পবিত্র হারাম শরীফের উপর ধোয়ার কুন্ডলী
অন্যদের জন্য বাকি সব দিনের মত একটি সাধারন দিন হলেও ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর মুসলমানদের জন্য একটি ইতিহাস, অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটি দিন। দিনটি ছিল ১৪০০ হিজরীর মহররম মাসের প্রথম দিন। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসল্লির অংশগ্রহনে মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইল এর ঈমামতিতে পবিত্র হারাম শরীফে ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। অব্যবহিত পরেই হারাম শরীফের আকাশে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দে উপস্থিত মুসল্লিবৃন্দ স্তম্ভিত। সামনের কাতারে কয়েকজন লোকের মধ্যে কিছুটা হৈ চৈ। তাদের মধ্যে থেকে হঠাৎ একজন লোক উঠে এসে ঈমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইল এর কাছ থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিল এবং একের পর এক বলতে শুরু করল সৌদী সরকারের দুর্নীতির নানা দিক। লোকটি রাসূল (স) এর ঈমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করে বলল, যখন সারাবিশ্ব অন্যায় এবং পাপ কর্মে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, তখন ঈমাম মাহদীর আগমন ঘটবে। লোকটি আরও ঘোষনা করল, এটাই সেই সময় যখন ঈমাম মাহদীর আগমনের ব্যাপারে রাসূল (স) ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। আর ঈমাম মাহদী আমাদের মাঝেই বর্তমান রয়েছে। অজ্ঞাত লোকটি ছিল জুহাইমান আল ওতাইবি।
অতঃপর লোকটি হারাম শরীফে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে দ্বিতীয় একজন ব্যক্তিকে দাড়াতে বলল এবং মাইক্রোফোনের নিকট আসার নির্দেশ দিল, এবং বলল, হে মুসলমানেরা! এই ব্যক্তিই হচ্ছে তোমাদের মাহদী। এর কাছে তোমরা সবাই বাইয়াত গ্রহন কর। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছিল মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ আল কহতনী যিনি কুরাইশ বংশের কহতন গোত্রের অধিবাসী। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল কহতনী রূকন এবং মাকামের মধ্যবর্তী স্থানে এসে দাড়ালেন। অতঃপর জুহাইমান বলল এটা সেই জায়গা যে জায়গায় ঈমাম মাহদীর দাড়ানোর কথা রাসূল (স) বর্ননা করেছেন। ঘোষনাকারী জুহাইমান আল ওতাইবি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে তার কাছে বাইয়াত গ্রহনের শক্ত আহবান জানাল। জুহাইমান আরও বলল, দেখ এই লোকটির নাম মুহাম্মাদ যে নামটা ঈমাম মাহদীর নাম হবে বলে রাসূল (স) ভবিষ্যৎবানী করেছেন, তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ যেমনটা রাসূল (স) ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন, সে কুরাঈশ বংশের অধিবাসী যেমনটা রাসূল (স) ভবিষ্যৎবানী করছিলেন ঈমাম মাহদীর ব্যাপারে। শর্তগুলো ঘোষনা করার পর জুহাইমান আবারও উচ্চস্বরে ঘোষনা করল, এখন তোমাদের সবাইকে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর হাতে বাইয়াত গ্রহন করতে হবে।
পবিত্র হারাম শরীফ দখলের মূল পরিকল্পনাকারী জুহাইমান আল ওতাইবি
ক্ষতিগ্রস্ত পবিত্র হারাম শরিফে অভ্যন্তড়ের দৃশ্য
হারাম শরীফে উপস্থিত মুসল্লীরা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তারা কিছুই বুঝতে পারছিলেন কি হচ্ছে সেখানে। গোলাগুলির শব্দে অনেকেই মুশড়ে পড়লেন। আতঙ্কিত মুসল্লীদের হারাম শরীফ থেকে বের হয়ে যাওয়ারও কোন রাস্তা ছিল না। দরজাগুলো ছিল বন্ধ এবং প্রতিটি দরজাই ছিল জুহাইমান আল ওতাইবির নিজস্ব বাহিনীর শসস্ত্র পাহারাদার সন্নিবেশিত। যে হারাম শরীফে সকল প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ সেখানে এমন অবস্থা সকলকেই গভীর চিন্তায় ফেলে দিল। হারাম শরীফের ভিতরে অগনিত মুসলমান হয়ে পড়ল অবরুদ্ধ। জুহাইমান বাহিনী হারাম শরীফের টেলিফোন লাইন কেটে দিল। গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে তিন চার দিন কেটে গেল। অতঃপর খাবার সরবরাহ করতে না পেরে অন্যান্য মুসলমানদের জুহাইমান এবং তার বাহিনী বাইরে যেতে অনুমতি দিল।
ধারনা করা হয় প্রায় দুইশত থেকে দুই হাজার সৈন্যের বহর ছিল জুহাইমানের। ভিন্ন উপায়ে ক্ষমতা দখলের এই নষ্ট পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়েছিল বিপুল পরিমান আগ্নেয়াস্ত্র। অস্ত্র বহনেও জুহাইমান বাহিনী নিয়েছিল গোপন কৌশলের আশ্রয়। সেদিন পবিত্র হারাম শরীফে প্রবেশ করানো হয়েছিল বেশ কয়েকটি কফিন যার কোনটিতেই কোন লাশ ছিল না। সবগুলো কফিনেই ছিল অস্ত্রের সমাহার। সৌদী পুলিশ এমনকি সৌদী সরকারও মহা সমস্যার মধ্যে পতিত হল। আসলেই হারাম শরীফে কি ঘটছে তা তখনও তাদের নিকট ছিল অপরিষ্কার। তারা বুঝতে পারছিল না তাদের আসলেই কি করা উচিত। ঘটনার তথ্য সরবরাহের জন্য আস্তে আস্তে পুলিশের কতিপয় লোককে হারাম শরীফের দিকে পাঠানো হল। কিন্তু পুলিশের যে সকল লোক হারাম শরীফের দিকে আগ্রসর হয়েছিলেন, তাদের কেউই প্রান নিয়ে ফিরা আসতে পারেন নি। চতুর জুহাইমান হারাম শরীফের মিনারের উপর তার অস্ত্রধারী সৈন্য আগেই নিয়োজিত করে রেখেছিল যাতে কেউ সামনে অগ্রসর হলেই তাকে হত্যা করা সহজ হয়। কর্তৃপক্ষ তখনও বুঝে উঠতে পারে নি ঘটনাটি কিভাবে তাদের মোকাবেলা করা প্রয়োজন।
পবিত্র হারাম শরীফ শত্রু মুক্ত করতে উদ্ধারকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান
ক্ষতিগ্রস্ত পবিত্র হারাম শরীফের অভ্যন্তরের দৃশ্য
এদিকে ঈমাম মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইইল ঠিকই বুঝতে পারলেন পুরো ঘটনাটি উগ্র এবং বিপদগামী কোন গোষ্ঠির একান্তই ব্যক্তিগত খায়েশ পুরনের পূর্ব পরিকল্পনার ফসল। ঈমাম সুবাইইল অনেক কৌশলে নারী পোষাক পরিধান করে হারাম শরীফ থেকে পলায়ন করতে সমর্থ হলেন এবং কর্তৃপক্ষ তার মাধ্যমে আসল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হল। কর্তৃপক্ষ নানাভাবে হারাম শরীফ পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু জুহাইমান বাহিনী সৌদী রাজ পরিবারের ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগে কোনভাবেই হারাম শরীফ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করল। অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে আব্দুল আজিজ বিন বাজ (রহ) এর নেতৃত্বে বিশিষ্ট ফকীহদের পরামর্শ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ পবিত্র হারাম শরীফে বিশেষ বাহিনী প্রেরন করতে বাধ্য হল। ৮ দিন পর শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী বিশাল ট্যাংকের বহর নিয়ে পবিত্র কাবা শরীফের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল। জুহাইমান বাহিনী স্পীকারে তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করতে লাগল। শুরু হল তুমল যুদ্ধ। জুহাইমানের অনুগত বাহিনী অবস্থান নিল কাবা শরীফের ভু-গর্ভস্ত অংশে। ভিতরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য একটি মাত্র ফটক থাকায় জুহাইমান এবং তার অনুগত বাহিনীর সুবিধা হল। সেনাবাহিনীর কেউ ঢুকতে চাইলে ওট পেতে থাকা জুহাইমান বাহিনী তাদেরকে গুলি করে হত্যা করতে লাগল। জুহাইমান বাহিনীর শত শত সৈন্য ফটকের কাছে তাদের শসস্ত্র অবস্থান আরও সুসংহত করল।
কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারল জুহাইমান বাহিনীর পানির কোন সমস্যা নেই, কেননা জমজম থেকে তারা পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছিল। প্রচুর পরিমানে খেজুর সঙ্গে করে নেওয়ায় তাদের খাবারেরও কোন সমস্যা ছিল না। তাদের নিকট ছিল বিপুল পরিমান অস্ত্র সস্ত্রও। স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ তখনও শেষ হয় নি। ইতিমধ্যেই কাবা শরীফের অভ্যন্তরে মৃত্য হল শত শত মুসলমানের। শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে কাবা শরীফ মুক্ত করার জন্য একের পর এক কৌশল অবলম্বন করতে লাগল সেনাবাহিনী। অবশেষে সেনাবাহিনীর কৌশলের কাছে পরাজয় হল আরেকজন ভন্ড লোকের। জুহাইমান এবং তার বাহিনীকে ধরাশায়ী করতে সেনাবাহিনী পানি দিয়ে পুরো ফ্লোর পরিপূর্ন করে দিল এবং অতঃপর তার মধ্যে বৈদ্যুতিক তার ছেড়ে দিলে জুহাইমান বাহিনী অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমনে মৃত্য হয় তথাকথিত ঈমাম মাহাদী মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহসহ তার অধিকাংশ অনুসারীর। আর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ঘটনার মুল পরিকল্পনাকারী জুহাইমান আল ওতাইবি ও তার সত্তর জন সহযোগী।
যুদ্ধে নিহত কথিত এবং ভন্ড ইমাম মাহদী, মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ
এভাবেই সমাপ্তি হয় পবিত্র হারাম শরীফের কয়েকদিনের অচলাবস্থার। এই সময়ের মধ্যে কাউকেই পবিত্র হারাম শরীফের ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নি। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পবিত্র হারাম শরীফে কোন রকম তাওয়াফ হয় নি, হয় নি কোন নামাজ যে ঘটনা ছিল মুসলমাদের ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা। অবশেষে আটকের দুই তিন দিন পর জুহাইমান এবং তার সহচরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আর এর মাধ্যমেই শত্রু চক্রের হাত থেকে দুই সপ্তাহ পর উদ্ধার হয় মুসলমানদের কেবলা পবিত্র কাবা শরীফ। কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে জুহাইমান বাহিনীর প্রায় ২৬০ জন বিপদগামী সৈন্য স্বল্পস্থায়ী এ যুদ্ধে নিহত হয় এবং আর ৫৬০ জন আহত হয় যদিও ইতিহাসবিদদের মতে এ সংখ্যা ছিল আরো বেশি। অন্যদিকে হারাম শরীফ উদ্ধারে নিয়োজিত সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সদস্যের মধ্যে ১২৭ জন নিহত হন এবং আহত হন ৪৫১ জন।
সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী জুহাইমানের ৭০ জন সহযোগী যাদেরকে পরবর্তীতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়
সূত্র:
1) Lecture of Yasir Qadhi
2) Wikipedia
3) The Siege of Mecca