সকালের মিষ্টিরোদ সবেমাত্র সতেজ হয়ে উঠছে। ঘড়ির কাটায় ঠিক দশটায় নরওয়েজিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট হেলসিংকি বিমানবন্দর থেকে আমাদের নিয়ে স্টকহোমের আরলান্ডা (Arlanda) বিমানবন্দরে অবতরন করেছে। সংখ্যায় আমরা প্রায় পনেরজন, উদ্দেশ্য চারদিনব্যাপী একটি কনফারেন্সে যোগ দেওয়া। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। তিনি হলেন ডঃ আব্দুস সবুর। এখন সস্ত্রীক স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ভদ্রলোকের গাড়িতে পর্যাপ্ত যায়গা না হওয়ায় গন্তব্যে পৌছতে আরও একটি ট্যক্সিক্যাব ভাড়া করা হল। আমি আর বন্ধু শহীদুল বিমানবন্দরেই থেকে গেলাম। পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আমাদের দুজনের প্রথম গন্তব্য স্টকহোমে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী। উল্লেখ্য সুইডেন ছাড়া স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশের কোন অ্যাম্বাসী না থাকায় পাসপোর্ট সংক্রান্ত কার্যাবলী সম্পাদন করার জন্য বাংলাদেশীদের সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ছুটতে হয়।
আমাদের দুজনকেই অতিরিক্ত খরচ বাচাতে কনফারেন্স কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দুটি ভ্রমন কার্ড দেওয়া হল। মোবাইল ফোনে যে ভদ্রলোক অ্যাম্বাসীতে যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিচ্ছিলেন তা যে কিঞ্চিত বিভ্রান্তিকর ছিল কিছুক্ষন পরেই বুঝতে পেলাম। স্থানীয় লোকদের তথ্যগত সহায়তায় ঠিক ঠিক অ্যাম্বাসীতে পৌছলাম। সূর্যটা তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়তে আরম্ভ করেছে। রৌদ্রের তীব্রতা একেবারেই নেই। সাথে হালকা বাতাস প্রান চাঞ্চল্য এনে দেয়। এর আগেও একবার অ্যাম্বাসীতে এসেছিলাম। সামান্য কিছু কাজ থাকায় সেবার কোন রকম হয়রানির স্বীকার হতে হয় নি। শহীদুলের অবশ্য এটাই প্রথম যাওয়া। তাই অ্যাম্বাসী দর্শনে ভড়কে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। মেট্রো থেকে নেমে মাত্র একশ মিটার দুরত্বে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসীর অবস্থান। অ্যাম্বাসী সম্পর্কে মানুষের যে ধারনা বা অভিজ্ঞতা তাতে অবশ্য একেবারে না জানা থাকলে কারও বুঝার উপায় নেই এখানে আদৌ কোন অ্যাম্বাসী রয়েছে। কয়েক মিটার দূর থেকেই চোখে পড়ল বাংলাদেশের পতাকা। বহুতল একটি ভবনের দোতলার একটি কক্ষের জানালা দিয়ে অনেকটা আড়াআড়িভাবে রাস্তার দিকে হেলানো অনেক সাধনার বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা। তাতেও উড়ার পতপত শব্দ বেশ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে। তখনও শহীদুল অ্যাম্বাসী চিনতে পারে নি। কয়েক গজ দূর থেকে এটিই বাংলাদেশের অ্যাম্বাসী বলার পর শহীদুলের হুশ ফিরল। দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়লাম।
স্টকহোমে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসী
রাস্তার পাশে অবস্থিত বহুতল ভবনটির দোতলায় মাত্র গুটিকয়েক কক্ষ নিয়ে স্টকহোমে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসী। অ্যাম্বাসীর এমন বেহাল দশা প্রত্যক্ষ করে যে কারোরই হাসি পাওয়াটা স্বাভাবিক। স্টকহোমে অবস্থিত অন্য কোন দেশের অ্যাম্বাসীর এমন জীর্ণদশা আছে কিনা সেটা যাচাই করার সুযোগ অবশ্য হয় নি। কিছুটা আনমনা হয়ে গেলাম। মনে হল আমরা অবহেলার স্বীকার। যাইহোক ভবনে অন্তরীন হয়ে দোতলায় ওঠার জন্য লিফটের সহায়তা নিলাম। অ্যাম্বাসীর ভিতরে ঢুকতেই ডানদিকে চশমা পরিহিত কালো কুচকুচে গোঁফধারী এক ভদ্রলোককে চোখে পড়ল। বেলা বারটা বেজে মাত্র কয়েক মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। ভদ্রলোককে আমাদের আসার হেতু বলতেই চশমার অগ্রভাগ দিয়ে চোখ দুটি বের করে কিঞ্চিত ভ্রু কুচকিয়ে উত্তর দিলেন, বারটার পরেতো পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোন কাগজ জমা নেওয়া হয় না। কাকুতি মিনতি করে সুদূর ফিনল্যান্ডে থেকে আসার কিচ্ছা বর্নণা করা বাদ তিনি পাসপোর্ট ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক কাগজপত্র জমা নিতে রাজি হলেন। কতক্ষন লাগবে জিজ্ঞেস করতেই উল্টো আমরা কখন ফিনল্যান্ড ফেরত যাব এবং আগামীকাল নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন। অনাকাঙ্খিত ঝামেলা এড়াতে একটু হেকমতের আশ্রয় নিতে হল। যেহেতু আমরা একটা কনফারেন্সে এসেছি কোনভাবেই আগামীকাল আসা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারিখটা গোপন রেখে শুধু বললাম আমাদেরতো ভোর পাঁচটার সময় ফিরতি ফ্লাইট। একথা শুনে তিনি আমাদের ঠিক তিনটার সময় আসতে বললেন। মজার ব্যাপার হল আামদের ফিরতি ফ্লাইট ভোর পাঁচটায় হলেও সেটা ছিল চারদিন পর যেটা ভদ্রলোক বুঝতে পারেন নি, বলা যায় আমরা বুঝতে দেই নি। তারপরও কিছুটা মন খারাপ হল। মাত্র পাঁচ দশ মিনিটের কাজের জন্য তিন ঘন্টা অপেক্ষা করানো অমানবিক। প্রশাসনের কাছে সাধারন মানুষের জিম্মিদশা বেশ ভালভাবেই অনুভব করলাম।
প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। কনফারেন্সস্থলে যেতেও অনেক দেরি হবে। আবার ইউরোপিয়ানদের খাবার খেয়ে পেট ভরলেও কখনও মন ভরাতে পারি না। অগত্যা কোন উপায়ান্তর না দেখে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকে হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। প্রায় তিনঘন্টা সময় কি করব কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। বারবার অ্যাম্বাসীর এমন অপকর্মের জন্য মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিল। কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছিল না। বেশ খানিক্ষন হাটাহাটি করার পর বড় একটা ঘাসের মাঠ দেখে সেদিকে পা বাড়ালাম। অনেকেই এ দেশীয় স্টাইলে রোদ পোহাচ্ছে। সবুজ ঘাসের উপর চাদর বিছিয়ে কোনরকম লজ্জাস্থান ঢেকে দিব্যি মনের খায়েস মিটাচ্ছে। আমরা দুজন মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লাম। আমাদের দিকে কিছু কৌতুহলী ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি লক্ষ্য করলাম। এখানেও মন টিকল না। উঠে পড়লাম। কিছুক্ষন এদিক সেদিক পায়চারি করে বেলা আড়াইটায় আবার অ্যাম্বাসীতে গেলাম। আধা ঘন্টা আগে যাওয়ায় অ্যাম্বাসীর লোকদের বিরক্ত না করে সোজা গিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে কর্মরত সেই ভদ্রলোক পুরনো ভঙ্গিতে শহীদুলের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন। শহীদুল উঠে যেতেই পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হল। অ্যাম্বাসীর কাজ শেষ হওয়ায় দুজনেই হাফ ছেড়ে বাচলাম।
নিচে নেমে জাতীয় পতাকার দিকে শেষ দৃষ্টি দিয়ে কনফারেন্সস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম। যাতায়াতের মাধ্যম মেট্রো এবং বাস। এর আগে স্টকহোমের মেট্রো সেবা নেওয়ার সামান্য সুযোগ হলেও ইতিপূর্বে লোকমুখে শোনা নানা কিচ্ছা আগ্রহের মাত্রাকে এখনও বেশ বলবৎ রেখেছে। স্টকহোমের মেট্রো রেলপথ হেলসিংকির তুলনায় অনেক উন্নত যেটা স্টকহোম সাবওয়ে (Stockholm Subway) নামে পরিচিত। ১৯৫০ সালে স্টকহোমে প্রথম মেট্রো সার্ভিস চালু হয় বর্তমানে যার দৈর্ঘ্য একশত পাঁচ কিলোমিটেরের চেয়েও বেশি। পুরো স্টকহোম মেট্রো স্থানভেদে গ্রীন (Green Line), ব্লু (Blue Line) এবং রেড লাইন (Red Line) এই তিন ভাগে বিভক্ত যাতে সবমিলিয়ে একশত স্টেশন রয়েছে। এরমধ্যে সাতচল্লিশটি স্টেশনই মাটির নিচে অবস্থিত। জানা যায় পৃথিবীর সর্বপ্রথম মেট্রো রেল চালু হয় ১৮৬৩ সালে লন্ডনে যার নাম লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেট্রোগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক সাবওয়ে (New York Subway), সাংহাই মেট্রো (Shanghai Metro) এবং লন্ডন আন্ডারগ্রায়ন্ড (London Underground) উল্লেখ্যযোগ্য। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে স্টকহোমেরর অবস্থান একেবারে উপরের দিকে। যোগাযোগ, প্রযুক্তি সর্বক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছোয়া। তার সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যোগ হয়ে অত্যাধুনিক নগরে পরিনত হয়েছে স্টকহোম।
কনফারেন্সস্থলে পৌছতে চারটা বেজে গেল। কোনরকম খাওয়ার কাজটা সাঙ্গ করে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। অনুষ্ঠানের গুনগত মান এতই নজরকাড়া আর আকর্ষনীয় ছিল কখন যে চারদিন সময় অতিবাহিত হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। নিয়মিত প্রোগ্রামের পাশাপাশি খেলাধুলা, হৈ হুল্লোড় করে কেটে গেল সময়। কনফারেন্সের শেষদিন দুপুর দুইটায় গাটের বাক্স নিয়ে সকলেই কনফারেন্সস্থান ত্যাগ করতে প্রস্তুত। আমাদের ফ্লাইট পরেরদিন ভোর পাঁচটায়। আমি, শহীদুল, সোহাগ, এহসান আর নুর ইসলাম ভাই পাঁচজন স্টকহোম শহরটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের সাথে গাইড হিসেবে আসাদ ও সুজন নামে স্টকহোমে বসবাসরত দুজন বাংলাদেশীও ছিল। ওদের বাসায় ব্যাগগুলো রেখে বেরিয়া পড়লাম শহরে দেখতে। আমাদের প্রথম গন্তব্য স্টকহোমের বিনোদন পার্ক যা ত্রিভলি গ্রোনা লান্ড (Trivli Gröna Lund) নামে পরিচিত যার অর্থ সবুজ কুঞ্জবন (Green Grove)। গ্রোনা লান্ড স্টকহোম শহরের জুরগার্ডেন দ্বীপে (Djurgården island) একেবারে সমুদ্রাভিমুখে অবস্থিত হওয়ায় দূর থেকেই এর সৌন্দর্য চোখে পড়ে। বর্তমানে প্রায় ত্রিশটিরও অধিক অত্যাধুনিক চিত্তাকর্ষক রাইডসম্পন্ন গ্রোনা লান্ড ১৮৮৩ সালে জেমস স্কালথেইস (James Schultheis) নামক একজন জার্মান নাগরিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য গ্রোনা লান্ড পপ কনসার্ট আয়োজনের জন্যও বিখ্যাত। বব মার্লিসহ নামকরা অনেক শিল্পী একাধিকবার এখানে কনসার্ট করেছেন।
সমুদ্রাভিমুখে অবস্থিত গ্রোনা লান্ড পার্ক
স্টকহোম সেন্টার থেকে গ্রোনা লান্ড ভিন্ন দ্বীপে অবস্থিত হওয়ায় স্বল্প সময়ে যেতে হলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার সহায়তায় নিতে হয়। ট্রাম বা বাসে করেও যাওয়া যায়। আমরা ঢাকা বরিশাল রুটের লঞ্চের চেয়ে ছোট সাইজের একটি নৌকা বা জাহাজে উঠলাম। সামনের ছাউনীহীন জায়গায় দাড়িয়ে সবাই মিলে বেশ রঙ্গ রসিকতা করছিলাম। আমাদের সাথে যোগ দিল হালকা মাতাল এক সুইডিশ নাগরিকও। এক পর্যায়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে আমরা কোথা থেকে এসেছি জানতে চাইল। আমি রসিকতা করে উত্তর দিলাম, আমরা এসেছি দুনিয়ার রাজধানী বাংলাদেশ থেকে (We are from Bangladesh, the capital country of the world)। লোকটা খুব মজা পেল। আমার রসবোধ সুইডিশ লোকটিকে আনন্দ দিতে পারায় ভাল লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাহাজটি গ্রোনা লান্ডের নিকটে নোঙ্গর করল। সময় স্বল্পতার কারনে বাইরে থেকে পার্কের রাইডগুলো আর কৃত্তিম শোভা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। অল্প কিছুক্ষন ঘুরে দেখার পর ছুটলাম পরবর্তী গন্তব্য রাজপ্রাসাদ ও পার্লামেন্ট ভবন দর্শনুদ্দেশ্যে।
প্রথমে ট্রামযোগে এবং পরবর্তীতে পায়ে হেটে পৌছলাম গন্তব্যস্থলে। উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মকালে দিন বড় হওয়ায় পর্যটকদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা। সন্ধা হতে হতে প্রায় দশটা এগারটা বেজে যায়। হাটতে হাটতে পুরনো দুর্গের মত একটি জায়গায় ঢুকে পড়লাম। ছোট্ট একটি গেটের সামনে অস্ত্রসহ সুইডিশ সেনাবাহিনীর একজন সৈনিককে দেখে বুঝতে পারলাম আমরা রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছি। উল্লেখ্য স্টকহোম প্যালেস (Stockholms Slott) নামক রাজ পরিবারের সদস্যদের এ কার্যালয়টি স্টকহোমের পর্যটকদের অন্যতম একটি আকর্ষনও বটে। কিছুদূর অগ্রসর হতে অস্ত্রসমেত আরও কতিপয় লোককে চোখে পড়ল। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। পুরনো শহরে অবস্থিত স্টকহোম প্যালেসের কোল ঘেষে অতিবাহিত ছোট হৃদটি প্যালেসের বাহ্যিক সৌন্দর্য অনেকগুন বৃদ্ধি করেছে। হৃদে কয়েকজনকে বড়শি ফেলে অলস বসে থাকতে দেখা গেল। রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফ ((King Carl XVI Gustaf), রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অফিস এবং সুইডিশ রয়াল কোর্ট (Royal Court of Sweden) এখানেই অবস্থিত। ত্রয়োদশ শতকে এ স্থানটিতে প্রথমে একটি উচু ভবনসমেত দুর্গ তৈরি করা হয় যা পরবর্তীতে থ্রী ক্রাউন (Tre Kronor) নামে রাজ প্রসাদে পরিনত হয়। রাজা জন তৃতীয় (King John III) এর তত্তাবধায়নে ষোড়শ শতকে দুর্গের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে রেনেসা-স্টাইলে রাজপ্রাসাদ তৈরি করা হয়। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকেও চলে ব্যাপক কারুকাজ এবং শোভাবর্ধনের কাজ।
পশ্চিম, দক্ষিন, পূর্ব ও উত্তর এই চার সারিতে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই রাজ প্রাসাদে রয়েছে ১৪৩০ টি কক্ষ। একেক সারিতে অবস্থিত ভবনগুলোর মাধ্যমে একেকটি সত্তার প্রকাশ পায়। স্টকহোম প্যালেসের দক্ষিন দিকটি সমগ্র জাতির, পশ্চিমাংশ রাজার, পূর্বাংশ রানীর এবং উত্তর দিকটি পুরো রাজ পরিবারের প্রতিনিধিত্ব বহন করে। যতদূর সম্ভব রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখা হল। হৃদের অপর পাশেই পার্লামেন্ট ভবনের অবস্থান। খানিকটা দূর থেকে ভবনের চারিদিকের পরিবেশটা ভাল লাগায় সেদিকেই পা বাড়ালাম। ভবনটির চারপাশের দেওয়ালে অঙ্কিত কারুকাজগুলো সত্যিই অসাধারন। একেবারে উপরের দিকে সুইডিশ ভাষায় ভবনের নাম লেখা থাকায় সকলেরই পড়তে অসুবিধা হল। আমাদের পথপ্রদর্শক আসাদ জানাল এটি সুইডেনের পার্লামেন্ট ভবন এবং এর নাম রিকসডাগ (Sveriges riksdag)। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে সুইডেনের তিনশত উনপঞ্চাশ জন সংসদ সদস্য এখানেই যুক্তিতর্কে লিপ্ত হন। ভবনটির নামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সুইডিশ সংবিধানে ভবনটির নামের আদ্যাক্ষরসহ সবগুলো বর্ণই ছোট অক্ষরে লেখা।
সুইডিশ পার্লামেন্ট ভবন ও বাম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দর্শনীয় হৃদ
ঘুরে ঘুরে দেখার ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটি স্পটে ছবি তোলার কাজটিও চলল ভালভাবে। রাজপ্রাসাদ আর সংসদ ভবনের মাঝামাঝি স্থানে দাড়ালে আড়াআড়ি কয়েকশত মিটার দূরে খালি চোখেই একটি সুদৃশ্য ভবন দৃশ্যমান হয়। ভবনটির নাম স্টকহোম সিটি হল (Stockholm City Hall)। ভবনটির সাথে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরষ্কারের একটি বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান। এখান থেকেই প্রতি বছর শান্তি ছাড়া বাকি বিষয়গুলোর বিজয়ীদের মধ্যে নোবেল পুরষ্কার বিতরন করা হয়। মৃত্যুর বছর খানেক আগে ১৮৯৫ সালে ডিনামাইট আবিষ্কারক সুইডিশ রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল একত্রিশ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা সমমুল্য, যা তার রেখে যাওয়া সম্পদের শতকরা চুরানব্বই ভাগ মানব সেবার কয়েকটি ক্ষেত্র পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে অবদান রাখা ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে পুরষ্কারের জন্য ইষ্টিপত্র (Will) লিখে যান যা নোবেল পুরষ্কার নামে পরিচিত। ১৯০০ সালে নোবেলের রেখে যাওয়া সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং নোবেল পুরষ্কারের কার্যাবলী সঠিকভাবে আঞ্জাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে নোবেল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছা অনুযায়ী পাঁচটি ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। ১৯০৫ সালে নরওয়ে সুইডেন থেকে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে নোবেল শান্তি পুরষ্কার নরওয়েতে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৩৮-৩৯ সালে অ্যডলফ হিটলারের নাৎসী বাহিনী (Nazi Germany) জার্মানীর তিনজন নোবেল বিজয়ীকে পুরষ্কার না নিতে বাধ্য করে। ১৯৩৯ সালে শান্তি ছাড়া বাকি বিষয়গুলোতে পুরষ্কার দেওয়া হলেও ১৯৪০-৪২ সাল পর্যন্ত কাউকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয় নি। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতি বিষয় যোগ করার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতি বছর মোট ছয়টি বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৬৫ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জীন পল স্টারটে (Jean-Paul Sartre ) ব্যক্তিগত এবং ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী লি ডিউক থো (Lê Ðức Thọ) ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারনে স্বেচ্ছায় নোবেল পুরষ্কার গ্রহন থেকে বিরত থাকেন।
সন্ধার স্টকহোম
সন্ধা ঘনিয়ে আসায় দূর থেকে মর্যাদাসম্পন্ন নোবেল পুরষ্কারের সম্পর্ক বিজড়িত স্টকহোম সিটি হল প্রত্যক্ষ করে সন্তুষ্ট থাকতে হল। আঁধার নামার সাথে সাথে বিজলী বাতির ঝলকানিগুলো এক একটি উজ্জল তারকায় পরিনত হয়েছে। তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত শীতল পানির উপরে সরু সাকোর অগ্রভাগে দাড়িয়ে শহরের সৌন্দর্যের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা ক্ষুধামন্দাও দূর করেছে। পাশ থেকে কে যেন একজন ক্ষুধার কথা বলতেই নিজের মধ্যেও কিছুটা অনুভব করলাম। সঙ্গীদের পীড়াপীড়িতে হাজার মিটার কদম চালিয়ে স্টকহোম সিটি সেন্টারের দিকে চললাম ম্যাকডোনাল্ডসের (McDonald's) উদ্দেশ্যে। মিনিট বিশেক হাটার পর ম্যকডোনাল্ডসের দেখা মিলল। ঝটপট হালাল চিকেন উইংস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফাও কফিতে পেট ঠান্ডা হল। শরীরও আর চলছে না। সেই তিনটা থেকে শুরু করে রাত এগারটা পর্যন্ত একটানা দৌড়ের উপর। শরীরের হক আদায় করা সমীচীন মনে করে আসাদ ভাইদের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। যোগাযোগের মাধ্যম আবারও মেট্রো। আধা ঘন্টার পথ। বাসায় পৌছে গল্পগুজব করার পাশাপাশি স্টকহোম নগরীতে ভ্রমন অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি ঠাহর করতে পারি নি। আজ ১৮ জুলাই ২০১১ ভোর পাঁচটায় ফিরতি ফ্লাইট। ঘুম থেকে উঠে খানাপিনার পর্ব শেষে বিমানবন্দরের দিকে ছুটে চললাম। ঘন্টাখানেক পর বিমানবন্দরে পৌছে স্বল্প সময়ের মধ্যে চেক ইন সম্পন্ন করলাম। নগরীর একপ্রান্তে অবস্থিত বিমান বন্দরের অপেক্ষমান কক্ষে শক্ত কেদারায় আসন গেড়ে পরিষ্কার গ্লাসের মধ্য দিয়ে তখনও দৃষ্টি শহরের দিকে। মনে হল ওপার থেকে কে যেন বলছে ত্রেভলিগ রেসা (trevlig resa- have a pleasure journey)।