চলুন একটা অংক কষি।
ছোট্ট বেলায় অংক করতাম। চার টাকা আর চার টাকা সমান সমান আট টাকা। আবার মা বলতেন, তোমাকে ১০ টাকা নিয়ে বাজারে পাঠালাম। বাজার থেকে ২ টাকার মাছ, ২ টাকার কাঁচা বাজার, ২ টাকার তরকারী কিনে আনলে কতটাকা ফেরত দিবে? আমি হাতের আঙ্গুল কষে কষে বলতাম। আম্মু খুশী হয়ে ১ টাকা দিতেন। সে’কি লাফ দিতাম। হৈচৈ পড়ে যেতো চারিপাশ। আম্মুকে দেখতাম কি যেন হিসেব করেই যেতেন বারবার। তখন অতটা বুঝতাম না আজ যতটা বুঝি।
অষ্টম শ্রেণিতেই আমি প্রথম বীজগণিত পাই। গণিতে আমি কিঞ্চিত ভালো ছিলাম। অন্যত্র থেকে আসার ফলে সকল ক্ষেত্রেই আমার জন্য ছিলো চ্যালেঞ্জ। মা বলতেন “আমি জানি তুমি পারবে” সেই একটি কথাই যেন আমাকে পারতে হতো। আমি চেষ্টা করতাম কুপির আলোর ভীতর। পাশেই বসে থাকতেন মা। আমার চাইতেও তাহাকেই ক্লান্ত দেখতাম কিন্তু পরা না শেষ করা অব্দি উঠতেন না। আজ বুঝি তাহার সে বসে থাকার রহস্য কি...
এসএসসি পরীক্ষা দেবার সময় মা কেঁদেছিলেন। আমি শুধু মা’কে বলেছিলাম তোমার ছেলে ফেল করবেনা এটা নিশ্চিত থাকো। আল্লাহ চাইলে অনেকের চাইতেও ভালো রেজাল্ট করবো। খালাম্মা আর খালাতো ভাইগুলো তখন অনেক শিক্ষিত। আম্মুর ইচ্ছে ছিলো আমিও যেন তা হই। কতটুকু হতে পেরেছি জানিনা কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিন নিজেই গিয়ে রেজাল্ট আনি। মায়ের মুখের সেদিনের হাসিটা আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
এইচএসসি থেকেই সংগ্রামের শুরু। টিউশনি, পড়া আর পড়া। মা বলতেন নিজের যুদ্ধে নিজে না নামলে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্ত তোমার। পড়াকেই ভালো লাগতো। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের পরাতাম। ফাঁকে ফাঁকে বাবার ব্যবসায় সময় দিতাম। বাবা যেন ঠিক থেকেও না থাকার মতই ছিলেন। সে কিসসা না বলে এইচএসসি পাশের তৃপ্ততার ঢেঁকুর তুললাম।
পড়াশুনা আর করবোনা। পরিবারের হাল ধরবো বলেই ঢাকায় আমার অবস্থান। খালাতো ভাইগুলো আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করলো। কেউ এখানে কেউ ওখানে বলে বলে শেষ পর্যন্ত কোন প্রস্তুতি ছাড়াই সরকারী কলেজে হিসাববিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। পেট চলতে ও চালাতে টিউশনের সাথে এখন যোগ করলাম খন্ডকালীন শিক্ষকতা। সেখান থেকেই আসল যুদ্ধটা শুরু। রোমান্স নামক ভালোবাসারা কাছে ভীড়লেও বারবার বেড়িয়ে গেছি গভীর মাটি বাইং মাছের মতই। ইহা আমার জন্য ছিলোনা বলেই...
জীবনে ভালোবাসা বলতে আমার একটাই আঁচল ছিলো। আমার কাছে একটাই বিশ্বাসের যায়গা। যেখানে কোন দিন নেই, ক্ষণ নেই, সময় নেই। তিনি আমার “মা” অনেক মেয়ে দেখেছি, অনেক সংগ্রামের কাহিনী পড়েছি কিন্তু আমার মায়ের মতন হয়নি। আমার সংগ্রামের মতন নয়। হয়তো আরোও কঠিন কেউ কেউ তবে আমি মহাখুশী এই শিক্ষাকে নিয়ে। রব এখানেই আমার জন্য বরকত রেখেছেন। আর তাইতো মায়ের মুখের এক চিলতে হাসির জন্য জীবন কোরবানি দিতেও দ্বিধা হয়না।
আমি যে অংকের হিসেব কষতে ছিলাম। চলেন না একটা কাজ করি। আজ অন্যধর্মের কিংবা যে লোকটা ইসলামের নয় কিন্তু তাহারা একটা দিবস দিয়েছেন। আর আমরাও পালন করেই যাচ্ছি। আর তাহাকে উত্তম হিসেবে ব্যবহার করি। যেমনি ভাবে বীজগণিতের সূত্রের ন্যায় মাইনাস আর মাইনাসে প্লাস হয়। তাহাদের দেয়া আধুনিকতায় ভালোবাসা বিনিময় করি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষগুলোকে। বিশ্বাস করেন, থমকে যাবে। জড়িয়ে (হাগ) ধরবে। যে তৃপ্ততা আমি ১০০ সুন্দরী মেয়ে কিংবা ১০০ সুন্দর পুরুষের সাথে জড়িয়ে ধরে পাবেন না। যতটা পাবেন আপনার মা-বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরলে। এটা বন্ধন, রক্তের স্পন্দন, এটা অন্যরকম অনুভূতি। যা আসলেই ভাষায় প্রকাশিত নয়।
অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো মা, আজ একবার জড়িয়ে ধরে গন্ধটা নেই তোমার আঁচলের। চাকুরি নামক দায়িত্বের ফলে পারিনি। তবে খুব শীগ্রই হবে। ভালোবাসা দিবসে বারবার তোমাকে না বলা কথাটাই বলে বেড়াই। নিজের অজান্তেই শান্তনা দেই। বড্ড ভালোবাসি মা। বড্ড ভালোবাসি হে মহিয়সী নারী। তোমাকে নিয়ে আমার কলমের কালি শেষ হবার নয়। তুমি আমার শুধু মা নও। তুমি আমার আসল শিক্ষক, পথ প্রদর্শক। তোমার গর্ভে জন্ম নিয়ে আমি ভাগ্যবান। তুমি শুধু বেঁচে থাকো এই দোয়াই করি আজকের দিনে। বেঁচে থাকুক সকল মা-ময় নারীরা। হারিয়ে যাক সকল ছলনাময়ীরা।
সকলকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। যে ভালোবাসাতে ফুটে উঠুক আসল তৃপ্ততা, আসল সুখময় বন্ধন। যে অংকের হিসাবে সদাই যোগফল বাড়বে কমবেনা। যে অংক কষে শেষ হবার নয় কক্ষনোই।
ভালোবাসা দিবস হতে আমার ভালোবাসার অংক / মিনহাজ উদ্দিন
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:৫৬