সিরিয়া আরব বিশ্বের একটি গুরুত্বপুর্ন দেশ যে দেশটি একসময় প্যান আরব ধারনা লালন করত ও এই ধারনার উদ্যেক্তাদের একজন। ১৯৫৮ সালে সিরিয়া মিশরের সাথে যুক্ত আরব রাস্ট্র গঠন করেছিল এবং তা স্থায়ী ছিল ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। এই গুরুত্বপুর্ন রাস্ট্রটি সবসময় লালন পালন করেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে পালন করেছিল এবং এখনো পর্যন্ত পালন করতেছে কঠোর ইসরায়েল বিরোধী নীতি। সেই লক্ষ্যে এই রাস্ট্রটির সাথে প্রথমে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ফাতাহ ও পরে চুড়ান্ত সখ্যতা স্থাপন করে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার লড়াকু দল হামাস ও অন্যদিকে ইসরায়েলের অধিপত্যবাদের বিরোধী লেবাননের দুধর্ষ সংগঠন হিজুবল্লাহর সাথে।
আল আসাদ পরিবার ।
১৯৬৭ সালে সিরিয়া মিশরের সাথে যৌথভাবে ইসরায়েলের কাছে হারে এবং সিরিয়ার একটা বিস্তির্ন মালভূমি গোলান হাইট দখর করে নেয় ইসরায়েল ও মিশর হারায় সিনাই উপত্যাকা কিন্তু পরে মিশর ইসরায়েলের সাথে ক্যাম্পডিভেড শান্তিচুক্তি করে তার হারানো সিনাই উপত্যাকা ফেরত পায় কিন্তু সিরিয়া তার অবস্থানে অনড় থাকে। এ কারনে আজ পর্যন্ত সিরিয়ার গোলান হাইট ইসরায়েলের দখলে।
৬৭ এর যুদ্ধের পরপরই সিরিয়ায় একটা ক্যু সংঘটিত হয় আর ক্ষমতায় আসেন সামরিক বাহিনী প্রধান হাফিজ আল আসাদ যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের বাবা। ইসরায়েলের কাছে গোলান হাইট হারিয়ে ও পরে মিশরের অপমানজনক শর্তের বিনিময়ে সিনাই উপত্যাকা ফিরিয়ে নেওয়া নতুন করে ভাবনায় ফেলে সিরিয়াকে । আরব বিশ্বের প্রতি অবিশ্বাস থেকে সিরিয়া আরবমুখী না হয়ে এবার হয়ে পড়ে ইরানমুখী। এর পরিণতিতে ইরাক-ইরাক আট বছর ব্যাপিয়া দীর্ঘকালীন যুদ্ধে আরব দেশগুলির মধ্যে একমাত্র সিরিয়ায় ইরানের পাশে থেকে ইরানকে সক্রিয় সহযোগীতা করে আর অন্যদিকে লেবাননে সিভিল ওয়ারে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে সিরিয়া নতুন করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় ফিরে আসে।
হাফেজ আল আসাদ
পিতা হাফেজ আল আসাদের মুত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন তরুন ছেলে চক্ষু বিশেষজ্ঞ বাশার আল আসাদ।ধারনা করা হয়েছিল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত তরুন বাশার সিরিয়ায় গুরুত্বপুর্ন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন । হাফেজ আল-আসাদের তুলনামূলক রক্ষণশীল রাজনৈতিক নীতিমালা থেকে বেরিয়ে এসে নব্য রাষ্ট্রপ্রধান কি কি উপায়ে সিরিয়ার প্রশাসনকে আরও উদারপন্থী করে ক্রমশ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, এই বিষয়ে ২০০০ সাল থেকে প্রায় এক বছর যাবত একটি রাজনৈতিক বিতর্ক চলছিল যা ডেমাস্কাস স্প্রিং নামে খ্যাতি লাভ করে। উল্লেখ্য যে ডেমাস্কাস স্প্রিং বাশারের পিতার রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতির সামলোচনা করলেও তিনি এই বিতর্ক হতে উত্থাপিত বেশ কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছিলেন ও বাস্তবায়িত করেছেন। যেমন মেজে নামক একটি কারাগার যেখানে রাজনৈতিক বন্দীদের আটক রাখা হত, বাশার এই কারাগারের সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়ার ব্যাবস্থা করেন ও কারাগারটি বন্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনি পশ্চিমা বিরোধীতা, ইরান,রাশিয়ার ও চীনের সাথে উত্তোরোত্তর সম্পর্ক বৃদ্ধি ও হামাস হিজবুল্লাহ সাথে গলায় গলায় পিরিত বাবার চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন। হামাস নেতাদের সিরিয়ায় আশ্রয়দান ও তাদের সবধরনের সহযোগীতা তার অন্যতম। পশ্চিমাবিশ্ব বাবা হাফেজ আল আসাদকে নিয়ে চিন্তিত না হলেও এবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন বাশার আসাদকে নিয়ে । আসাদের অতি ইরান, হামাস হিজবুল্লাহপ্রীতি সিরিয়াকে গুরুত্বপুর্ন করে তুলল পশ্চিমাদের কাছে। তারা সময় অসময়ে আসাদকে বিভিন্ন প্রলোভন দিতে লাগলো পশ্চিমাদের ভাষায় এই তিন শয়তান অক্ষের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের । ইসরায়েল বার কায়েক ঘোষনাও দিয়েছিল যে সিরিয়া যদি ইরানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাহলে আলোচনা ছাড়াই আমরা দখলকৃত গোলান মালভূমি সিরিয়াকে ফেরত দিব কিন্তু আসাদ ইসরায়েলের এসব মিষ্টি কথাই কখনো প্রলোভিত হননি। অনেক সমালোচক বলে থাকন যে ইসরায়েল বিরোধীতা আসাদের ক্ষমতায় দীর্ঘ থাকা চালমাত্র কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে আসাদ ইচ্ছা করলেই ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মিশর জর্ডানের মত গোলান মালভূমি ফেরত নিতে পারতেন বা হামাস নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।
শিশু বাশার আল আসাদ
ইরাকের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ বিরোধ ও সম্পর্কে বৈরিতা সত্ত্বেও বাশার আল-আসাদ ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর ইরাক অভিযানের বিরোধীতা করেছিলেন। বাশারের এই মতামত মূলত সাধারণ সিরীয় জনমতের প্রতিফলন ছিল। বাশার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ার অস্থায়ী আসনের ভোটাধিকার বলে উক্ত অভিযানের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
এভাবে বিভিন্ন কারনেই মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে সিরিয়ার সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যেতে থাক।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সিরিয়ার বৈরি সম্পর্কের আরেকটি কারণ ছিল লেবাননে সিরীয় সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি, যদিও ২০০৫ সালে সিরিয়া লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। মুলত সেসময় যুক্তরাস্ট্র লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি হত্যার অভিযোগকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে সিরিয়ার বিরুদ্ধে।
যাইহোক, আরব বসন্তের ঢেউ শুরু হল তিউনিসিয়ায় । সেই ঢেউ পর্যায়ক্রমে মিশর থেকে লিবিয়া ও তারপরে আঘাত হানে সিরিয়ায় ২০১১ সালে মার্চে আর দীর্ঘদিনের সুযোগ সন্ধানী পশ্চিমারাও পেয়ে যায় মওকা সুযোগ। পশ্চিমাদের সহযোগীতায় ও সৌদি, তুরস্ক, কাতারের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সিরিয়ার গণআন্দোলন রাতারাতি পরিণত হয় স্বশস্ত্র বিদ্রোহে। আর আসাদও অনুসরন করেন উত্তরসুরী হাফিজ আল আসাদকে। এখানে উল্লেখ্য আশির দশকে হাফিজ আল আসাদের বিরুদ্ধে হোমস প্রদেশে একটা স্বশস্ত্র বিদ্রোহ হয়েছিল কিন্তু হাফিজ আল আসাদের কঠোরভূমিকার কারনে কয়েকহাজার মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে তা দমন করা হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন আসাদের পতন অতি দ্রুতই হবে যেমন হয়েছিল বেন আলী, মোবারক ও গাদ্দাফীর কিন্তু না সবার প্রফেসী ভূল প্রমান করে বিদ্রোহের প্রায় দু’বছর হওয়ার পরেও আসাদ এখনো সিরিয়ার ক্ষমতায় টিকে আছেন বহাল তবিয়তে। বেন আলী, মোবারক আর গাদ্দাফির পক্ষে ছিল না কোন রাস্ট্রশক্তি আর ছিল না তাদের কোন জনসমর্থন কিন্তু সিরিয়ার প্রেক্ষাপট পুরোপুরি আলাদা।
প্রেসিডেন্ট বাশাল আল আসাদ
তুরস্ক ভেবেছিল, আসাদের সহজেই পতন হবে তাই একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসাদকে ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি তুরস্ক। ভেবেছিল, আসাদের পতন ঘটিয়ে সেখানে নিজস্ব স্যাটেলাইট সরকার প্রতিষ্ঠা করবে কিন্তু বিধিবাম ! বেঁকে বসেছে মিত্র ইরান আর রাশিয়া ও চীন এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইরাকও। অন্যদিকে আরবের স্বৈরাচারী শাসকগণ ভেবেছিল, সিরিয়ার আসাদকে হঠাতে পারলে তারা মধ্যেপ্রাচ্যে দ্রুত প্রভাববিস্তারকারী ইরানের রাশ টেনে ধরতে পারবে। আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রের উদ্দ্যেশ্যও তাই। গাদ্দাফী ও সাদ্দাম উৎখাতে আমেরিকা, ইউরোপের যে স্বার্থ নিহিত ছিল সিরিয়ার বেলায় তেমন নেই। স্বার্থটা হল আসাদকে হঠাতে পারলে ইরানকে দুর্বল করা অনেক সহজ হবে আর ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করা যাবে। মধ্যেপ্রচ্যের আরব দেশগুলির মধ্যে একমাত্র সিরিয়ার ই সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান আর রয়েছে হালের ইরাকের সাথে। সিরিয়ার সাথে ইরানের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক, রয়েছে নিরাপত্তাগত চুক্তি। সিরিয়াই হল ইরানের জন্য আরব- ইসরায়েল প্রবেশের একমাত্র পথ। সিরিয়া সরকার ইরানের আদর্শিক মিত্র না হলেও এবং সিরিয়া সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসক আসাদ হল সংখ্যালঘু আলাভী সম্প্রদায়ের তবে আসাদ সংখ্যালঘু আলাভী সম্প্রদায়ের হলেও সুন্নিদের মধ্যেও আছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে মডারেট সুন্নি ও সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের মধ্যে। এছাড়া সিরিয়া সরকার ইরানের আদর্শিক মিত্র না হলেও সিরিয়া যেহেতু আমেরিকা ও ইসরায়েল বিরোধী তাই শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এই নীতিতে সিরিয়া ইরানের বন্ধু । সেনাবাহিনী এখনো পুরোপুরি আসাদের নিয়ন্ত্রনে যদিও সেনাবহিনীতে সুন্নিরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। এ থেকেই বুঝা যায় আসাদের জনপ্রিয়তা।
মধ্যপ্রচ্যের একমাত্র সিরিয়ার তারতুসে আছে রাশিয়ার নৌঘাটি এবং সিরিয়া রাশিয়ার কৌশলগত মিত্রও বটে। আরব দেশগুলির মধ্যে সিরিয়া হল রাশিয়ার প্রধান অস্ত্রক্রেতা। রাশিয়া চাচ্ছে না সিরিয়াকে হাত ছাড়া করতে কারন রাশিয়া আর পশ্চিমাদের ফাঁকা বুলিতে বিশ্বাসী নয়। রাশিয়া দেখেছে ইরাক ও লিবিয়ার পরিণতি, পশ্চিমারা কার্য উদ্ধারের পর সেখানে রাশিয়ার প্রভাব নেই বললেই চলে। তাছাড়া রাশিয়ার পুতিন বরাবরই পশ্চিমা বিরোধী এবং সিরিয়ান ইস্যুতে পজিটিভ ভূমিকা নিয়ে রাশিয়া ও চীন তাদের মিত্রদের এই বার্তা দিতে চাচ্ছে যে আমরা তোমাদের মিত্র । তোমাদের ছেড়ে যাব না। তাইতো রাশিয়া জাতিসংঘে যে কোন সিরিয়া বিরোধী প্রস্তাবেই ভেটো দিচ্ছে এবং অঙ্গীকার করেছে ভবিষ্যতে তারা ভেটো দেওয়া অব্যাহত রাখবে ।
(....চলবে )