আশির দশক এমন এক সময়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল নষ্টদের অধিকারে। নষ্টদের রাজআধিরাজ তখন আমাদের রাষ্ট্রপতি। সেই ইতর প্রানীটি নেমেছিল সব কিছু নষ্ট কারার মহাসংগ্রামে। নারী থেকে নদী, সাহিত্য থেকে ধর্ম সব কিছুতেই বসাতে শুরু করলো দুর্গন্ধময় নখের আচড়। সেই নষ্ট সময়ে নষ্টদের সফল হওয়ার ভবিষৎ বানী করেছিলেন বাঙালির ভিষন অপছন্দের মানুষ, কবি হুমায়ুন আজাদ। কবিতার নাম সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে হলেও, নষ্টদের অধিকারে থাকা রাষ্ট্র ও গনতন্ত্রে কথা উঠে এসেছে কবির দীর্ঘশ্বাসে। কবিতা যতই এগিয়েছে ততই বেড়েছে যন্ত্রনা, ভবিষ্যতের যন্ত্রনা।
হয়ত তার ভবিষ্যত বাণীর অনেক কিছু ফলে গেছে, অনেক কিছু চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে। এখন সব সংঘ আর পরিষদ নষ্টদের অধীনে। সংঘ আর পরিষদগুলো ঝলমল করছে নষ্টদের সান্নিধ্য পেয়ে। নষ্টরা ছুয়ে ফেলেছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য, সব ধর্মমন্দির। গনতন্ত্র আর রাষ্ট্রযন্ত্রের হেটে যাওয়া নষ্টদের পথে হেটে চলেছে সব জনতা। জনতা এখন ভোট দেয় নষ্টদের এবং প্রতিনিয়ত নষ্টদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে সুখ লাভ করে। চলে গেছে আমাদের সমাজ সংসার, সভ্যতা সব কিছু। চলে গেছে মস্তিষ্কহীন গর্ধবদের অধিকারে। রাজনীতি ব্যবসায়ীরা সৃষ্টি করছে ইতিহাস, বদলে যাচ্ছে সব দলিল আর জাদুঘরের অথর্ব মুর্তি। সব রাজনৈতিক আদর্শ খেয়ে ফেলেছে ধর্মজীবিরা।
যারা অমর হতে চায় তাদের জন্য এই কবিতা এক বিরাট দুঃসংবাদ। মেধাবীরা শুধুমাত্র অমর হওয়ার সুযোগ পায় কিন্তু এখন গর্ধবেরাও অমর হতে চায়। অবশ্য অমরতা কবির কাছে নিঃস্ফল আশা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি মনে করেন অমরতা নির্বোধদের বেঁচে থাকতে আশা জাগায়। তবুও সেই নির্বোধদের জন্য তিনি ব্যথায় কাতর হয়েছেন। বলেছেন, তাদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে অমরতা চলে যাবে নষ্টদের অধিকারে। ধনীর স্থূল স্ত্রী থেকে মগজপচা রাজনীতিবিদ সবার মধ্যই এখন জ্বলে উঠে অমর হওয়ার অনন্ত এক লিপ্সা।
সেই সব নারীরা যাদের শরীরে বয়ে যায় সৈন্দর্য্যের সমুদ্র, যাদের আমরা ভাবি তারা শুধুমাত্র দেবতাদের মত পবিত্র পুরুষের যোগ্য। তারা দল বেধে চলে যাবে বয়স্ক আর লম্পট ধনীদের বাহুতে, পত্নি না হোক অন্তত উপপত্নি হবে। তারা ঘ্রিনা করবে চুম্বন আর প্রেম, প্রার্থনা করবে যৌনদাসত্ব ও অনুমদিত ধর্ষনের।
সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
হুমায়ুন আজাদ
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানব মুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ পরিষদ;-চ’লে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ’লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর গ্রাম ধানখেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ নির্জন প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার রাত
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবীশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙ্গুল
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চ’লে যাবে সেই সব উপকথা: সৌন্দর্য প্রতিভা-
মেধা;-এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাস ভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুই হাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট
গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্কস-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৮