আমার ভ্রমণ সঙ্গী সমাজবিজ্ঞানী দূলাভাই জাহাঙ্গীর আলম
পুরি যারা আসেন তাদের অনেকের ঘোরাঘুরির উপায় হচ্ছে নানা ধরনের ট্যুর। পুরির আশেপাশে জগন্নাথ মন্দিরসহ অন্তত ৪০টি বিখ্যাত মন্দির আছে। সেই সাথে কোনারক সুর্য মন্দির, নন্দন কানন, ডলফিন সি, রিজার্ভ ফরেস্টসহ নানা দর্শনীয় স্থান। ওড়িশ্যা পর্যটন বিভাগের এসি/ননএসি/মাইক্রবাসে করে এসব স্থান ঘোরানো হয়। ৮-১০ টি স্পটের জন্য দিনব্যাপী এসব প্যাকেজ ৩৫০ রুপি থেকে হাজার রুপির মধ্যে। বেসরকারিভাবে মুড়ির টিন ধরনের বাসে অবশ্য ২০০ থেকে ৩৫০ টাকায় দিনব্যাপী ঘুরে আসা যায়। বাংলাদেশ থেকে যারা যান, তারা অবশ্য মুড়ির টিন প্যাকেজে মানিয়ে নিতে পারবেন না।
আমাদের মন্দিরে মন্দিরে যাবার দরকার ছিলনা। আমরা কোনারক সূর্য মন্দিরে যেতে চাই। যে মন্দিরকে দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, কোনারক মন্দির না দেখা হলে মধ্যযুগীয় সভ্যতার অনেকটাই দেখা হতো না। রবীন্দ্রনাথের কারণে সেই সভ্যতা দেখার আগ্রহ ছিল।
কোনারক যাবার জন্য প্রাইভেট কারের ভাড়া পড়ে হাজার থেকে ১২০০ রুপি। আমরা একটু কমে খুজছিলাম। আমাদের হোটেলের বয়ের পরামর্শে ৬০ রুপিতে অটোরিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ১০ মিনিট পরপর কোনারকের বাস। ভাড়া জনপ্রতি ২৫ রুপি।
পুরি বাসস্ট্যান্ড। এইরকম বাসে চড়ে আমরা কোনারক গেলাম।
লোকাল বাস দেখে একটু দমে গেলেন দুলাভাই। তবুও উঠলাম। বাস ছাড়তেই সমুদ্রের বাতাসে দুলাভাই ঘুমিয়ে গেলেন। আমি দেখতে থাকলাম কলিঙ্গ যুদ্ধের নায়ক সম্রাট অশোকের চারণভ’মি। দেখলাম দয়া নদী। যে নদী কলিঙ্গ যুদ্ধে লাশ-রক্তের নদীতে রূপ নিয়েছিলো।
দয়া নদী সমুদ্রে মিশেছে। সম্রাট অশোকের নৃশংসতার সাক্ষীও এই নদী
বাসে যাত্রীদের মধ্যে অনেক ছাত্র-ছাত্রীও ছিল। তাদের পরনে কলেজ ড্রেস। ইউনিফর্ম পরা থাকলে হাফ-ভাড়া। বিষয়টি আমাদেও দেশেও বিবেচনার দা্িব রাখে। শিক্ষার্থীদের গায়ে ইউনিফর্ম বা কলেজ লোগা দেখা গেলে হয়তো প্রতিদিন বাসের মধ্যে বচসা হতো না।
বাসের ভেতরে এক ঝলক
প্রায় একঘন্টা পর কোনারক পৌছালাম। সারাভারত থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই মন্দির দেখতে আসেন। পৃুথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এর অপূর্ব নির্মাণ ও সৃষ্টিশৈল্য দেখতে ভিড় করা বিদেশির সংখ্যাও কম নয়।
দূর থেকে কোনারক সূর্য মন্দির
সমুদ্রের তীর ঘেষে সূর্য দেবতার প্রতি ভক্তিতে পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের (১০৭৮-১৪৩৪) রাজা প্রথম নরসিংহদেব(১২৩৮-১২৬৪) এই মন্দিরের নির্মাণ করেছিলেন। মাটি থেকে মন্দিরের চুড়ার উচ্চতা প্রায় ২৩০ ফুট (৭০ মিটার)। এটি এখন ভারতের শ্রেষ্ঠ দশটি দর্শনীয় স্থানের একটি পূরার্কীতি এবং অবশ্যই ইউনেসকোর বিশ্ব সভ্যতার অংশ।
মন্দিরটির ভেতরে সম্ভ্রান্তদের প্রার্থণা কেন্দ্র, মাঝখানে নাটমন্দির (যেখানে নৃত্য পরিবেশিত হতো), এর বাইরের দিকে জগমোহন বা সাধারনের শ্রদ্ধা জানানোর কেন্দ্র –এই তিনভাগে বিভক্ত। সাধারণ হিন্দুদের নাকি ভেতরে প্রবেশাধিকার ছিল না। ভেতরে প্রার্থনা মঞ্চের পাশেই একটি ঘর। গাইডরা জানান, সেখানে সেবাদাসীদের কাছ থেকে যৌনভোগ নিতেন সম্ভ্রান্তরা।
বিশাল আকৃতির এই মন্দির নির্মানশৈলি প্রশংসার দাবি রাখে। পুরো মন্দিরের অবয়ব জুড়ে পাথরের টেরাকোঠার কাজ। টেরাকোঠাগুলো সবই নরনারীর যৌনসংগম ও আচরণ সংশ্লিষ্ট। দুলাভাই একটি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি জানালেন, প্রাচীন বা মধ্যভারতে হিন্দু সমাজের মধ্যে পলোগামিতা বৈধ ছিল। এই চিত্রগুলো তার অনন্য উদাহরণ। মন্দির মানে শ্রষ্টার জন্য ভক্তি প্রদর্শনের স্থান। সেখানে এই অবাধ যৌনচিত্রের শিল্পকলা স্থাপনের কারণ আমার বোধগম্য নয়। অধ্যাপক দ্লুাভাই সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় জানালেন, বেশিরভাগ ধর্মেই বংশবৃদ্ধির জন্য যৌনকর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে প্রাচীন হিন্দু ধর্মে অবাধ যৌনাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। যৌনতৃপ্তির মাধ্যমে দেব-দেবির আর্শিবাদ প্রাপ্তি—ও অনেকের লক্ষ ছিল।
আমরা টেরাকোঠার কাজ গুলো গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। এক নারী-এক পুরুষের পাশাপশি দুই নারী এক পুরুষ, বা দুই পুরুষ এক নারীর অনেক চিত্র মন্দিরের গায়ে দেখলাম। এ থেকে বোঝা যায় যখন মন্দিরটি প্রতিষ্টা করা হয় তখন সমাজে এ ধরনের যৌনাচার খুব স্বাভাবিক ছিল।
এন্দিরের ইতিহাস থেকে জানলাম অকেবারই ভারতের মুসলিম শাসকরা এর ক্ষতিসাধণ করেছেন। তবে মন্দিরের কাঠামো এত মজবুত পাথরের তৈরি যে কেউউ এটা গুড়িয়ে দিতে পারেননি। আমি লক্ষ্য করে যা দেখলাম তাতে মনে হলো হয়তো মুসলিম শাসকরা মন্দির ধংস করতে চাননি। তারা কেবল তাদের ভাষায় ”অশ্লীল” যৌনসংগমের চিত্রগুলো ধংস করতে চেয়েছিলেন। কারণ বেশিরভাগ টেরাকোঠা খুঁচিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। তবে মন্দিরের চুড়া বা এর নীচে থাকা চারপাশের চারটি চক্র অক্ষতই আছে।
কোনারক দেখা শেষ করে বাসে চড়েই পুরি ফি“ এলাম। বাস থেকে রাস্তার পাশের মন্দিরগুলো ভালো করে খেয়াল করলাম। ওড়িশ্যায় আরেকটি জিনিস লক্ষনীয় তা হলো সব মন্দিরের চুড়ায় একটি নগ্ন নারী মূর্তি। এবং মূর্তির গায়ের রং ফর্সা। ওড়িশ্যার নারী-পুরুষ বেশিরভাগের গায়ের রঙ কালো। একটু বেটে-খাটো ধরণের গড়ন। অনেকেই হিন্দিও চেয়ে বাংলা ভালো জানেন। জানা গেল, একসময় ওড়িশ্যা অঞ্চল অনুন্নত ছিল। লেখাপড়ার জন্য অনেকেই কলকাতা আসতো। বাঙলা ও ওড়িশ্যা লাগোয়া প্রদেশ হওয়াও একটা বড় কারণ।
যেমন: যাত্রীগন ধ্যান দেন। তিন নম্বর প্লাটফর্মে ভুবনেশ্বর এক্সপ্রেস আসিযাই আছে।
এর অর্থ: যাত্রীরা মনোযোগ দিন। তিন নম্বর প্লাটফর্মে ভুবনেম্বর এক্সপ্রেস এসে গিয়েছে/ পৌছেছে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে হোটেল ফেরার জন্য রিক্সা নিলাম। রিক্স্ওালার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেই সে জানালো, হিন্দি জানেনা, ওড়িয়া জানে। আমার হিন্দিতে বললাম বাংলা জানো। সে জানালো, বাংলা বুঝতে পারে বলতে পাওে না। আমরাও ওড়িয়া বুঝতে পারছিলাম। জানলাম রিক্সাওয়ালা মুসলমান। পুরি’র মতো হিন্দু এলাকায় একজন মুসলমানকে পাওয়া গেল। আমরা জানতে চাইলাম এখানে আর মুসলমান আছে কিনা। সে জানালো, পুরিতেই চার-পাচশ মুসলমান আছে। একটা মসজিদ আছে। যা আমাদের হোটেলে যাওয়ার পথেই পড়বে।
দেখলাম খিস্টান ও মুসলমানরা বহুদিন ধরেই শহরের একটি এলাকায় বাস করে। গীর্জার একশ গজের মধ্যেই মসজিদ। গ্রিলের দরজায় নাড়া দিতেই খাদেম সাহেব হাজির হলেন। আমরা নামাজ আদায় করলাম। ফেরার সময় দানবাক্সে বড় নোট দান করতেও সং্কোচ হলো না।
পুরিতে দুদিন ধরে আমরা প্রায় না খেয়ে আছি। মিষ্টি, আপেল, কমলা, পাউরুটি এসব খাচ্ছি। ইডলি, দোসা খেতে পারছি না। রিক্সাওলার মাধ্যমে বাংলা হোটেলের সন্ধান পেলাম। নাম হোটেল বসু। পুরি হোটেলের কাছে গোপাল বল্লভ রোডে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো আাকাশের চাদ হাতে পেলাম। তিন দিনের মাথায় ভাত দেখে গোগ্রাসে খেলাম। মুরগির কারিটাও ছিল অতি চমৎকার। হোটেল বসু’র ম্যানেজারকে কথা দিলাম বাংলাদেশে গিয়ে আপনার হোটেলের কথা লিখবো। যারা আমার লেখা পড়বে তারা এলে আপনার হোটেলে আসবে। বলে রাখি হোটেল বসুতে রুম ভাড়া ৬০০ থেকে ১৫শ রুপির মধ্যে। বাঙালিদের জন্য আদর্শ জায়গা। আহা, আমাদের কেউ যদি আগে এই হোটেলের কথা বলে দিত, তাহলে আমাদের এত কষ্ট হতো না। আমাদেও হাতে সময় থাকলে বাকি দিনগুলো বসুতেই থাকতাম। সেই রাতেই আমাদেও কলকাতা ফিরতে হবে। পরদিন সকালে দ্লুাভাইয়ের কেমোথেরাপি দিতে হবে। বিকেলের সময়টা সৈকতেই কাটাবো ঠিক করলাম।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। আমাদেও আগের হোটেল দিপকের রিসেপশনে লাগেজ রাখা আছে। সৈকতের ওই মাথায় সেই হোটেল। দুলাভাইকে বিচ রোড়ের বেঞ্চে বসিয়ে আমি চার+চার= আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লাগেজ আনলাম। রাত আটটা বাজে। আমরা ঠিক করেছি আটটায় হোটেল বসুতে খেয়ে সাড়ে নটার মধ্যে রেলস্টেশনে পৌছাবো।
হঠাৎ কী যেন মনে হতেই আমি ট্রেনের টিকিট বের করলাম। দেখি আমাদেও ট্রেনের সময় ২০.৩০ মিনিট। মানে সাড়ে আটটা। আর মাত্র ২৫ মিনিট বাকি। অথচ আমরা জানতাম আমাদের ট্রেন সাড়ে দশটায়। সাথে সাথেই অটো ঠিক করলাম। যা ভাড়া চাইলো তাতেই রাজী হলাম। খাওয়া চুলোয় গেল। স্টেশনে যখন পৌছালাম তখন আটটা বিশ। দুতিন মিনিটের মধ্যে বগি খুজে পেলাম। হাতে আছে আর ছয়-সাত মিনিট। এরমধ্যে কিছু খাবার না কিনলে রাতে না খেয়েই থাকতে হবে। হাই রিক্স নিয়ে নামলাম। এক দৌড়ে স্টেশনের বাইরে এসে দেখি আটার রুটি বিক্রি হচ্ছে। পাশের দোকানে ডিম ভাজি পাওয়া যাচ্ছে। দুই দোকানে একসাথে অর্ডাও দিয়ে ডিম রুটি নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকতেই দেখি সবুজ পতাকা উড়ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা দরজায় উঠতেই ট্রেন হালকা দুলুনি দিয়ে চলতে শুরু করলো। আমি কামরার মাঝ দিয়ে হেটে হেটে আমাদেও কামরায় পৌছালাম। উদ্বিগ্ন দুলাভাইয়ের মুখের সেই ফ্যাকাসে রঙ আমার বহুদিন মনে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:৪১