[সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বিভাগে মাদ্রাসাপাস আধা-শিক্ষিতদের ভর্তির দুরভিসন্ধি ঠেকিয়ে দেয়া হল। আমার এই লেখাটি মূলত এই প্রসঙ্গে ]
বাংলাদেশে মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি দেশের আপামর জনসাধারানের বিরক্ত মনোভাব নূতন কিছু নয়, বরং বাড়ছে । আর কোথাও ঢুকতে না পেরে, তারা শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসায় যায় - এই হতাশ মনোভাব পোষন করে থাকেন দেশবাসী। এটা অবশ্যই সত্য যে, মাদ্রাসাশিক্ষার্থীসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপগুলোর প্রতি জনগনের এই বিদ্বেষ বিনা কারনে কিংবা একদিনে তৈরী হয় নি। উগ্র-বিশ্বাস ও শান্তিকামীতার পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে আজকের এই বিরক্তি জনগনের মনে। নিউটনের সূত্র "এভরি একশন হ্যাজ এন অপোজিট এন্ড ইকুয়াল রিএকশন" ফর্মূলায় মাদ্রাসীদের প্রতি ঘৃণা দিন দিন বেড়েই চলছে। জনগন দেখেছে, তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় উগ্র-ধার্মিক কলঙ্কায়নের চেষ্টা করছে স্বল্প-বুদ্ধির মধ্যযুগীয় মানসিকতার এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। এরা ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ নামের একটা আধাসেদ্ধ জগাখিচুড়িতে মগজধোলাই হয়ে চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতিকে খেয়ে ফেলতে চাইছে। ঘুনে ধরা বিশ্বাস নিয়ে মাদ্রাসাপাসেরা ভিক্ষুকের মতো একধরনের বিরক্তিকর সামাজিক উপাদানে পরিনত হয়েছে। আরো হতাশাব্যন্জ্ঞক হল, কোন পক্ষই এখন পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন নি মাদ্রাসা নামের এই মোল্লা উৎপাদন কারখানার সংষ্কারে । সঙ্গত কারনেই তাই বাংলার জনগন এদের কোন সুবিধা দিতে একবারেই প্রস্তুত নন, বরং সম্পূর্ন প্রতিহত করার পক্ষপাতী। এদের নিয়ন্ত্রন করার ঘোষনার যে আহ্বান তাতেও ধ্বনিত হয় একই সুর, ‘মাদ্রাসা এমন এক গোষ্ঠী যারা বোঝে না ফুল কি, সংস্কৃতি কি, গান কি, কবিতা কি’।
মাদ্রাসর উদ্ভাবকেরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে এই দেশের ধর্মকে কলুষিত করতে। ধর্মের নামে নানা প্রকার অপকর্মের উৎস হিসেবে মাদ্রাসাগুলি সবার মাঝে কুখ্যাত। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদসহ আরো অনেক অপরাধের সাথে এর সখ্যতার প্রচুর প্রমান বিদ্যমান। এটা এখন সকলের বিশ্বাস যে, বাংলাদেশ সহ মুসলিম দেশগুলোতে হাজারে বিজারে গড়ে উঠা মাদ্রাসাই জংগীবাদের মূল কারন। সম্প্রতি বাউল ভাষ্কর্য ভাঙ্গা তার একটি জলন্ত প্রমাণ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিক্যাল "দ্য মাদ্রাসা মিথ" লেখায় দেখানো হয়, মাদ্রাসা শিক্ষা কিভাবে মৌলবাদ এবং প্রকারান্তরে সন্ত্রাসবাদ চর্চা করে। (While madrassas may breed fundamentalists.... do not teach the technical or linguistic skills necessary to be an effective terrorist. …the view that poverty drives terrorism ... the idea that madrassas are incubating the next generation of terrorists offers the soothing illusion that desperate, ignorant automatons are attacking us ... technical subjects like engineering)। মাদ্রাসা শিক্ষাকে তাই জংগিবাদের মতোই হুমকি বলে দাবী করা হয়।
এই সব ইতিহাস কারো অজানা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছু শর্ত যুক্ত হলো ফলে মাদ্রাসাপাস ঘুটা-মগজ ছাগ-দাড়িয়ালগুলি আর কিছু বিভাগে ঢুকে শিক্ষার মান নিচে নামিয়ে আনতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বিভাগ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বন্ধ সংক্রান্ত সংবাদটি পড়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে এসেছে তা হল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপ কেন আরো আগেই নেয়া হয় নি? আমাদের আমলাতন্ত্রে আজ যে জামাতী কীট গিজগিজ করছে তা রোধ করা যেতো তাহলে।
এই প্রশ্ন আরো বদ্ধমূল হয় যখন পত্রিকায় প্রাক্তন ভিসি মনিরুজ্জামান মিয়ার বক্তব্য পড়ি : ৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের অপব্যাখা করা হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ঠেকানোর জন্যে। মনিরুজ্জামান কি তাহলে জামাতী ছিলো? একটা জামাতী কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আমীর’ হলো?
আমি যখন ভর্তি বন্ধের সংবাদটি পত্রিকায় পড়ছিলাম তখনই কেন যেন আমার মনে পড়ে যায় আয়েন্দেসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতাদের অনুসৃত নীতির কথা। সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ নির্ভর কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিকশিত হতে পারে না সরকারের সতর্ক নীতিমালার কারনে। যার ফলে পুঁজিবাদী কোন ব্যবসা শিল্প, বিকশিত হতে পারে না পুজির সঞ্চয়ে। আমেরিকা সহ মুক্ত বিশ্বের দেশগুলো যার সম্পূর্ন বিপরীত অবস্থান নিয়ে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতায় একমত হবার কারনে এসব দেশ হয়ে উঠেছে মুক্তচিন্তার প্রতীক, অপার সম্ভাবনাময়।
যোগ্যতা প্রমান করতে পারলে মুক্ত বিশ্বের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র এক গ্রেড টপকে সহসাই চলে যায় পরের গ্রেডে। যে কেউ যে কোন স্কুল থেকে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে যদি স্যাট বা অন্য স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট গুলোতে ভাল করতে পারে। পাবলিক, প্রাইভেট, হোম স্কুলিং - সবগুলোই স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা। এডমিশন টেস্ট থাকে না তবে শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিচিত্রতা পরীক্ষিত হয় স্যাট বা সেরকম স্ট্যান্ডার্ড টেস্টের মাধ্যমে। মেধার বিকাশের সবরকম সহায়তা প্রদানে রাষ্ট্র যেন অংগীকারাব্দ্ধ। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে এ ধরনের কোন টেস্টের প্রচলন নেই। আমাদের উচিত এধরনের কিছু একমুখী স্ট্যান্ডার্ড টেস্টের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করা।
মাদ্রাসার বুরবকেরা কি জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা হারালো তা আরেকবার দেখা যাক। সাধারন শিক্ষা থেকে আসা ছেলে মেয়েরা যেখানে ২০০ নম্বরের বাংলা, আর ২০০ নম্বরের ইংরেজী পড়ে আসে, সেখানে মাদ্রাসা ছাত্ররা ১০০ নম্বরের বাংলা এবং ১০০ নম্বরের ইংরেজী কোর্স পড়ে আসে। আশ্চর্য লাগে, আমরা কি তাহলে এতোদিন যেসব মাদ্রাসাছাত্রকে ভর্তির সুযোগ দিয়েছি, তারা কি এভাবেই ধর্মানুভুতির অপব্যাবহার করে ভর্তি হয়ে এসেছে? যেখানে মূলধারা শিক্ষাব্যাবস্থা থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী কঠৌর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে, সেখানে শুধুমাত্র টুপি পড়ে দেখেই কি মাদ্রাছাপাশদের ভাষায় দক্ষতার প্রয়োজন মাফ হয়ে যেতো? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাব চাই।
মাদ্রাসা ছাত্ররা এতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছে। তারা কি রকম পারফরম্যান্স করে আসছে তার নমুনা এখনকার কিছু শিক্ষকের জামাতী মানসিকতা। শুধু মাত্র ভর্তি পরীক্ষাতে উত্তীর্ন হওয়াটাই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাপকাঠি হতো তবে কখনো কখনো অখ্যাত গ্রামের মেধামী অষ্টমশ্রেণী পাস বালকও আচানক ভর্তি পরীক্ষায় উত্রে যেতো। সুতরাং এখন পর্যন্ত মাদ্রাসা থেকে আসা নিন্মমানের বালকদের পেছনে জনগনের মূল্যবান অর্থের অপচয় রোধকল্পে এতো দেরিতে ব্যাবস্থা নেয়ায় ক্রোধ প্রকাশ করছি।
মাদ্রাসা শিক্ষাকে পুর্ববর্তী কিছু দুর্বল সরকার অনুমোদন দিয়ে যে ভুল করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমন তার একটু মাসুল। এছাড়াও লালনের ভাষ্কর্য যেভাবে এরা উদ্ধত ভঙ্গিতে ভেঙ্গেছে, তাতে সকলেরই একমত হওয়া উচিত যে এই ভ্রান্ত কু-শিক্ষা ব্যাবস্থাটাকে অচিরেই পরিবর্তনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
এ বিষয়ে ব্লগার আরিফুর রহমানের একটি প্রস্তাব আছে। এই কু-শিক্ষায় মগজ-ধোলাইকৃতদের জন্য ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়, যেটি কিনা জনগনের অর্থে পরিচালিত, বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ কেন এতো দেরিতে নেয়া হলো, তার জন্য কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি করতে হবে।
সেই শুভ বুদ্ধির প্রত্যাশায় রইলাম।
( আপদুল্লার মায়ের প্রপাগান্ডার একটি প্যারোডি হিসেবে লেখাটা শুরু হলেও শেষের কয়েকটি প্যারায় আমার নিজের প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:২২