায় অনেকটা পানি ঢেলে দেয়।
একা বাসায় এই অবস্থায় চরম অসহায় বোধ করে দবির উদ্দীন। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ আপনজনদের মুখগুলো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। বাবা মারা গেছেন চার বছর হয়; মা-ও চলে গেছেন এক বছর আগে। বাবা মৃত্যুর সময় বলে গেছেন পাড়ার শরীয়তপুর ফার্মেসীতে সাত শ’ টাকার মতো বাকি আছে। মা মারা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, প্রতিবেশি এক কাকীর কাছে তার দুই হাজার টাকা ঋণ আছে। ভেবেছিল পরিশোধ করে দিবে। আজ দিবে কাল দিবে করে এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয় নি ভেবে এই মুহূর্তে তার খুবই অনুশোচনা হচ্ছে। আসলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দিতে পারে নি। মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন শেষ হয়ে যায়। তার নিজের ঋণের পরিমাণও লক্ষ টাকা ছাড়াবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে চাপটা একটু কমে আসে। একটু সহজ হয় শ্বাসপ্রশ্বাস। ব্যাথাটা থেকে গেছে এখনও আগের মতোই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দবির উদ্দীন চলে আসে সিঁড়ির দরজার কাছে। নবটা ঘুড়িয়ে দরজা খুলে কপাটটা একবারে পেছনের দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয়। তারপর কপাটে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। পাশের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে কারো নাক ডাকার আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের অবিশ্রান্ত ডেকে চলা ছাড়া কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। ডান হাতে বুক চেপে ধরে বাম হাতে মোবাইলে সময় দেখে৷ রাত তিনটা বাইশ৷ তারপর স্ত্রী শান্তার নাম্বার ডায়াল করে। চারবার রিং বাজার পর শান্তা ফোন ধরে।
-হ্যালো শান্তা! প্রথমে কথা বলে দবির উদ্দীন নিজেই
-হ্যালো দবির! কী হয়েছে তোমার? স্ত্রীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কানে আসে দবির উদ্দীনের।
-কিছু না শান্তা! আই লাভ ইউ!
-এই কথা বলার জন্য এত রাতে তুমি আমাকে ফোন দিয়েছ? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখতে দেখতে তোমার ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।
-মেয়েটা কী করে? ঘুমায়?
-হুম, মেয়ে ঘুমায়। কিন্তু তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? তোমার কী হয়েছে দবির?
শান্তার শেষ কথাগুলো দবির শুনতে পায় না। একটা দলা পাকানো ব্যাথার তীব্র আক্রমণে শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে দবির উদ্দীন। ধপাশ করেই মেঝেতে পড়ে যায় তার শরীরের উপরের অংশ। মোবাইলটা পড়ে যায় হাত থেকে।